৬৯ বছরে ৩৯ জন স্ত্রী নিয়েও সন্তুষ্ট নন!
হওয়ার কথাই ছিল। কারণ ৬৯ বছরের জাওনার মোট ৩৯ জন স্ত্রী। ৪১টি পুত্রসন্তান, ৪৬টি কন্যাসন্তান। এবং এখানেই দাঁড়ি, সেটাও ভেবে নেওয়ার কারণ নেই। পিতৃত্বে জাওনার এখনও অরুচি হয়নি, ফুরিয়ে যায়নি বিয়ে করার সুযোগও। স্ত্রীদের জন্য ডরমিটরি তৈরি করে দিয়েছেন। কমবয়সী স্ত্রীরা জাওনার ঘরের কাছাকাছি ডরমিটরিতে থাকেন। বয়স্ক বউদের ঠাঁই দূরের ডরমিটরিতে। বড় বউয়ের বয়স ৭৩। জাওনা মনে করেন, পারস্পরিক সহমত, শ্রদ্ধা ও ভালবাসা থাকলে এই ব্যবস্থায় কোনও সমস্যা নেই। প্রশ্ন করলে দার্শনিক ভাবে উত্তর দেন, সবই ঈশ্বরের ইচ্ছা। তিনি চাইলে আরও বিয়ে করতে হবে।
জাওনা ঈশ্বরের দিকে চেয়ে আছেন। আর গোটা সম্প্রদায় তাকিয়ে আছে জাওনার দিকে। তাদের কাছে, জাওনাই ঈশ্বর। সম্প্রদায়ের মুখপাত্র লালরিনথাঙ্গার কথায়, জাওনা ঈশ্বরের বরপুত্র। ঈশ্বর তাই ওর ওপর এত ভার দিয়ে পাঠিয়েছেন। আমরা জাওনার দেখানো পথে চলি।
সম্প্রদায়ে কোনও নতুন সন্তান জন্মালে জাওনাই নবজাতকের নামকরণ করেন। বাচ্চাকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করাও জাওনারই দায়িত্ব। তিনি যে গ্রামের গির্জারও প্রধান। লালরিনথাঙ্গাই জানালেন, গ্রামের অনেক মেয়ের বাবাই এখনও জাওনার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে আগ্রহী। লালরিনথাঙ্গার নিজের ছেলের সঙ্গে জাওনার এক মেয়ের বিয়ে হয়েছে। আবার তার মেয়ের সঙ্গে জাওনার ২৮তম ছেলের বিয়ে দিয়েছেন লালরিনথাঙ্গা। তিনি জানান, গোটা সম্প্রদায় বিশ্বাস করে, জাওনাই এক দিন পৃথিবীর শাসক হয়ে উঠবেন!
এই বিশ্বাসের জন্ম কী ভাবে হল? কাহিনীর সূত্রপাত জাওনার বাবার হাতে। জাওনার বাবা চালিয়ান পু চানা জাংডুম বাকটাওং গ্রামকে ঘিরে একটি নতুন সম্প্রদায়ের পত্তন করেছিলেন। সম্প্রদায়ের নাম দিয়েছিলেন ‘চানা পাওল’। সম্প্রদায়ের আয়তন বাড়াতে বহুবিবাহ তখন থেকেই ভরপুর চালু। সে ১৯৪২ সালের কথা। চালিয়ান নিজে সাতটি বিয়ে করেছিলেন। তার ১৪টি ছেলে ও ১৫টি মেয়ে হয়। বাবার মৃত্যুর পরে বড় ছেলে জাওনা সম্প্রদায়ের নেতৃত্বভার নিজের কাঁধে নেন। সকলে এখন তাকে ‘কাতা’ বা বাবা বলে। সম্প্রদায়ের সদস্যসংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫ হাজার। জাওনার গ্রামে ৩০০ পরিবারের বাস। বাকিরা আশপাশের বেশ কয়েকটি গ্রাম জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছেন। জাওনার বংশকেই তারা সর্বতোভাবে মান্য করেন।
জাওনার চারতলা অট্টালিকার নাম ‘ছুয়াং থার রান’, মানে ‘নব প্রজন্ম’। সংক্ষেপে বাড়ির মাথায় লেখা ‘সিটিআর’। জাওনার বাড়ির সব গাড়ির সামনেও ‘সিটিআর’ লেখা। মানুষ সসম্মানে আরোহীদের পথ ছেড়ে দেয়। বাড়ির সদস্যসংখ্যা? ২০৯! বাড়িতে ২২টি ঘর। একতলায় রান্নাঘর, খাওয়ার ঘর। দোতলায় জাওনার নিজের বিলাসবহুল ঘর। ৪৬ জন মেয়ের মধ্যে ২২ জন এখনও এই বাড়িতেই থাকেন। ১৩০ জন নাতি-নাতনির মধ্যে ৯৩ জন সিটিআরে রয়েছেন। আছেন ১৫ জন পুত্রবধূ। আছেন আশ্রিত আত্মীয়রাও। বাকি সন্তানসন্ততি, তাদের পরিবার, জাওনার ভাইবোনেরা সকলেই আশপাশে থাকেন। বড় ছেলে পারলিয়ানার বয়স এখন ৫০। তার এখনও পর্যন্ত দুই স্ত্রী ও ১৫টি সন্তান। জাওনা ছাড়া তারই একমাত্র নিজস্ব অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে। কারণ তিনিই জাওনার উত্তরসূরি।
বড় বউ, ৭৩ বছরের থিয়াংগি বাড়ির সকলের জন্য সাপ্তাহিক কাজের রুটিন ঠিক করেন। সকলে সেটা মেনেই কাজ করে। প্রতিবেলায় খাবার জন্য ৫০ কেজি চাল, ২০ কেজি ডাল, ২০ কেজি সব্জি লাগে। মাংস খেলে ৩৫ কেজি। এত মাংস জোগাড় করতে গেলে বহু শুয়োর মারতে হবে। তাই মাংস সচরাচর হয় না। ম্যাটাডর করে সিটিআর-এর বাজার আসে। প্রথমে বাচ্চারা খায়। পরে বড়রা। শেষে বউরা। প্রতিদিন রাতে খাওয়ার পরে জাওনার নামকীর্তনের সঙ্গে পরিবারের বাচ্চা ও মহিলারা নাচেন। সেটাই দিনের সেরা বিনোদন।
জাওনার অধিকাংশ সন্তান-সন্ততি পারিবারিক কাঠের ব্যবসায় যুক্ত। তিনটি আসবাব কারখানা থেকে আসা লাভের পুরো টাকা জাওনার কাছে দেওয়া হয়। সে টাকা প্রয়োজন অনুযায়ী ভাগ করেন। বউ-মেয়ে-নাতনিরা সব্জি খেতের পরিচর্যা করে, কাঠ সংগ্রহ করে। শুয়োরের খামারে শুয়োরদের যত্ন নেওয়াটাও বড় কাজ। রয়েছে পোলট্রিও।
বিকেলে পরিবারের ছোটদের ও গ্রামের কিশোর-কিশোরীদের ফুটবল-চর্চা চলে জাওনার হাতে গড়া ছুয়াং থার স্টার স্টেডিয়ামে। জাওনার নেতৃত্বে গ্রামবাসীরা ১৫ বছর ধরে হাতে হাতে পাহাড় কেটে স্টেডিয়াম তৈরি করেছেন। জলের রিজার্ভার বানিয়েছেন। জাওনার তৈরি ছুয়াংথার প্রাথমিক স্কুল ও হাইস্কুলেই গ্রামের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করে। গ্রামের মানুষদের অসুখের চিকিৎসাও জাওনাই করেন। জাওনাই নিয়ম করে দিয়েছেন, প্রতিদিন সম্প্রদায়ের সদস্যকে দু’ঘণ্টা রাস্তা তৈরির কাজে হাত লাগাতে হবে। গিনেস রেকর্ডে জাওনা বৃহত্তম পরিবারের কর্তা। চানা পাওলের কাছে তিনি সম্প্রদায়ের পিতা। ।আনন্দবাজার পত্রিকা।