পানিবন্দি লাখো মানুষ বান্দরবান বিচ্ছিন্ন
২৮ জুলাই ২০১৫, মঙ্গলবার
অবিরাম বর্ষণ আর পাহাড়ি ঢলে জেলায় জেলায় দেখা দিয়েছে বন্যা। কোথাও বাড়িঘর তলিয়ে গেছে। কোথাওবা সড়ক মহাসড়ক পানির নিচে। ফলে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে ওই সব এলাকা। দুর্ভোগ চরমে। বান্দরবান জেলা গত দু’দিন ধরে রয়েছে গোটা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন। কক্সবাজার শহর, উখিয়া, টেকনাফ এখন বানের পানিতে ভাসছে। বানভাসি মানুষ আশ্রয় নিয়েছে উঁচুস্থানে। অব্যাহত বর্ষণে নদ-নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে নদীর কূল বেয়ে, বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে ছড়িয়ে পড়েছে পানি। অসংখ্য স্কুলে পানি প্রবেশ করায় শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।
ফেনী প্রতিনিধি জানান, মুহুরী ও ছোট ফেনী নদীর পানি বিপদসীমার ১০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফেনী সদর ও দাগনভূঞায় নতুন করে অর্ধশতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েছে এসব গ্রামের বাসিন্দারা। ফেনীর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রমজান আলি প্রামানিক জানান, ভারি বর্ষণ ও ভারতীয় পাহাড়ি ঢলে মুহুরী নদীর পানি বিপদসীমার ১০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ৫টি স্থানে বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় নতুন করে আরও পাঁচটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এদিকে ছোট ফেনী নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় ফেনী সদর উপজেলা ও দাগনভূঞা উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
দাগনভূঞা উপজেলার ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী কর্মকর্তা জামশেদ খোন্দকার জানান, সিন্দুরপুর ইউনিয়নের ১০টি ও রাজাপুর ইউনিয়নের ১০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বন্যার পানিতে উপজেলার পূর্বচন্দ্রপুর, রামনগর, মাতুভূঞা, ইয়াকুব পুর, জায়লস্করসহ অন্তত ২০ গ্রামে পানি প্রবেশ করেছে। বন্যায় এসব গ্রামের নিচু ঘরবাড়ি ডুবে গেছে। উপজেলার ৮টি স্কুলে বন্যার পানি ঢুকে পড়ায় শিক্ষাকার্যক্রম বিঘ্নিত হচ্ছে। পাঁচশতাধিক মাছের ঘের ভেসে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মৎস চাষিরা। বিস্তীর্ণ জমিতে পানি জমে যাওয়া বোরো ধানের চারা ডুবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষক।
ফেনী সদরের পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মানিক জানান, পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের নুনের গোলা, ডুমুর গাঁও, বিরুলি, আবুপুর গ্রামে পানি বন্দি হয়ে দিন কাটাচ্ছে হাজারো পরিবার।
ফুলগাজী সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবুল হোসেন জানান, মুহুরী নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় নতুন করে পাঁচটি গ্রাম প্লাবিত হওয়ায় আজ ৪শত পরিবারের মাঝে ১০ কেজি করে চাল বিতরণ করা হবে।
এদিকে টানা বর্ষণে তৃতীয় দিনের মতো পানিবন্দি রয়েছে ফেনী শহরবাসী। শহরের প্রধান সড়ক শহীদ শহীদুল্লাহ কায়সার সড়ক ও একাডেমি সড়কে হাঁটুপানি থাকায় যান চলাচলে সমস্যা হচ্ছে। এ ছাড়া এসব সড়ক সংলগ্ন ডাক্তার হায়দার ক্লিনিক সড়ক, রামপুর ভূঞা বাড়ি সড়ক, কলাবাগান, শান্তি কোম্পানি সড়ক, ডাক্তারপাড়া, বারাহীপুর, খাজুরিয়া, মধুপুর, কমার্স কলেজ সড়কসহ শহরের বিভিন্ন সড়ক প্লাবিত হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কুমিল্লা অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী মোসাদ্দেক হোসেন জানান, পানি না কমা পর্যন্ত ফুলগাজীতে বাঁধের ভেঙে যাওয়া স্থানে মেরামত করা সম্ভব নয়। মুহুরী ও কহুয়া নদীর ঝুঁকিপূর্ণ আরও কয়েকটি অংশে বাঁধের ভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড নিরলস চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানান তিনি।
আমতলী (বরগুনা) প্রতিনিধি জানান, সমুদ্রে প্রচুর ইলিশ ধরা পরলেও বৈরী আবহাওয়া ও পায়রা সমুদ্রবন্দরসহ উত্তর বঙ্গোপসাগরে ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত বহালের কারণে মাছ শিকার করতে পারছে না জেলেরা। ফকিরহাট কুয়াকাটাসহ উপকূলীয় এলাকার মাছ ধরা ট্রলারগুলো তীরে ফিরে এসেছে। রোববার থেকে সোমবার সকাল পর্যন্ত হাজার হাজার ট্রলার মৎস্যবন্দর আলীপুর-মহিপুরের শিববাড়িয়া নদীতে আশ্রয় নিয়েছে। যেসব মাছ ধরার ট্রলারের জেলেরা বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করে ঝুঁকি নিয়ে ইলিশ সন্ধানে সমুদ্রে রয়েছে তাদের স্বজনরা চিন্তিত হয়ে পড়েছে। ভাণ্ডারিয়া থানার তুষখালী এলাকার এফবি রাকিব ট্রলারের জেলে সোহেল জানান, গতকাল সকালে পাথরঘাটা মোহনা থেকে সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে বৈরী আবহাওার কারণে বিকালে মৎস্য বন্দর আলীপুরে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছে। এতে তাদের ট্রলারে বরফ, চাল ও জ্বালানিসহ প্রায় ৪০ হাজার টাকা লোকসান হয়েছে। বরগুনার বড়ইতলা এলাকার জেলে সোবহান বলেন, সাগরে প্রচুর মাছ আছে কিন্তু সাগর উত্তাল থাকায় তীরে ফিরে আসতে হয়েছে। কলাপাড়া উপজেলা মাঝি সমিতির সভাপতি নুরু মাঝি বলেন, এখনও গভীর সমুদ্রে প্রচুর মাছ ধরার ট্রলার রয়েছে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চলছে যা গতকাল রাতে বা আজ উপকূলে ফিরতে সক্ষম হবে। অপর দিকে গত ১০ বছরে এত মাছ ধরার ট্রলার আলীপুর মহিপুর মৎস্যবন্দরে এসে আশ্রয় নিতে কেউ দেখে নি। বৈরী আবহাওয়ার কারণে হাজার হাজার ট্রলার বন্দরে এসে নোঙর নেওয়ায় শিববাড়িয়া নদীর এক মোহনা থেকে শুরু করে অপর মোহনা পর্যন্ত পুরো নদীই ট্রলারে ভরে যায়।
স্টাফ রিপোর্টার, মুন্সীগঞ্জ থেকে জানান, বৈরী আবহাওয়ায় উত্তাল পদ্মায় বড় বড় ঢেউ ও প্রচণ্ড স্রোতের কারণে রাত ৮টায় রো রো ফেরিসহ সব কয়টি ফেরি চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। অবশ্য গতকাল সকাল ৭টা থেকে পুনরায় ফেরি চলাচল স্বাভাবিক হয়েছে। আবহাওয়া স্বাভাবিক না হলে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম শিমুলিয়া-কাওড়াকান্দির এ নৌরুটে ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন কর্তৃপক্ষ। এদিকে, ঘণ্টা দুয়েক চলার পর গতকাল বেলা ১১টার দিকে ফের বন্ধ করে দিতে হয়েছে ওই রুটের সব কয়টি লঞ্চ।
বিআইডব্লিউটিসির শিমুলিয়া (মাওয়া) কার্যালয়ের ব্যবস্থাপক মো. গিয়াসউদ্দিন পাটোয়ারী জানান, বৈরী আবহাওয়ার পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পর ফেরি চলাচল শুরু হয়েছে। কিন্তু বৈরী আবহাওয়া উন্নীত না হলে আবারও ফেরি চলাচল বন্ধ রাখার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বিআইডব্লিউটিসির মাওয়া কার্যালয়ের সহকারী ব্যবস্থাপক চন্দ্র শেখর রায় জানান, বৈরী আবহাওয়ায় উত্তাল পদ্মায় বড় বড় ঢেউ, প্রচণ্ড স্রোত ও চ্যানেলে ডুবোচর থাকায় রোববার রাতে সব কয়টি ফেরি চলাচল বন্ধ রেখে নোঙরে রাখা হয়েছিল। গতকাল দিনভর মাঝে মাঝে নোঙরে রেখে ফেরি চলাচল স্বাভাবিক রাখা হয়।
মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, বৈরী আবহাওয়ার কারণে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে লঞ্চ চলাচল আবারও বন্ধ রয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় বিআইডব্লিউটিএ এই নির্দেশ দিয়েছে। এর আগে রোববার বিকাল ৫টা থেকে গতকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত টানা ১৫ ঘণ্টা পর্যন্ত লঞ্চ চলাচল বন্ধ ছিল। তবে ফেরি চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে।
বিআইডব্লিউটিএ আরিচা কার্যালয়ের সহকারী পোর্ট অফিসার সাজ্জাদুর রহমান জানান, গতকাল দুপুর থেকে বৈরী আবহাওয়ার কারণে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটের পদ্মা নদীতে প্রচণ্ড বাতাস ও ঢেউয়ের সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে এ রুটে লঞ্চ চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় দুপুর একটা থেকে বন্ধ রাখা হয়েছে। এ ছাড়া দুর্ঘটনার আশঙ্কায় কর্তৃপক্ষের নির্দেষে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটের পাশাপাশি আরিচা-কাজিরহাট নৗরুটেও লঞ্চ চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে।
স্টাফ রিপোর্টার, খুলনা থেকে জানান, টানা বৃষ্টি ও জোয়ারের প্রবল স্রোতে কপোতাক্ষের বাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। তলিয়ে গেছে বিল ডাকাতিয়াসহ ফুলতলার নিম্ন অঞ্চল। বিল ডাকাতিয়ার নিম্ন অঞ্চলে অনেক মাছের ঘের ডুবে গেছে। ফুলতলার রাস্তাঘাট ও জমির বীজ তলার প্রচুর ক্ষতি হয়েছে। পাইকগাছা উপজেলার হরিঢালী ইউনিয়নের নোয়াকাটি মালোপাড়ায় কপোতাক্ষের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙ্গে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এতে কাঁচা বাড়িঘর ধসে পড়েছে। ঘরের আসবাবপত্রসহ মূল্যবান জিনিসপত্র নষ্ট হয়ে ২০ লক্ষাধিক টাকার ক্ষতি হয়েছে। ভেঙ্গে পড়েছে পয়ঃনিষ্কাশন ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা। রোববার থেকে স্থানীয় গ্রামবাসী স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে বেড়িবাঁধ দেয়ার চেষ্টা চালায়।
এলাকাবাসী জানায়, উপজেলার হরিটালী ইউনিয়নের নোয়াকাটি গ্রাম সংলগ্ন কপোতাক্ষ নদের বেড়িবাঁধ ভেঙে পানি ঢুকে পড়েছে নোয়াকাটি, হরিদাসকাটি, হরিঢালী, উলুডাঙ্গা, রহিমপুরসহ কয়েকটি গ্রামে। স্থানীয়রা জানান, গত শনিবার ভোর রাতে নোয়াকাটি মালোপাড়া সংলগ্ন কপোতাক্ষ নদের বেড়িবাঁধ ভেঙে পানি ঢুকতে থাকে। বাঁধভাঙা পানিতে তলিয়ে যায় গোটা এলাকা। ভেসে যায় এলাকার পুকুর ও মাছের ঘের। ফলে এলাকার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে ও কাঁচা বাড়িঘর ধসে পড়ে। ভাঙন মেরামতে গত দুই দিনে প্রায় দুই শতাধিক গ্রামবাসী বেড়িবাঁধ দেয়ার চেষ্টা করে। তবে বাঁধ মেরামত সম্ভব হয়নি।
এদিকে ফুলতলা উপজেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, বিলডাকাতিয়াসহ অন্যান্য এলাকায় মোট ১০ হাজার ৬শ ৪৮টি চিংড়ি ও সাদা মাছের ঘের রয়েছে। এর মধ্যে শুধু চিংড়ির ঘের ৮ হাজার ২১১টি। এতে ২৯শ ২৩ হেক্টর জমি ঘেরের আওতায় রয়েছে। এলাকার অনেকেই জানান, চিংড়ি ঘেরের ৩০ভাগ প্লাবিত হয়েছে।
উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা এটি এন তৌফিক মাহমুদ জানান, এই মুহূর্তে কোন মাছের ঘের ভেসে যাওয়ার খবর তার কাছে নাই। অপরদিকে মৎস্য ঘের মালিক সমিতির সভাপতি মোশারফ হোসেন মোড়ল জানান, বসুরাবাদ, পটিয়াবান্দা ও ভুলোপোতা গ্রামের অনেক ঘের অতি বৃষ্টির কারণে ভেসে গেছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রিনা খাতুন জানান, অতিবৃষ্টিতে উপজেলার আমন, আউশ ও সবজি বীজ তলার অনেক ক্ষতি হয়েছে। আমন বীজ তলার আওয়াতায় ৪৫০ বিঘা জমির মধ্যে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৭০ বিঘা। ২৫০ বিঘার সবজি বীজ তলার মধ্যে ক্ষতি হয়েছে ৭৫ বিঘা। আউশ এর ক্ষতি হয়েছে ২৫ বিঘা। তিনি আরও জানান অন্যান্য বীজতলাও প্লাবিত হয়েছে। বৃষ্টি আরও হলে আরও ক্ষতি হবে বলে জানা যায়। তবে এলাকার কৃষকরা জানান, বীজ তলার ক্ষতি আরও বেশি হয়েছে।
টেকনাফ (কক্সবাজার) প্রতিনিধি জানান, সীমান্ত জনপদ টেকনাফে চার দিনের টানা ভারিবর্ষণে জনজীবন ব্যাহত হয়ে পড়েছে। বৃষ্টি, বঙ্গোপসাগর ও নাফনদীর জোয়ারের পানিতে উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকার বসতবাড়ি, সড়ক, মৎস্যঘের ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ডুবে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে উঠেছে। ঝড়ো হাওয়ার কবলে পড়ে সেন্টমার্টিন ও শামলাপুরে ৪টি ফিশিং বোট ডুবির ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় ১ জেলের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া টর্নেডোর আঘাতে প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনসহ উপজেলায় ৫০টি বসতবাড়ী লণ্ডভণ্ড ও শুধু শাহপরীর দ্বীপের ৪০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। জেলা ও স্থানীয় প্রশাসন জানমাল ও সম্পদ রক্ষায় জনসাধারণকে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার জন্য সতর্কতা জারি করেছে এবং ১৬টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ পরিবারকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিয়েছে। অপরদিকে ঝড়ো হাওয়ার কারণে গত ৪ দিন যাবৎ বিদ্যুৎবিহীন রয়েছে গোটা টেকনাফ উপজেলা। ফলে ফ্রিজে রক্ষিত মাছ-তরকারির পচন ধরেছে এবং গোটা উপজেলায় ভুতুড়ে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। শিগগিরই সরকারি উদ্যোগে পদক্ষেপ না নিলে রোগব্যাধির সংক্রমণসহ পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। উপজেলার উপকূলের বেড়িবাঁধ বিধ্বস্ত শাহপরীর দ্বীপ ও সাবরাং ইউনিয়নের মানবিক বিপর্যয় ও করুণ দশার সৃষ্টি হয়েছে। দেখা দিয়েছে খাদ্য ও নিরাপদ সুপেয় পানির সংকট।
এদিকে সদর ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ড ডেইলপাড়ায় অসাধ্য ব্যক্তিরা একটি সরকারি কালভার্ট ও ড্রেন বন্ধ করে দেওয়াল নির্মাণ করায় ২শতাধিক পরিবারের পুরো গ্রাম পানিবন্দি হয়ে পড়েছে বলে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেন। এ ছাড়া সদর ইউনিয়নের পূর্ব গোদারবিল, হাবিরছড়া, মিঠাপানির ছড়ায় প্রবল ঝড়ো হাওয়া এবং পাহাড়ি ঢলে গ্রামীণ জনপদের ব্যাপক ক্ষতি হয়।
বাহারছড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মৌ. হাবিব উল্লাহ জানান, প্রচারণা চালিয়ে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারীদের নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া গত ২৫শে জুলাই বঙ্গোপসাগরে ঝড়ো হাওয়ার কবলে পড়ে নুরুল হকের মালিকানাধীন একটি ফিশিং ট্রলার ডুবির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় আবদুল মজিদ নামে এক জেলের মৃত্যু হয়েছে। দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের ৯নং দক্ষিণ পাড়ায় টর্নেডোর আঘাতে ৩০টি বাড়ি লণ্ডভণ্ড হয়েছে। আমির হামজা, নুর মোহাম্মদ ও সৈয়দ আলমের মালিকানাধীন ৩টি ফিশিং বোটের ডুবির ঘটনা ঘটেছে। এঘটনায় কেউ হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। সেন্টমার্টিনের প্যানেল চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান জানান, টেকনাফ- সেন্টমার্টিনের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় খাদ্য দ্রব্যের দাম বেড়ে গেছে। এ পর্যন্ত সরকারিভাবে কোন প্রকার সাহায্য বা ত্রাণ পৌঁছেনি। দ্বীপবাসী আতঙ্গে দিনাতিপাত করছে। এ ছাড়া হ্নীলা রঙ্গিখালী মঈন উদ্দিন মেমোরিয়াল সংলগ্ন প্রধান সড়ক ডুবে যাওয়া, পূর্ব পানখালীর কালভার্ট ভেঙ্গে যাওয়া এবং হোয়াব্রাংয়ের কালভার্ট ধসে যাওয়ায় যানবাহন ও জনসাধারণের চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। স্থানীয়ভাবে ধারণা করা হচ্ছে পুরো উপজেলায় কোটি কোটি টাকার গ্রামীণ জনপদ, ব্রিজ-কালভার্ট, মৎস্যঘের, বসতবাড়ির ক্ষতি সাধিত হয়েছে। এদিকে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী অফিসার শাহ মোজাহিদ উদ্দিন উপজেলায় মাইকিং করে ভূমি ধ্বস ও ভারি বৃষ্টিপাত হতে জানমাল রক্ষায় যথাযথ পদক্ষেপ নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। এই ধরনের দুর্যোগপূর্ণ পরিবেশ অব্যাহত থাকায় জনসাধারণের মধ্যে আতংক বিরাজ করছে।
আবহাওয়া দপ্তর ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাও টানা বৃষ্টিতে পাহাড় ধসের আশঙ্কা করছেন। ইতিমধ্যে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইউএনও শাহ মোজাহিদ উদ্দিনের নির্দেশে শনিবার বিকালে উপজেলার ফকিরামোরা এলাকার পাহাড়ের অতি ঝুঁকিপূর্ণ বসতিতে থাকা ১৬টি পরিবারকে সরিয়ে নিয়েছে।
ইউএনও শাহ মোজাহিদ উদ্দিন বলেন, উপজেলা পরিষদ সংলগ্ন ফকিরামুরা, গিলাতলী, বৈদ্যেরঘোনা, নাজিরঘোনা, শিয়াইল্যারঘোনা, পল্লানপাড়া, নাইট্যংপাড়া, কেরুনতলী, বরুইতলী, জাহালিয়াপাড়া, রোজারঘোনা, রঙ্গিখালী, উলুচামারী, লেচুয়াপ্রাং, পানখালী, সিকদারপাড়া, রোজারঘোনা, মিনাবাজার, রক্ষ্যইম, আমতলীসহ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে ওঠা ঝুঁকিপূর্ণ বসতি থেকে বাসিন্দাদের সরে যেতে মাইকিং করা হয়েছে। যারা সরে যাবে না তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানান।
রাউজান (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি জানান, অবিরাম বর্ষণে চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকার মত রাউজানের জনজীবনে চরম বিপর্যয় নেমে এসেছে। পাহাড়ি ঢল আর জোয়ারের পানিতে বিল-ঝিল, রাস্তাঘাট ডুবে বন্যার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। ১৪টি ইউনিয়ন ও একটি পৌর এলাকার হাজার হাজার মানুষ পানি বন্দি হয়ে পড়েছে। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা, বৈদ্যুতিক সংযোগ। বন্ধ রয়েছে দোকানপাট, মিলছে না হাটবাজার, থমকে আছে ব্যবসা বাণিজ্য। ভেঙ্গে পড়েছে ঘরবাড়ি, ডুবে গেছে মৎস খামার, ভেসে গেল লক্ষ লক্ষ টাকার মাছ। তাই মৎস চাষিদের মাথায় পড়েছে বাজ।
ঈদের দিন থেকে থেমে থেমে বৃষ্টি পড়লেও গত বৃহস্পতিবার থেকে টানা বর্ষণে রাউজানের নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি সড়কের রাউজান জলিল নগর, মুন্সিরঘাটা, বেরুলিয়া, ধায়েরঘাটা ও পৌরসভা এলাকার থানা রোড হাঁটু থেকে কোমর পানিতে তলিয়ে গেছে। সড়ক পথে যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। পৌর সদরের শাহনগর, ছত্তর পাড়া, উপজেলার ডাবুয়া, চিকদাইর, রাউজান কদলপুর, পূর্বগুজরা, পশ্চিম গুজরা ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের রাস্তাঘাট ডুবে গেছে। নোয়াপাড়া-রাউজান সড়ক ও পাহাড়তলী হাফেজ বজলুর রহমান সড়কে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে।
সিএনজি অটোরিকশা চালক কামরুল জানান, গত দুই দিন মালিকের ভাড়াটাও আয় করতে পারি নি। রাস্তায় মানুষের তেমন চলাচল নেই। তাছাড়া রাস্তার মাঝে মাঝে হাঁটু সমান পানি থাকায় গাড়ি বন্ধ হয়ে যায়। এভাবে আরও কয়েকদিন বৃষ্টি পড়তে থাকলে পরিবারে খাবার জোগাড় করতে অনেক কষ্ট হবে।
রাউজানের রাস্তার ধারে বিভিন্ন হাটবাজার, দোকানপাট ও জংশনে পানি নিষ্কাশনের জন্য যে সকল নালা রয়েছে সেগুলো দোকানপাট ও বাজারের আবর্জনায় ভরে থাকার ফলে রাস্তায় পানি জমে কর্দমাক্ত হয়ে উঠেছে। সে সকল স্থানে পায়ে হেঁটে চলা খুবই কষ্টসাধ্য।
এদিকে রোববার সর্তা খালের প্রবল স্রোতে উত্তর হলদিয়া চাদ তেলির বাড়ি পাশে ১১ হাজার লাইনের পল্লী বিদ্যুতের খুঁটি ও তার পানিতে তলিয়ে গেছে। খুঁটিসহ তার পানিতে পড়ে যাওয়ায় সে এলাকার প্রায় ৩০০ পরিবার বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়েছে। চিকদাইরে অসংখ্য মাটির ঘরবাড়ি ভেঙে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
পৌরসদরের বাসিন্দা নুরুল আবছার জানিয়েছে সর্তা, ডাবুয়া কাশখালী ও রাউজান হয়ে তীব্র বেগে পাহাড়ি পানি নামতে থাকায় খালগুলোর বিভিন্ন অংশের পাড় ভেঙে অনেক গ্রামে পানি প্রবেশ করেছে। তীব্র বেগে ছুটে আসা খালে পানির চাপে এলাকার কাঁচা রাস্ত্তা ভেঙে গেছে। মাছ চাষের পুকুর ডুবে ভাসিয়ে গেছে মাছ।
লাকসাম (কুমিল্লা) প্রতিনিধি জানান, ডাকাতিয়া নদীর পানি বৃদ্ধির কারণে লাকসাম পৌরসভাসহ ৭টি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চাল প্লাবিত হয়েছে। উপজেলা প্রশাসনের উত্তরে রাস্তা তলিয়ে গেছে পানিতে। লাকসাম-নোয়াখালী সড়কে হাঁটু সমান পানি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গাড়ি চলাচল করছে। ভেসে গেছে হাজার হাজার পুকুরের মাছ ও মাছের ঘের। প্রায় ৫০ লাখ টাকার মাছ ভেসে গেছে। সর্বসান্ত্ব হয়ে পড়েছে মাছ চাষিরা।
লাকসাম পৌরসভার ড্রেনগুলো পরিষ্কার না করায় লাকসাম নোয়াখালী সড়ক জগন্নাথ দিঘীর দক্ষিণপাড় জলাবদ্ধতার কারণে রাস্তার উপরে পানি উঠেছে। অনেকের বাড়িঘরে পানি ঢুকার কারণে আশ্রয় নিয়েছি লাকসাম পাবলিক হলে।
চানগাঁও ফিশারি ব্যবসায়ী দেলোয়ার হোসেন জানান, দীর্ঘদিন থেকে আমি মাছ চাষ করে আসছি। আমার বেশ কয়েকটি পুকুর মাছের ঘের রয়েছে। হঠাৎ করে বৃষ্টি ও পানি বৃদ্ধির কারণে আমার সব মাছ ভেসে গেছে। শুধু ফিশারি ব্যবসায়ী দেলোয়ার নয় সব মাছ চাষি সর্বসান্ত্ব হয়ে পড়েছে। তাদের উৎপাদিত মাছের রেনু ও মাছ ভেসে গেছে।
গঙ্গাচড়া (রংপুর) প্রতিনিধি জানান, রংপুরের গঙ্গাচড়ায় কোলকোন্দ ইউনিয়নে তিস্তার বাঁধ ভেঙে দুই গ্রামের মানুষজন ১২ দিন ধরে পানিবন্দি হয়ে আছে। খাবার সমস্যাসহ মানবেতর জীবনযাপন করছে পানিবন্দি পরিবারগুলো। এ ছাড়া তিস্তার ভাঙনে ১০ পরিবারের ভিটে মাটি ছাড়া হয়েছে। ভাঙনের ১০ ফুট দূরে চিলাখাল চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রহর গুনছে কখন যে বিলীন হয়ে যায়।
গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুর, কাশিয়ানী, কোটালীপাড়া, টুঙ্গিপাড়া ও জেলা সদরের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পড়েছে। ঘর থেকে বের হতে না পারায় পানিবন্দি শত শত দিনমজুর এখন বেকার হয়ে পড়েছে। ফলে পরিবার পরিজন নিয়ে তারা এখন মানবেতর জিবনযাপন করছে। বিশেষ করে টুঙ্গিপাড়া উপজেলার অধিকাংশ নিম্নাঞ্চল প্লাবিত- ভেসে গেছে গোপালপুর ইউনিয়নের ১৪টি গ্রামের ৩শরও বেশি ঘেরের বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। তলিয়ে গেছে সোনাখালী ও বেলেডাঙ্গাসহ দুটি গ্রামের ১০০ শত ঘরবাড়ি ও বিভিন্ন সবজির ক্ষেত। ভেসে যাওয়ার পথে আরো শত শত ঘেরের মাছ।
স্থানীয় আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ আবু সুফিয়ান জানিয়েছেন-পরবর্তী ৭২ ঘণ্টা পর দেশে বৃষ্টির পরিমাণ কিছুটা কমলেও আবহাওয়া অনুকূলে আসতে বেশ সময় লাগবে। লঘুচাপটি বর্তমানে মংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৭৫ কিলোমিটার দূরে রয়েছে।
ভোলা প্রতিনিধি জানান, মেঘনার করাল গ্রাসে হুমকির মুখে ভোলা শহর। নদী ভাঙনে দিন দিন ছোট হয়ে যাচ্ছে ভোলার মানচিত্র। ভোলা সদরের ইলিশা ইউনিয়ন পয়েন্টে ২৪ ঘণ্টায় অন্তত ৩শ’ মিটার এলাকা ভেঙে গেছে। এতে বরিশাল-ভোলা-লক্ষ্মীপুর মহাসড়ক ভেঙ্গে যাওয়ায় ফেরি চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
গতকাল ভোর রাতে এ ভাঙন শুরু হয়। সকাল থেকেই ফেরি চলাচল বন্ধ থাকায় ভোলার সঙ্গে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ফলে উভয় পাড়ে গাড়ির তীব্র লাইন জটের সৃষ্টি হয়েছে। এতে দুর্ভোগে পড়েছেন পরিবহন শ্রমিক ও সাধারণ যাত্রীরা। এদিকে, উত্তাল মেঘনা গ্রাস করছে জনপদ, ভাঙছে রাস্তা, ফসলি জমি, দোকানসহ বিভিন্ন স্থাপনা। প্রবল জোয়ারে চাপে ইলিশা ঘাট এলাকায় সড়কের পুরো অংশ ভেঙে গেছে।
ফেরির ইনচার্জ আবু আলম জানান, বৈরী আবহাওয়ার কারণে রোববার দিনভর ভোলা-লক্ষ্মীপুর রুটে ফেরি চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। সোমবার ভোরের দিকে প্রবল জোয়ারের চাপে ইলিশা ঘাট এলাকায় সড়কে ভাঙনের ফলে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এতে সড়ক দিয়ে কোন যানবাহন চলাচল করতে পারছে না। যার ফলে ফেরি চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, ভাটার কারণে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করেনি, তবে জোয়ার এলেই পুরো এলাকা তলিয়ে যাবে।
স্থানীয় আইনজীবী মনিরুল ইসলাম জানান, বরিশাল ভোলা- লক্ষ্মীপুর মহাসড়কের হার্ড পয়েন্ট হলো ইলিশা চডার মাথা। এই চডার মাথা ভেঙ্গে গেলে ভোলার সঙ্গে ২১ জেলার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হবে। তার সঙ্গে সঙ্গে ভোলার দারোগার খালের উপর নির্মিত শত কোটি টাকা ব্যায়ে চার চারটি ব্রিজ ভেঙ্গে বিচ্ছিন্ন হবে ভোলার অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থাও।
ভোলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল হেকিম জানান, জোয়ারের চাপে সড়ক ভেঙে গেছে। আমরা ওই পয়েন্টে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা করছি।
কোম্পানীগঞ্জ (নোয়াখালী) প্রতিনিধি জানান, কোম্পানীগঞ্জে টানা বর্ষণে ও প্রবল জোয়ারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেঁড়ি বাঁধের ভাঙ্গা অংশ দিয়ে জোয়ারের পানি প্রবেশ করে উপকূলীয় অঞ্চলে ৫টি ইউনিয়ন প্লাবিত। রবি-সোমবার দিনে-রাতে টানা বর্ষণে বামনীয়া ও ছোট ফেনী নদীর প্রবল জোয়ারে ৫টি ইউনিয়নের ২৫০টি বসতবাড়ি, ৪০টি মৎস্য খামার, ৯০টি চলাচলের রাস্তা, চরপার্বতী ইউনিয়নের জনতা প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ৭/৮ফুট পানির নিচে তলিয়ে গিয়েছে। রোববার রাতে চরফকিরা ইউনিয়নের সিএনজি ড্রাইভার কামাল উদ্দিন (৩০) টানা বৃষ্টির মধ্যে সিএনজি নিয়ে চর এলাহীর ক্লোজার ঘাটে মাছ আনার জন্য যাওয়ার পথে রাস্তার পাশে থাকা গাছ পড়ে ঘটনাস্থলে নিহত হয়। সে চরফকিরা ইউনিয়নের ছায়দল হক মাঝির ছেলে বলে জানা যায়। চরএলাহীর চেয়ারম্যান ও চরফকিরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিন লিটন মৃত ব্যক্তির পরিবারকে আর্থিক সাহায্য প্রদান করেন। উপজেলা নির্বাহী অফিসার আশাফুর রহমান ৫টি ইউনিয়ন পরিদর্শন করে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে আর্থিক সাহায্য সহযোগিতা করার জন্য দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য জেলা প্রশাসককে অনুরোধ জানিয়েছেন বলে জানান। ইউনিয়নগুলো হলো- চরহাজারী, চরপার্বতী, চরএলাহী, মুছাপুর, চরফকিরা। এলাকাবাসী জানায়, চরএলাহী ইউনিয়নের চরলেংটা বিশ্ব বেড়িবাঁধের ভাঙ্গা অংশে ও চরপার্বতী ইউনিয়নের মৌলভীবাজার এলাকার বেড়িবাঁধের ভাঙন দিয়ে বৃহস্পতিবার রাতে টানা বর্ষণ ও বামনীয়া ও ছোট ফেনী নদীর প্রবল জোয়ারে ২৫০টি বসতবাড়ী, ৪০টি মৎস্য খামার, ৯০টি চলাচলের রাস্তা, ৫টি ইউনিয়নের জনতা প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ৭/৮ফুট পানির নিচে তলিয়ে গিয়েছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রতি বছর বর্ষা মওসুমে বেড়িবাঁধে মেরামত করার কাজ শুরু করে। কিন্তু এতে করে কোন সুফল পাওয়া যায় না। বেড়িবাঁধের মেরামতের কাজের জন্য টাকা বরাদ্দ হয়ে থাকে, একশ্রেণীর লোকের শুধু লুটপাটের জন্য। অধিক প্লাবিত এলাকাগুলো হলো- চরপার্বতীর ৯টি ওয়ার্ড, মুছাপুরের ৭, ৮, ৯নং ওয়ার্ড ও চরএনায়েত। চরএলাহীর চরযাত্রা, চরলেংটা, চরগাংচিল, চরওমেদ, চররমজান, চরমিজান, চরমওদুদ, চরএলাহী চেয়ারম্যান আবদুল মতিন তোতা, চরহাজারী চেয়ারম্যান হারুন-অর-রশিদ আল হারুন জানান, রবি-সোমবার রাতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে জোয়ারের পানি প্রবেশ করে বসতবাড়ি, মৎস্য খামার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, চলাচলের রাস্তা, মসজিদ, মক্তব সবকিছু পানির নিচে তলিয়ে গিয়েছে। ওদিকে, বসুরহাট পৌরসভায় পর্যাপ্ত পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকায় টানা বর্ষণে ৩নং ওয়ার্ড, ২নং ওয়ার্ড, ৫নং ওয়ার্ড, ৯নং ওয়ার্ডে ব্যাপক জলাবদ্ধতা দেখা দিয়ে দিয়েছে। পৌরবাসীর অভিযোগ রাস্তা ও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা বসুরহাট পৌরসভার দীর্ঘদিনের সমস্যা।
নন্দীগ্রাম (বগুড়া) প্রতিনিধি জানান, বগুড়ার নন্দীগ্রামে জলাবদ্ধতায় কৃষক জমিতে আমন ধানের চারা রোপণ করতে পারছে না। ফসলি জমি নিয়ে কৃষক চরম বিপাকে পড়েছে। বগুড়ার নন্দীগ্রাম উপজেলার কৃষকরা ধানের চাষাবাদের ওপর বেশি নির্ভরশীল। তাই বছরে ৩ বার ধানের চাষাবাদ করে। এবার আউশ মওসুমে আউশ ধানের চাষাবাদ হয়নি। এতে কৃষকরা অনেকটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, চলতি আমন মওসুমে ১৯ হাজার ৯৯৮ হেক্টর জমিতে আমন ধানের চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে প্রায় ৩ হাজার হেক্টর জমিতে আমন ধানের চারা রোপণ করা হয়েছে। গত শুক্র ও শনিবারের প্রচণ্ড বৃষ্টিপাতে নন্দীগ্রাম উপজেলার সব ফসলি জমি পানিতে তলিয়ে যায়। এতে জমিতে হালচাষ ও চারা রোপণ কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়েছে। যার কারণে আমন ধানের ফসলি জমি নিয়ে কৃষকরা এখন চরম বিপাকে রয়েছে। পানি না নামলে জমিতে হালচাষ ও চারা রোপণ করা সম্ভব হবে না। উপজেলার বিভিন্ন মাঠে খোঁজ খবর নিয়ে দেখা যায় ফসলি জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। কৃষকরা বলেছে, পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। উপজেলা কৃষি অফিসার মশিদুল হকের সঙ্গে কথা বললে তিনি বলেন, জলাবদ্ধতার কারণে কৃষকরা আমন ধানের চারা রোপণ করতে পারছে না। তবে পানি নেমে গেলেই চারা রোপণ কাজ পুরোদমে শুরু হবে।
সোনারগাঁ (নারায়ণগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, টানা বৃষ্টিতে সোনারগাঁ উপজেলার বাড়ি মজলিশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষে দুই ফুট পানি জমেছে। ফলে পানির মধ্যেই চরম ভোগান্তি সহ্য করে ক্লাস করতে হয় শিক্ষক শিক্ষার্থীদের। নিষ্কাশনের কোন ব্যবস্থা না থাকায় পানির মধ্যেই ক্লাস করছে শিক্ষক শিক্ষার্থীরা। পানির মধ্যে ক্লাস করে ইতিমধ্যে অসুস্থ হয়ে পরেছেন অনেক শিক্ষক শিক্ষার্থী। তাছাড়া ছাদের ফাটলের কারণে শিক্ষার্থীরা রয়েছে ঝুঁকির মধ্যে।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নার্গিস শামসুন্নাহার জানান, এ বিদ্যালয়ে বর্তমানে প্রায় ৭শ ছাত্রছাত্রী পড়াশুনা করছে। তাদের জন্য এমনিতেই পর্যাপ্ত শ্রেণীকক্ষ নেই তার উপর বৃষ্টির কারণে ৩টি শ্রেণী কক্ষ নিয়মিত পানিতে ডুবে আছে যার ফলে আমরা সুষ্ঠুভাবে ক্লাস করতে পারছি না।
এ ব্যাপারে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার আ ফ ম জাহিদ ইকবালের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি।
স্টাফ রিপোর্টার, কক্সবাজার থেকে জানান, কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের ডায়াবেটিক পয়েন্টে ঝড়ো হাওয়ার কবলে পড়ে ফিশিং ট্রলার ডুবে জুবাইদ (৩২) নামের এক জেলের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় ৫ জেলেকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। এদের মধ্যে শমসু মাঝি, এনায়েত উল্লাহ ও মো. হানিফ নামে তিনজনের পরিচয় জানা গেছে। এতে আরও ৯ জেলে নিখোঁজ রয়েছে। গতকাল সকালে ট্রলার ডুবির ঘটনাটি ঘটে। উদ্ধার জেলেদের জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এদিকে, চারদিনের প্রবল বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে কক্সবাজার জেলার ব্যাপক এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে তিন শতাধিক গ্রামের অন্তত ৫ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে আবার বন্যা দেখা দেয়ায় লোকজনের দুর্ভোগ চরমে উঠেছে। রোববার অতিবর্ষণে কক্সবাজার শহরে মারাত্মক জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। শহরের বাজার ঘাটায় অথৈ পানিতে লোকজনের সীমাহীন দুর্ভোগ হয়। এ ছাড়া কক্সবাজার সৈকতের গণপূর্ত আবাসিক এলাকা, পর্যটন এলাকাতেও এবার পানিতে অনেক ঘরবাড়ি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তলিয়ে গেছে। এলাকাবাসী জানান, কলাতলী পর্যন্ত প্রধান সড়কের পাশে নির্মিত নালাটি জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ। তারা জানায় আগে নালাটি প্রশস্ত ছিল। এখন এটিকে ছোট করে দুপাশে দেয়াল তুলে দিয়েছে। এতে পানি সহজে নালায় আসতে পারছে না।