হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে গাম্বিয়ার পক্ষে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সে দেশের আইনমন্ত্রী ও অ্যাটর্নি জেনারেল আবুবকর মারি তামবাদুগাম্বিয়া, আবুবকর তামবাদু উভয়েই ইতিহাসে পাতায় ঢুকে গেলেন।
লজ্জায় ফেলে দিলেন গাম্বিয়ার আবুবকর
গাম্বিয়া, আবুবকর তামবাদু উভয়েই ইতিহাসে পাতায় ঢুকে গেলেন। রাখাইনে মিয়ানমারের গণহত্যার বিরুদ্ধে অপ্রত্যাশিত পদক্ষেপ হচ্ছে গাম্বিয়ার আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা। গাম্বিয়া মিয়ানমারকে গণহত্যার দায়ে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের মুখে দাঁড় করিয়েছে। তাই শান্তিতে নোবেল জয়ী অং সান সু চিকে গণতন্ত্র, মানবাধিকারের শিক্ষা দিচ্ছে গাম্বিয়া। অং সান সু চি যথারীতি সব জলাঞ্জলি দিয়ে গণহত্যার পক্ষে সাফাই গেয়ে যাচ্ছেন। আর এদিকে আবুবকর লজ্জায় ফেলে দিলেন মানবতার স্বঘোষিত অভিভাবক, আত্মীয়, মালিক ও সেবায়েতদের।
মিয়ানমারে বিরুদ্ধে মামলার মূল উদ্যোক্তা হচ্ছেন গাম্বিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল ও বিচারবিষয়ক মন্ত্রী আবুবকর তামবাদু। অনেক দেশই মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে গণহত্যা বা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা করতে পারত। কিন্তু সবাই যখন আহা-উহু করে, নিন্দা জানিয়ে বিষয়টি পার করে দিচ্ছিল, ঠিক তখনই গণহত্যার মামলা করে গাম্বিয়া সবাইকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করল। আন্তর্জাতিক আদালতে রায় কী হবে, সেটা পরের বিষয়। কিন্তু গণহত্যার মামলা হওয়াটাই গুরুত্বপূর্ণ। এখন অন্তত প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মিয়ানমারকে গণহত্যাকারী বলা যাবে। আবুবকর প্রমাণ করে দিলেন, একজন ব্যক্তিই ইতিহাসে ব্যবধান গড়ে দিতে পারেন।
দেশ হিসেবে গাম্বিয়া খুব বেশি প্রভাবশালী বা পরিচিত না। আফ্রিকার রাজনীতি বা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গাম্বিয়ার কোনো প্রভাবের কথা তেমন শোনা যায় না। এমনকি ওআইসিতেও গাম্বিয়াকে বড় ধরনের শক্তি হিসেবে কেউ বিবেচনা করে না। তবে গাম্বিয়া মানবিকতার দিক থেকে এখন শীর্ষেই থাকবে। মানবাধিকার, সম-অধিকারের বিষয়ে এত দিন পশ্চিমাদেরই চ্যাম্পিয়ন বলে মনে করা হতো। কিন্তু গাম্বিয়া সেই ধারণা পাল্টে দিল খানিকটা। দরিদ্র, ক্ষুদ্র দেশও যে মানবাধিকার, জন-অধিকারের পক্ষে কথা বলতে পারে, গাম্বিয়া তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। মনে হচ্ছে, সারা বিশ্বের কথাই বলছে গাম্বিয়া, ঠিক যখন গাম্বিয়া স্বৈরশাসকের আলখাল্লা ঝেড়ে ফেলতে চাইছে। দেশটিতে মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নত করার জন্যও কাজ করছে। এসবই গাম্বিয়াকে মানবিকতার জগতে এক অনন্য জায়গায় নিয়ে যাবে।
পশ্চিম আফ্রিকার দরিদ্র এক দেশ গাম্বিয়া। জনসংখ্যা মাত্র ২০ লাখ। তিন দিকে সেনেগাল দিয়ে ঘেরা। আটলান্টিকের তীরে ছোট্ট উপকূল রয়েছে। ২০১৮ সালে ওআইসির পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের ঢাকা বৈঠকে গাম্বিয়া পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে না পাঠিয়ে শেষ মুহূর্তে বিচারবিষয়ক মন্ত্রী আবুবকর তামবাদুকে পাঠায়। আবুবকর ওআইসির প্রতিনিধি দলের সঙ্গে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। দেশে ফিরে গিয়ে গণমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আবুবকর জানান, ‘রোহিঙ্গাদের প্রতিটি কথায় গণহত্যার কাহিনি লেখা আছে। আমি এখানে রুয়ান্ডার গণহত্যার সঙ্গে মিল খুঁজে পাই।’ রোহিঙ্গা গণহত্যার বিষয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করার জন্য আবুবকর ওইআইসিতে প্রস্তাব উত্থাপন করেন এবং এই বছর ওআইসিকে মামলায় সহযোগিতা করতে সম্মত করেন। এভাবেই আবুবকর পশ্চিম আফ্রিকার এক ক্ষুদ্র দেশ গাম্বিয়াকে মানবাধিকারের ক্ষেত্রে সামনে নিয়ে আসেন।
কিন্তু কে এই আবুবকর?
ব্রিটেনে আইন বিষয়ে শিক্ষা লাভ করে গত শতকের শেষ দিকে গাম্বিয়া ফিরে আইন পেশায় যোগ দেন আবুবকর। ২০০০ সালে একটি ঘটনা আবুবকরের চিন্তার মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ওই বছর ১৪ জন শিক্ষার্থীকে রাজপথে হত্যা করে সরকারি বাহিনী। এরপরই আবুবকর মানবাধিকার নিয়ে কাজ শুরু করেন। ২০০৩ সালে জাতিসংঘে যোগ দিয়ে তানজানিয়ায় রুয়ান্ডা গণহত্যার বিচারে কৌঁসুলি হিসেবে অংশ নেন। বলা হয়ে থাকে, আবুবকরের কৌশলী ও দৃঢ় ভূমিকার কারণে সাবেক সেনাপ্রধান আউগুস্টিন বিজিমুনিগোর ৩০ বছরের কারাদণ্ড হয়।
গত তিন বছরে অনেকটাই বদলে গেছে গাম্বিয়া। ২২ বছরের শাসনামলে গাম্বিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট ইয়াহইয়া জামেহ বিরোধীমত দমন করে এক ভয়ার্ত পরিবেশ সৃষ্টি করেছিলেন। হত্যা, গুম, আটক করে নির্যাতন নিত্যকার ঘটনা ছিল গাম্বিয়াবাসীর জীবনে। ২০১৬ সালের নির্বাচনে সবাইকে চমকে দিয়ে আদম ব্যারো প্রেসিডেন্ট ইয়াহইয়া জামেহকে পরাজিত করেন। এরপরই গাম্বিয়ার পরিস্থিতি বদলে যেতে থাকে। পরবর্তীতে নতুন সরকার ট্রুথ কমিশন গঠন করলে ইয়াহইয়ার আমলের অনেক কুকীর্তি বেরিয়ে আসে। ইয়াহইয়ার দুঃশাসনই গাম্বিয়াকে মানবতার পক্ষে লড়তে উদ্বুদ্ধ করেছে বলে আবুবকর জানান।
আর রুয়ান্ডা গণহত্যা বিচারের অভিজ্ঞতা আবুবকরকে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার মামলা করতে সাহস জুগিয়েছে। অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ছিল এটা। সবাই যখন নীরবে মিয়ানমারের গণহত্যা অবলোকন করছিল কিন্তু গণহত্যা বন্ধে তেমন জোরালো ভূমিকা রাখছিল না, তখনই এগিয়ে এল গাম্বিয়া। জাতিসংঘের জেনোসাইড কনভেনশন অনুসারেই একটি দেশ আরেকটি দেশের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ করতে পারে। এর আগেও বসনিয়া সার্বিয়ার বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ উত্থাপন করেছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে ১৯৯৩ সালে। ২০০৭ সাল পর্যন্ত এই মামলার সুরাহা করা হয়নি। কিন্তু ৭০০০ কিলোমিটার দূরের দেশ গাম্বিয়া মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে অন্তর্বর্তীকালীন সিদ্ধান্তের জন্য মামলা করেছে। এতে করে মিয়ানমারকে সুনির্দিষ্ট কিছু কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার আদেশ দিতে পারেন আদালত। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো রায় হলে নিরাপত্তা পরিষদে গিয়ে আটতে যেতে পারে। নিরাপত্তা পরিষদে চীন ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করলে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হবে না।
এখানে লক্ষণীয়, যেসব দেশ মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বের জন্য নিরন্তর লড়াই করছে, এদের কেউই মিয়ানমারে বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে এগিয়ে আসেনি। মুসলিম পরিচিতিকে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ব্যবহারকারী সৌদি আরব, তুরস্ক, ইরান, পাকিস্তান বরাবর নিন্দা জানানো ও বিবৃতি দানের মধ্যেই সীমিত ছিল। তুরস্ক অবশ্য ত্রাণ পাঠিয়েছে। এখানে দেখা যাচ্ছে, মিয়ানমারের মিত্র মুসলিম বিশ্বেরও মিত্র। মিয়ানমারের সঙ্গে চীন, রাশিয়া, আমেরিকা, ভারতের আঞ্চলিক ও কৌশলগত স্বার্থ রয়েছে। এসব দেশকে চটিয়ে এককভাবে কেউই মিয়ানমারের বিপক্ষে যেতে চায়নি। এ অবস্থায় গাম্বিয়া ওআইসিতে প্রস্তাব উত্থাপন করলে কেউ এর বিরোধিতা করতে পারেনি। এখানেই গাম্বিয়া অন্যদের থেকে এগিয়ে গেছে।
শেষ পর্যন্ত মামলার ফলাফল যা-ই হোক, আবুবকরকে সময় মনে রাখবে। গাম্বিয়াকে সবাই মনে রাখবে। নির্যাতিতের পক্ষে, নিপীড়িতের সঙ্গে দাঁড়ানোর সুযোগ সময় করে দেয়। কিন্তু সেই সুযোগ সবাই গ্রহণ করতে পারে না। যাঁরা ঝুঁকি নিয়ে, দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে যান, ইতিহাসের পাতায় তাঁদেরই নাম লেখা হয়। গাম্বিয়ার মামলার পেছনে নানা কারণ খুঁজে বের করা যাবে। এর সঙ্গে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিরও সংযোগ থাকতে পারে। কেউ হয়তো গাম্বিয়াকে উসকাতেও পারে। কারও দ্বারা প্রভাবিত হলেও গাম্বিয়াকে, আবুবকরকে মানবতার পক্ষের বলেই ইতিহাস স্মরণ করবে। ইতিহাস তাঁদের মনে রাখবে এই কারণে যে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা পরিচালনার আর্থিক সক্ষমতা না থাকার পরও ‘তোমাদের দাবি আমাদের দাবি’ বলে রোহিঙ্গাদের রক্ষায় আবুবকর নামের এক আইনজীবী তাঁর দেশ গাম্বিয়াকে নিয়ে এগিয়ে এসেছিল।