প্রেমের গল্প
‘আরেকটা কথা বললে একদম থাপড় দেব।’
 ‘গাল পেতে দিলাম, দে।’
 বিনা নোটিশে আকাশ ফুটো হয়ে গেছে। কদিন ধরে এই শহরে তুমুল বর্ষা, যেন বা ত্রিকাল ধেয়ে বৃষ্টি নামছে।
 বিকেল থেকে হরর ছবিতে ডুবে ছিল বিজন। ছাতা নিয়ে মুনা এসে দরজা ধাক্কাতে থাকে। ছবি-দৃশ্যের মোহাচ্ছন্নতার কঠিন ইন্দ্রজাল থেকে নিজেকে বিযুক্ত করে মুনাতে বিন্যস্ত হয় বিজন। এ সময় মুনার আগমন বিজনকে বিরক্ত করে।
 মুনা হরর কোনো কিছু দুচোখে দেখতে পারে না।
 এরপরও বিজনের সঙ্গ পেতে মুনা বেশ কিছু হরর ছবি দেখেছে। কী অদ্ভুতভাবে একটি ঘাড় থেকে মস্তক খসে পড়ল। কারও-বা ঘাড়ের মধ্যে দাঁত বসিয়ে দিচ্ছে। রূপসী নারীর বীভৎস দাঁত। কবর থেকে উঠে আসছে জ্যান্ত লাশ—কিছুক্ষণ দেখে দেখে হাই তুলতে তুলতে বিজনকে ধাক্কায়। এই একজনই তো বন্ধু তার, যার কাছে মিহিরের গল্প করা যায়। মুনার অন্তরে জ্বলে উঠতে থাকা প্রদীপের উল্লম্ফন সমূলে দাবিয়ে বিজন বলে, ‘তোদের সম্পর্কটা আমি বুঝি না, যেন দাতা আর গ্রহীতা। ভার্সিটিতে থাকতে তোকে নোট দিয়ে হেল্প করত, অবিন্যস্ত তোকে বিন্যস্ত করে নিজের মতো চলতে শেখাল মিহির। ওর কাছে গিয়ে তুই মাটির ঢেলা হয়ে গেলি। তোর নিজস্বতা ওর সামনে দাঁড়ায়ই না।’
 ‘ঈর্ষা করছিস ওকে?’ বিজনের গা জ্বালাতে ঠোঁট চেপে হাসে মুনা, ‘আমি আদতে কোনো ভদ্রমানুষ নাকি? ক্লাস ওয়ান থেকে তোর সঙ্গে চলে চলে তোর মতোই বুনো হয়ে গিয়েছিলাম।’
 ‘আমি তোর প্রেমে পড়লাম কবে যে ওকে ঈর্ষা করব?’
 ‘আমার এই খালি ঘর পেয়ে তোরা কী সব অসভ্যতা করিস…সুযোগ তো আমিই করে দিই, না?’
 বৃষ্টির ছাট জানালার শার্সি কাঁপাচ্ছে।
 কালই মুনার বিয়ে। মেয়ে আজ এসে আজাইরা বকবক করছে।
 মিহিরের সঙ্গে কত পথ হেঁটেছে মুনা। কী চৌকস তার দেহ ভঙ্গিমা। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কত মেয়ে প্রেমে পড়েছিল মিহিরের। ছেলেটি সামনে এসে দাঁড়ালে ফলসা পাতার মতো কাঁপত মুনা। মিহির সবাইকে বাদ দিয়ে…। ভাবলেই মুনা অদ্ভুত রোমান্সের নৌকায় ভাসতে থাকে। নিজ চিত্তের আদলে মুনাকে বিন্দু বিন্দু করে গড়ে নিয়েছে মিহির।
 মিহিরকে মুনা প্রায়ই বলে, ‘বিজনটা জংলি। মেডিকেলে ভর্তি হয়ে ভাগা দিয়েছে। দিনরাত নিজ আলস্যে কার্পেটে গড়ায়। ওর বাবা-মা ওকে বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে গেছেন।’
 সেদিন বিজনের ঘরে ছিল আলো-ছায়ার সঙ্গম। মিহিরের সঙ্গে শরীরের প্রায় শেষ ধাপে গিয়ে যৌনজ্বরে কাতর মুনা যখন চাদরের মতো নিজেকে বিছিয়ে দিয়েছে, ছটফট করতে করতে নিজেকে টেনে তোলে মিহির, ‘এখন নয়। এসব বিয়ের পর হবে।’ এতে করে মুনার হৃদয়ের কানকোর সঙ্গে এমন সুন্দরভাবে গেঁথে গেছে মিহির, অবিরাম ওর গল্প করার জন্য বিজনের মতো ভালো শ্রোতা সে আর পায় না।
 ‘তুই ইন্টার পাসই থাকবি?’
 ‘তোর প্রবলেম কী?’ রিমোট হাতে টিভির স্ক্রিন পাল্টাতে থাকা বিজন বলে। তার ঝাঁকড়া চুলে কদিন চিরুনি পড়েনি সেই হিসাব নেই। মাঝেমধ্যেই পাহাড়-জঙ্গলে উধাও হয়ে যায় সে, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী অধ্যুষিত অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে টাকা ফুরোলে তারপর চলে আসে আবার।
 একটানা বিজন না থাকার সময়টা বড় শূন্য লাগে মুনার। মিহিরের সান্নিধ্যও তাকে পূর্ণতা দেয় না। ওর সাহচর্য সাধনের চেয়েও অনেক তীব্র এই গল্পগুলো রঙিন সুতোয় বুনে বুনে বিজনকে শোনানো।
 ‘তুই মানুষ না হয়ে অন্য কিছু হওয়ার কথা ছিল।’
 মুনার এ কথায় হা হা করে হাসে বিজন, ‘এদ্দিনে বুঝলি?’
  শুধু কি মিহিরের গল্প? মিহির যখন তার জীবনে আসেনি, নিজের জীবনের প্রতিটি টুকরো গল্পকে রীতিমতো রূপকথা বানিয়ে মুনা বিজনের কাছে প্রকাশ করেছে। শৈশব থেকেই মুনা অনুভব করে, একটা ছায়া ঘোরে তার সঙ্গে যার কোনো অবয়ব নেই, রূপ নেই। যখন সে একা থাকে তখন ফিসফিস করে সেই ছায়ার সঙ্গে ভরা পূর্ণিমার চাঁদে যাওয়ার কথা বলে। কুয়াশা-ভোরে অনন্তে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া থেকে মাছকুমারী হয়ে মুনাকে সমুদ্রে সাঁতার কাটার গল্প বলে সেই ছায়া। ভয়ে হাত-পা হিম হয়ে আসে বলে কখনো একা ঘরে ঘুমায় না মুনা।
শুধু কি মিহিরের গল্প? মিহির যখন তার জীবনে আসেনি, নিজের জীবনের প্রতিটি টুকরো গল্পকে রীতিমতো রূপকথা বানিয়ে মুনা বিজনের কাছে প্রকাশ করেছে। শৈশব থেকেই মুনা অনুভব করে, একটা ছায়া ঘোরে তার সঙ্গে যার কোনো অবয়ব নেই, রূপ নেই। যখন সে একা থাকে তখন ফিসফিস করে সেই ছায়ার সঙ্গে ভরা পূর্ণিমার চাঁদে যাওয়ার কথা বলে। কুয়াশা-ভোরে অনন্তে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া থেকে মাছকুমারী হয়ে মুনাকে সমুদ্রে সাঁতার কাটার গল্প বলে সেই ছায়া। ভয়ে হাত-পা হিম হয়ে আসে বলে কখনো একা ঘরে ঘুমায় না মুনা।
 শৈশবে এসব কথা বললে সবাই হেসে উড়িয়ে দিয়েছে। একমাত্র বিজন বিশ্বাস করে বলেছে, ‘তোর ছায়ার সঙ্গে আমার দোস্তি হয়ে গেছে, সে এখন আমার সঙ্গে ওসব গল্প করে।’
 মুনা জানে, পড়াশোনা-বিচ্ছিন্ন বাউণ্ডুলে বিজনকে মিহির পছন্দ করে না। কিন্তু মুনার এ জায়গাটাতেই হাত একেবারে দেয় না মিহির।
 আহ্লাদে কাত হয়ে যখন বিজনকে কথাটি বলেছিল, সে কী হাসি বিজনের, ‘তুই একটা বোকা। আমার ঘরটা মিহিরের কত কাজে আসে। আমাকে অপছন্দ করে তার সাধ্য কই ওর?’
 বিজনকে সেদিন ছোটলোক মনে হয়েছিল। মিহির বিজনকে ঠিক পছন্দ না করলেও মুনার শৈশবের বন্ধু বলে তাকে খানিকটা পাত্তা দেয়, এটা মুনা বোঝে।
 নিউইয়র্কে পড়াশোনা করা বিজনের প্রেমিকার সঙ্গে মুনার দুর্দান্ত বন্ধুত্ব। বাংলা ভালো বলতে পারে না মেয়েটি। কিন্তু কই, তার সম্পর্কে তো মুনা কোনো দিন নেতিবাচক কিছু বলে না। মিহিরকে কেন অপছন্দ বিজনের?
 ‘ও তোকে ডমিনেট করে, তোর নিজস্ব সত্তা বিলীন হয়ে যাচ্ছে।’ বিজন বলে, ‘আশ্চর্য! এটা তুই বুঝতেই পারিস না।’
 তীব্র মহুয়ার ঘ্রাণে আচ্ছন্ন যেন এক ভুতুড়ে ছায়াচ্ছন্নতায় পাক খায় মুনা। কিছুতেই বুঝতে পারে না, মিহির তাকে সমৃদ্ধ করছে, এটা কেন বোঝে না বিজন?
 ‘ও নিজে জঙ্গুলে তো…।’ মনে মনে উত্তর খুঁজে পেয়ে হাঁফ ছাড়ে মুনা।
 হামাগুড়ি দিয়ে অনন্ত নামছে।
 বৃষ্টি থেমে গেছে অনেকক্ষণ। ঘরের মধ্যে যেন-বা ভর করেছে বন্য নৈঃশব্দ্য। আজ রাতের ফ্লাইটে নিউইয়র্ক ওর প্রেমিকার কাছে চলে যাবে বিজন। কাল তার বিয়েতেও থাকতে পারবে না। মুনা তাই নড়তে পারছে না। আবার এ নিয়ে কেউ কোনো কথাও বলছে না।
 বর্ষার বিষণ্নতা গিলে মুনা বলে, ‘একটা ছবি ছাড় দেখি।’ বিজন আচমকা ঘুরে দাঁড়ায়। এরপর মুখর হয়ে বলে, ‘নিশ্চুপতা কি আমাদের দুজনকে মানায়?’
 আবারও নৈঃশব্দ্য। কার্পেটের ওপর বসে নানান রকম ম্যাগাজিন দেখছে বিজন। পাশে ওর ডায়েরিও, ডায়েরিটি যেন ঝরাপাতা।
 ‘আমার কী ইচ্ছা করে জানিস?’, কার্পেটে পা ছড়িয়ে ম্যাগাজিন থেকে ছবি কাটতে কাটতে বিজন বলে, ‘একটা ছবি বানাই। কেন্দ্রীয় চরিত্র হলো ছায়া ছেঁকে ধরা তোর চোখ। দেহটা ছায়ার কাছে দিয়ে। আলো-ছায়ার ফোকাস ফেলব তোর চোখে। কী দুর্দান্ত হবে ভেবে দেখ তো। পুরো স্ক্রিনে ভেসে উঠবে শুধু দুটি চোখ। একসময় তা বাতাসে কাঁপতে শুরু করবে। কাঁপতে কাঁপতে বিষপিঁপড়ে হয়ে বাতাসে মিলিয়েও যাবে।’
 হাসতে থাকে মুনা, ‘না, এ নিছক কাব্য হয়ে গেল।’
 বিজন সিরিয়াস, ‘এটাকে আমি কবিতা হতে দেব না। যেই-না চোখ যুগল বাতাসে উড়েছে, অমনি এক চক্কর খেয়ে দুটি বিষপিঁপড়া একটি নেকড়েতে পরিণত হলো। যার দুই মাথা, এক লেজ। নেকড়ে তো বাতাসে উড়তে পারে না। কী হবে?’
 ‘ওদের ডানা পরিয়ে দে।’
 ‘না না, ডানা নয়, ধর ধারালো এক অস্ত্র দিয়ে নেকড়েটার মুণ্ডু বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। তারপর…।’
 ‘এক থাপড় দেব।’
 গাল পেতে রাখা বিজন বলে, ‘জানি তুই হরর গল্প পছন্দ করিস না, তা এতক্ষণ শুনে গেলি কেন? চলে যাব এ জন্য?’
 ঘোর ছায়ায় বেদনার মর্মস্বরের মধ্য দিয়ে এতক্ষণ বিদায়ধ্বনি প্রকট হলো।
 ‘আজ আমাদের কাবিন…।’ কম্পিত স্বরে মুনা বলে, ‘দু-ঘণ্টা আগেই যেটা হওয়ার কথা। আমি ফোনের রিঙ্গার অফ করে তোর কাছে এসে বসে আছি।’
 ‘বলিস কী?’ লাফিয়ে ওঠে বিজন, ‘তুই এত কথা শেয়ার করিস, এটা আমাকে বললি না? চল চল, তোকে দিয়ে আসি।’
 ভেতরের নোনাজল গিলে খায় বুভুক্ষু আত্মা। সন্ধ্যার প্রগাঢ় বর্ষা-তিরোহিত কক্ষে অদ্ভুত এক ভৈরব ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করে। পুরো জীবনটাই উল্টে মাটিসহ আসমানে গিয়ে ঠেকে।
 যে বিজনকে স্পর্শ করলে ডাল-ভাত অনুভূতি হতো, আচমকা তাকেই আমূল আঁকড়ে মুনা অনুভব করে রোমাঞ্চ—জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে গা। প্রবল আকুলতায় ওর কাঁধে মাথা রেখে অস্ফুট স্বরে কাঁদতে থাকে মুনা, ‘আমি স্বর্গের হুরপরি, তুই আমার যোগ্য না, এই লিখেছিস ডায়েরিতে? আমি সব পড়েছি, সব জানি, কেবল নিজের আত্মার শব্দই এত দিন শুনতে পাইনি। তুই তোর মতো জঙ্গুলে বুনোই থাক। আমি তোকে বদলাতে চাই না। মিহির, চৌকস…এই বাহুল্য…এইসব আমার না, এর মধ্যে আমি আর তলিয়ে যেতে চাই না। আমার শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসে—যা বুনো, যা জঙ্গুলে—তা একান্ত আমার। আমি একমাত্র এখানেই নিশ্বাস নিতে চাই…তোকে আমি কোত্থাও যেতে দেব না…।
 প্রগাঢ় রাত্রি নেমেছে ভূমণ্ডলে। দুটি দীর্ঘ অচেনা দীর্ঘশ্বাস আমূল এক হয়ে একটি কক্ষে ছায়ার মতো নৃত্য করতে থাকে।
 
 

















