ধ্বংসের মুখে জেলে সম্প্রদায়
বাংলাদেশের সুন্দরবন অঞ্চলের আশেপাশে যেসব জেলেদের বাস, তারা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে অদ্ভুত এক কায়দায় মাছ ধরতে অভ্যস্ত। আর তা হলো ভোঁদড়ের সাহায্যে মাছ ধরা। কিন্তু সেই দিন আর নেই। সুন্দরবনে মাছের সংখ্যা যেমন দ্রুত হারে কমছে, তেমনি কমছে ভোঁদড়ের সংখ্যা।
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলেরা অদ্ভুত এক কায়দায় ভোঁদড়ের সাহায্যে মাছ ধরেন। মাছ ধরার এই পদ্ধতি চলে আসছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে। বিষয়টা এমন নয় যে ভোঁদড়রা মুখে করে মাছ নিয়ে জেলেদের দিত। পদ্ধতিটা হলো, ভোঁদড়দের এমনভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া, যাতে তারা মাছকে ডাঙার কাছে বা মাছ ধরার জালের অদূরে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। আর তার ফলে বিপুল সংখ্যক মাছ ধরা পড়ে জালে।
৫০ বছর বয়সী শশধর বিশ্বাসের বাস সুন্দরবনে। তার পরিবারের প্রত্যেকেই ভোঁদড়দের প্রশিক্ষণ দেয়ায় বেশ দক্ষ। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে তারা এই কাজটি করে এসেছেন। শশধর জানান, ‘এই ভোঁদরদের ওপরই তাদের জীবিকা নির্ভর করে।’
শশধরের ছেলে বিপুল জানান, ‘গাছের গুড়ির আশেপাশে প্রচুর মাছ থাকে। ভোঁদড়গুলো ওই মাছগুলোকে ধাওয়া করে। ফলে মাছগুলো জালে আটকা পড়ে। এদের ছাড়া মাছ ধরতে গেলে এতো বিপুল সংখ্যক মাছ ধরা কখনই সম্ভব না।’এই মাছ ধরার কাজটা সাধারণত করা হয় রাতে।
শশধর জানান, কোনো কোনো দিন রাতে এই ভোঁদড়দের সাহায্যেই ১২ কেজি ওজনের মাছ, গলদা চিংড়ি এবং কাকড়া ধরেছেন তিনি। স্থানীয় বাজারে এ সব মাছ বিক্রি করে প্রতি মাসে এই পরিবার প্রায় ২০ হাজার টাকা আয় করেছে। কিন্তু সম্প্রতি কয়েক বছরে এমন বড় বড় মাছ আর ধরা পড়ে না, এমনকি কখনো কখনো জাল শূন্যই থেকে যায় বলে জানান শশধর-পুত্র বিপুল।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মোস্তফা ফিরোজ জানান, গত কয়েক বছরে মাছের প্রজনন ও বংশবৃদ্ধি ভয়াবহভাবে কমে গেছে। তিনি সংবাদ সংস্থা এএফপিকে বলেন, নদীর পানি দূষণ, ধানের জমিতে কীটনাশক ব্যবহার এবং বেশি পরিমাণে মাছ ধরার ফলে মাছের প্রজনন একেবারেই হচ্ছে না।
গত ২৫ বছর ধরে বাংলাদেশের ভোঁদড় দিয়ে মাছ ধরার বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করছেন মোস্তফা ফিরোজ। তিনি জানান, এই ২৫ বছরে জেলে পরিবারের সংখ্যা ৫০০ থেকে কমে ১৫০ এ নেমে এসেছে। ৫০ বছর আগে থেকে লক্ষ্য করলে হয়ত দেখা যাবে যে, এই জীবিকা কমেছে ৯০ ভাগ। তাই তার আশঙ্কা, এভাবে চলতে থাকলে আগামী দুই দশকে মাছ ধরার জীবিকাটাই আর থাকবে না।
শশধরের ছেলে বিপুল (২০) আরো বলেন, ‘যদি কোনো মাছই না থাকে, তবে ভোঁদড় দিয়ে এই মাছ ধরার পদ্ধতির কোনো মানে হয় না। আমার পরিবারের বর্তমান অবস্থার দিতে তাকিয়ে দেখুন। আমার ভাই-বোন সবাই পড়ালেখা করতে চায়। তারা মোটেই পানিতে গিয়ে মাছ ধরতে আগ্রহী নয়। তারা যদি পড়ালেখায় উন্নতি করে, তবে একটা সময় তারা এই গ্রাম থেকে শহরে গিয়ে ভালো চাকরি খুঁজবে।’
বিপুল আরো জানান, প্রতি মাসে তার উপার্জনের প্রায় অর্ধেকটা চলে যায় পাঁচটি ভোঁদড়কে খাওয়াতে। ভাবনার বিষয় হলো, কেবল যে বাংলাদেশ থেকে জেলে সম্প্রদায় বিলুপ্ত হতে চলেছে, তা নয়। ওয়াল্ডলাইফ বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এই ভোঁদড়রাও এখন হুমকির মুখে। ছোট লোমের এই ভোঁদড়গুলো ক্রমেই যে বিলুপ্ত হতে চলেছে!