৯ বছরে ১৯ হাজার কর্মী লাশ হয়ে ফিরেছে
ফরিদ উদ্দিন আহমেদ : তাদের বুক ভরা স্বপ্ন ছিল। তাই সহায়-সম্বল বেচে বা ধার-কর্জ করে গিয়েছিলেন বিদেশ। বিদেশে কঠোর পরিশ্রম করে অর্থ কামিয়ে সংসারের কষ্ট লাঘব করবেন। কিন্তু সে স্বপ্ন তাদের অপূর্ণই থেকেই গেল। তারা ফিরে এলেন লাশ হয়ে। গত ৯ বছরে প্রায় ১৯ হাজার কর্মী লাশ হয়ে স্বদেশে ফিরেছেন। বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ছয় প্রবাসী কর্মীর লাশ আসছে দেশে। সরকারি হিসাব মতে, গত আট মাসে বিমানবন্দর হয়ে ২০৪৫ কর্মীর মৃতদেহ দেশে এসেছে।
এদের বেশির ভাগই মারা গেছেন হার্ট অ্যাটাক অথবা দুর্ঘটনায়। হার্ট অ্যাটাকে কেউ মারা গেলে নিয়োগকারী সংস্থা থেকে কোনো ক্ষতিপূরণ পাওয়ার বিধান নেই। তবে কর্মরত অবস্থায় দুর্ঘটনায় মারা গেলে মৃতের উত্তরাধিকারীকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু আইনি জটিলতায় ওই টাকা পেতেও ব্যর্থ হচ্ছে বেশির ভাগ পরিবার।
মালয়েশিয়ায় মারা যাওয়া টাঙ্গাইলের মহেশ সরকারকে নিয়ে দেশব্যাপী আলোচনার ঝড় উঠেছিল। অসুস্থ হওয়ার পরও হাসপাতালে ভর্তি না করায় বিনা চিকিত্সায় মারা যান তিনি। এ নিয়ে সেখানে কর্মরত বাংলাদেশিরা আন্দোলনে পর্যন্ত নামেন। কিন্তু মহেশের বিধবা স্ত্রী ঝরনা সরকার ও দুই মেয়ে অনামিকা ও মিথিলা ক্ষতিপূরণের কানাকড়িও পাননি। এ পথে বাধার দেয়াল হচ্ছে আইনের জটিলতা। উত্তরাধিকার প্রমাণের জন্য আদালতে মামলা পর্যন্ত করেছেন তারা। তাতেও কাজ হয়নি। শুধু মহেশের পরিবারই নয়, ক্ষতিপূরণের টাকা পেতে শত শত অসহায় পরিবার প্রতিদিন জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) দ্বারে ধরনা দিচ্ছে।
বিএমইটি সূত্র মতে, এ বছরের জুলাই মাসে ২১৮টি লাশ এসেছে বিমানবন্দর হয়ে। এর মধ্যে ৮৬ জন হার্ট অ্যাটাক ও ৭৫ কর্মীর মৃত্যুর কারণ দেখানো হয়েছে দুর্ঘটনা। আগস্টে মৃতদেহ এসেছে ১৯৮টি। এখানেও হার্ট অ্যাটাক ও দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা বেশি। বিএমইটির পরিচালক কল্যাণ মোহসীন চৌধুরী বলেছেন, কর্মরত অবস্থায় কোনো কর্মী মারা গেলে ক্ষতিপূরণ পাওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে সেই দেশের আইনের ওপর নির্ভর করতে হয়। তবে একটু সময় লাগে। সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলে তিনি কার দোষে মারা গেলেন আইনে তা দেখে সেভাবে ক্ষতি নির্ধারণ করা হয়। আমাদের দেশ থেকে যেসব কর্মী বিদেশ যান, তাদের বয়স ২৫-৪০। ওখানে গিয়ে অনেকের আশা সঠিকভাবে পূরণ হয় না। তারা হতাশায় পড়ে যান। এ ছাড়া খাদ্যাভ্যাস, কাজের পরিবেশ এবং মানসিক চাপের কারণে অনেকেই হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। সব লাশ দেশে আসে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সব লাশ আসে না। সৌদি থেকে এক-তৃতীয়াংশ লাশ আসে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এসব মৃতের পরিবার আইনি জটিলতায় ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন না। সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর শ্রম আইনের জটিল নিয়মও ভোগান্তির আরেক অধ্যায় বলে জানিয়েছেন প্রবাসীরা। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আলোচনার মাধ্যমে এ জটিলতা ও ভোগান্তি কমানো সম্ভব বলে জানান প্রবাসী কর্মীরা।
বিএমইটি সূত্র জানায়, স্বাভাবিক ও হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু হলে নিয়োগকর্তার থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করা যায় না। কর্মরত অবস্থায় সংশ্লিষ্ট দেশের কোম্পানিতে ও সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলেই ক্ষতিপূরণ আদায় সম্ভব। তবে যেসব হতভাগা নিয়োগকর্তার কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ পান না, তাদের পরিবারকে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ তহবিল থেকে আর্থিক অনুদান দেয়া হয়। পক্ষান্তরে মেডিক্যাল রিপোর্টে বেশির ভাগ মৃত্যুর কারণ হার্ট অ্যাটাক দেখানোয় নিহতের আত্মীয়স্বজনের পক্ষে কোম্পানির কাছে ক্ষতিপূরণ পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
কেবল বহির্গমন ছাড়পত্রধারী কর্মী কর্মরত অবস্থায় মারা গেলে ক্ষতিপূরণ বা সহায়তা পেয়ে থাকেন। বহির্গমন ছাড়পত্র ছাড়াও যদি কেউ বৈধভাবে কাজ করেন এবং বাংলাদেশ দূতাবাস যদি তা স্বীকার করে, তবে সে ক্ষেত্রে কল্যাণ বোর্ডের সুপারিশ অনুযায়ী এ সুবিধা পাওয়া সম্ভব। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী ক্ষতিপূরণের টাকা পেতে সবার আগে নিহতের পরিবারকে উত্তরাধিকারের প্রমাণ দিতে হবে। প্রয়োজনে আদালতের মাধ্যমে উত্তরাধিকারের সমস্যা নিষ্পত্তি করে আসতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন জেলা জনশক্তি অফিসারের সম্মতিপত্র। ক্ষতিপূরণ হিসেবে যে টাকাটা দেয়া হবে, সেটা বিদেশে কাজ নিয়ে যাওয়ার আগে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ তহবিলে জমা রাখা কর্মীদেরই টাকা।
বিএমইটি সূত্রে জানা গেছে, ২০০৫ সালে ১২৪৮, ২০০৬ সালে ১৪০২, ২০০৭ সালে ১৬৭৩, ২০০৮ সালে ২০৯৮, ২০০৯ সালে ২৩১৫, ২০১০ সালে ২৫৬০, ২০১১ সালে ২৫৮৫, ২০১২ সালে ২৮৭৮ এবং এ বছরের আগস্ট পর্যন্ত বিদেশে মারা গেছেন ২০৫৪ কর্মী। সব মিলিয়ে নয় বছরে ১৮ হাজার ৮০২ কর্মী মারা গেছেন।
চলতি বছরে সৌদি আরব থেকে ৪২৬ লাশ, মালয়েশিয়া থেকে ২৬৪, কুয়েত থেকে ৯৩, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ২৪৬, বাহরাইন থেকে ৬৭, ভারত থেকে ৫৯, ওমান থেকে ১৩০, যক্তরাষ্ট্র থেকে ৮০, সিঙ্গাপুর থেকে ৪০, জর্ডান থেকে ১২, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ৫৫, কাতার থেকে ৩৪, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ছয়, লিবিয়া থেকে ১৬, যুক্তরাজ্য থেকে ১৩, ইতালি থেকে ৩৯, লেবানন থেকে ২২, গ্রিস থেকে পাঁচ, পাকিস্তান থেকে ১৮, চীন থেকে চার, জার্মানি থেকে পাঁচ, থাইল্যান্ড থেকে সাত, ফ্রান্স থেকে তিন, সুইডেন থেকে তিন, ব্রুনাই থেকে তিন, জাপান থেকে এক, মিসর থেকে তিন, অস্ট্রেলিয়া থেকে তিন, কানাডা থেকে ছয়, রাশিয়া থেকে এক, স্পেন থেকে এক, শ্রীলঙ্কা থেকে দুই, সুদান থেকে এক, মালদ্বীপ থেকে দুই, মরিশাস থেকে চার, ইরাক থেকে চার লাশসহ আট মাসে মোট ১৬৯২টি লাশ এসেছে। এগুলো হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে আসা লাশের হিসাব।
এছাড়াও চট্টগ্রাম শাহ্? আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে ২৮৩ ও সিলেট ওসমানী বিমানবন্দর দিয়ে আরও ৭০টি লাশ এসেছে। সব মিলিয়ে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত ২০৪৫টি লাশ এসেছে। কাগজপত্র সঠিক থাকা সাপেক্ষে লাশ পরিবহন ও দাফনের জন্য ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ তহবিল থেকে নিহতের পরিবারকে ৩৫ হাজার টাকা দেয়া হয় বিমানবন্দরে। এছাড়াও কল্যাণ বোর্ড থেকে পরবর্তীতে আরও তিন লাখ টাকা দেয়া হয় নিহতের পরিবারকে