২০১৮ সালে শেষ হবে পদ্মা সেতুর কাজ
পদ্মা সেতু প্রকল্পের তিনটি মূল অংশের কাজের জন্য দরপত্র আহ্বান এবং সংশ্লিষ্ট কাজ আগামী জুন মাস নাগাদ শেষ হবে বলে আশা করছে সরকার। জুন নাগাদ শেষ করা মূল প্রকল্পের এই তিনটি উপপ্রকল্প হলো- সেতু নির্মাণ, নদী খনন এবং প্রকল্পের সার্বিক কাজ তত্ত্বাবধানের জন্য বিশেষজ্ঞ উপদেষ্টা নিয়োগ। পদ্মা সেতুর প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন। এই প্রকল্পের বর্তমান উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান মাউনসেল লিমিটেড এইসিওএম’র সঙ্গে সরকারের চুক্তি শেষ হবে আগামী ২৪ জুন।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৫ সাল নাগাদ। কিন্তু তিন বছর পেছানোর পর বর্তমানে আশা করা হচ্ছে প্রকল্পটির কাজ শেষ হবে ২০১৮ সালে। সরকারের সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সেতুটি নির্মাণের সামগ্রিক খরচ বর্তমান বাজারমূল্য অনুযায়ী ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা হলেও তিন বছর বিলম্বের কারণে প্রকল্পটির খরচ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা। এই বাড়তি খরচের বোঝা বহন করা হবে সরকারি কোষাগার থেকে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে গত জানুয়ারি মাসের ২৮ তারিখে সেতু বিভাগ একটি চিঠি পাঠিয়েছে। চিঠিতে পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের অধীনে তিনটি মূল উপ-প্রকল্পের বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হয়েছে। এই তিনটি উপ-প্রকল্পের বর্তমান অবস্থা বিবেচনা করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বৈদেশিক মুদ্রার মাধ্যমে কিভাবে বিল পরিশোধ করা হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার জন্যও চিঠিতে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
বর্তমানে সেতু বিভাগ পদ্মা সেতু প্রকল্পের সেতু নির্মাণসংশ্লিষ্ট কাজের জন্য জমা পড়া দরপত্রগুলো যাচাই-বাছাই করছে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটি নদী খননের জন্য আগ্রহী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে আগামী ২০ ফেব্র“য়ারির মধ্যে এবং সেতুর সার্বিক কাজ তত্ত্বাবধানের জন্য উপদেষ্টা পদে আগ্রহী প্রতিষ্ঠানগুলোকে ১৮ মার্চের মধ্যে দরপত্র জমা দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
পদ্মা সেতু নির্মাণসংক্রান্ত মোট ছয়টি প্রকল্পের কাজ পরিচালিত হবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আওতাধীন প্রকল্প পর্যবেক্ষণ সংক্রান্ত ফাস্ট ট্র্যাক কমিটির সরাসরি তত্ত্বাবধানে।
পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের জন্য তহবিল সংগ্রহের কাজকে ‘মুরগির জন্য খাবার সংগ্রহ’ করার সঙ্গে তুলনা করে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত জানিয়েছেন, পদ্মা সেতুর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থায়ন করা হবে নিজস্ব তহবিল থেকে এবং তাতে কোনো সমস্যা হবে না। নিজের বক্তব্যের পক্ষে সাফাই গেয়ে তিনি জানান, বর্তমানে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে যেখানে চলতি অর্থবছরের জাতীয় বাজেট হলো মাত্র দুই লাখ কোটি টাকার কিছু বেশি। কাজেই যখনই টাকার প্রয়োজন হবে, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে তা বরাদ্দ করা হবে বলে উল্লেখ করেন মুহিত। বৈদেশিক মুদ্রায় দুই বিলিয়ন ডলারেরও বেশি খরচ হবে এমন প্রকল্প বাংলাদেশে এই প্রথম।
প্রসঙ্গত, পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য বিশ্ব ব্যাংক প্রথমে এক দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের একটি তহবিল গঠনের আশ্বাস দিলেও ২০১২ সালে তা থেকে সরে দাঁড়ায় আন্তর্জাতিক এই প্রতিষ্ঠানটি। পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগদানের ব্যাপারে দুর্নীতি ও ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে ঋণ দানের চুক্তি বাতিল করে প্রতিষ্ঠানটি।
সেতু বিভাগ জানিয়েছে, মূল সেতু নির্মাণের জন্য আর্থিক ও কারিগরি বিষয়গুলোর ওপর দৃষ্টি রেখে এরই মধ্যে দরপত্র জমা দিয়েছে তিনটি প্রতিষ্ঠান- দক্ষিণ কোরিয়ার স্যামসাং সি অ্যান্ড টি করপোরেশন, চীনের মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড এবং চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ার যৌথ প্রতিষ্ঠান দায়েলিম-বাম-ভিসিআই। বর্তমানে এই তিন প্রতিষ্ঠানে জমা দেয়া দরপত্র যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলছে যা শেষ হবে আগামী মে নাগাদ। এছাড়া আমেরিকা, ফ্রান্স এবং ভারতের মোট পাঁচটি প্রতিষ্ঠান নদী খননের দায়িত্ব পাওয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। আর পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের জন্য তালিকাভুক্ত পাঁচটি প্রতিষ্ঠানকে ‘প্রস্তাবনা অনুরোধ’ (আরএফপি) পাঠিয়েছে সেতু বিভাগ। আর যেহেতু প্রকল্পের দায়িত্ব আন্তর্জাতিক কোনো প্রতিষ্ঠানকে না দিয়ে প্রকল্পের সামগ্রিক অর্থবরাদ্দের বিষয়টির দেখভাল যেহেতু খোদ সরকারের তরফ থেকেই করা হচ্ছে, তাই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে কিভাবে বৈদেশিক মুদ্রার মাধ্যমে বিল পরিশোধ করা হবে তা সেতু বিভাগকে জানানোর জন্য তাগিদ দেয়া হয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়কে।
বৈদেশিক মুদ্রায় বিল পরিশোধের দিকগুলো নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে প্রকল্পসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো স্পষ্ট করতে অর্থমন্ত্রীর সভাপতিত্বে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকের অনুরোধও জানিয়েছে সেতু বিভাগ।
সেতু বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, মোট ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা বা দুই দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার বাজেটের পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের দুই দশমিক ০৩ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হবে বৈদেশিক মুদ্রায়। বৈদেশিক মুদ্রায় যা খরচ হবে তার প্রায় ১৫ শতাংশ চুক্তি স্বাক্ষরের সময়েই অগ্রিম হিসেবে দিতে হবে। এছাড়া বিলম্বের কারণে প্রকল্পের খরচ পরে আরো বেড়ে যেতে পারে। তাছাড়া কোন প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রকল্পের দায়িত্ব দেয়া হবে তার ওপর ভিত্তি করে শেষ সময়েও টাকার অংক পরিবর্তন হতে পারে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেতু বিভাগের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পের দুইশ’ মিলিয়ন ডলার খরচ করা হবে ভারতের কাছ থেকে পাওয়া অনুদান থেকে। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সম্পর্কের ভিত্তিতে আগামী অক্টোবর মাস নাগাদ তহবিলে আরো পাঁচশ’ মিলিয়ন থেকে এক বিলিয়ন ডলার যোগ করা হতে পারে।
পাশাপাশি, দেশে বৈদেশিক মুদ্রার যা রিজার্ভ রয়েছে তার একটি বড় অংশ পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ করার পরিকল্পনা করছে সরকার। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকও প্রাথমিকভাবে সরকারের এই পরিকল্পনায় সায় দিয়েছে।
পদ্মা সেতুর সঙ্গে দুটি সংযোগ সড়কসহ প্রকল্পসংশ্লিষ্ট অন্যান্য কাজ বর্তমানে চলছে। সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত বছরের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত শুধু এসব কাজের পিছনেই সরকারের কোষাগার থেকে খরচ করা হয়েছে দুই হাজার একশ’ কোটি টাকা। ডেইলি স্টার