হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় ॥ জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ
বিকাশ দত্ত ॥ পাঁচ বছর আগে জামায়াতে ইসলামীকে কর্তৃত্ব-বহির্ভূতভাবে নির্বাচন কমিশন নিবন্ধন দিয়েছিল বলে হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছে। দলটির নিবন্ধন বাতিল করে হাইকোর্টের দেয়া পূর্ণাঙ্গ রায়ে এ কথা বলা হয়েছে। তিন বিচারকের স্বাক্ষরের পর শনিবার এ রায় প্রকাশিত হয়েছে। গত ১ আগস্ট উন্মুক্ত আদালতে তিন বিচারকের বেঞ্চ সংবিধানের সঙ্গে গঠনতন্ত্র সাংঘর্ষিক হওয়ায় জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে রায় দেয়। সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে দেয়া ওই রায়ে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের পক্ষে মত দেন। ভিন্নমত জানান বেঞ্চের প্রিজাইডিং বিচারক বিচারপতি এম মোয়াজ্জাম হোসেন।
সংক্ষিপ্ত রায়ে বিচারপতি এম মোয়াজ্জাম হোসেন বলেন, ‘বাই মেজরিটি, রুল ইজ মেড এ্যাবসলিউট এ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন গিভেন টু জামায়াত বাই ইলেকশন কমিশন ইজ ডিক্লেয়ার্ড ইলিগ্যাল এ্যান্ড ভয়েড।’ পূর্ণাঙ্গ রায়ের মূল অংশটি লিখেছেন বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক। তিনি লেখেন, ‘জামায়াত এবং নির্বাচন কমিশন যুক্তি দেখিয়েছে, নিবন্ধনটি সাময়িক ছিল। কিন্তু সাময়িক নিবন্ধন দেয়া যায় বলে আমরা কোন বিধান গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে পাইনি। নিবন্ধন সনদেও সাময়িক নিবন্ধন বলে কোন বিষয় আমরা পাইনি।
শনিবার জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে দেয়া হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছে। হাইকোর্টের দেয়া রায়ের ৯২ দিন পর স্বাক্ষর শেষে শনিবার ১৫৮ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশ করে সংশ্লিষ্ট দফতর। পূর্ণাঙ্গ রায়ে পাঁচ বছর আগে জামায়াতে ইসলামীকে কর্তৃত্ব-বহির্ভূতভাবে নির্বাচন কমিশন নিবন্ধন দিয়েছিল বলে বলা হয়েছে। ১ আগস্ট বিচারপতি এম মোয়াজ্জাম হোসেন, বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি কাজী রেজা-উল হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণার রায় দিয়েছেন। এই দলের প্রতীক দাঁড়িপাল্লা নিয়ে আর কেউ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে দেয়া ওই রায়ে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক নিবন্ধন বাতিলের পক্ষে মত দেন। তবে ওই বেঞ্চের সিনিয়র বিচারক বিচারপতি এম মোয়াজ্জাম হোসেন তাতে ভিন্নমত পোষণ করেন।
পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হওয়ার পর সুপ্রীমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার এম আমির-উল ইসলাম বলেছেন, জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধ বৈধতা চ্যালেঞ্চ করে যে মামলাটি হয়েছিল শনিবার তার পূর্ণাঙ্গ রায় আমাদের হস্তগত হয়েছে। দুই বিচারপতি একমত হয়েছেন। এই রুলটি নিষ্পত্তি করা হলো, জামায়াতে নিবন্ধন দেয়া হয়েছিল সেটা আইনবহির্ভূত। যেহেতু সার্টিফাই কপি দেয়া হয়েছে, সে কারণে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের ত্রিশ দিনের মধ্যে সরাসরি তারা আপীল করতে পারবেন।
পূর্ণাঙ্গ রায়ে বিচারপতি এম মোয়াজ্জাম হোসেন বলেন, যেহেতু এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের কাছে একটি দরখাস্ত রয়েছে। এখান থেকেই নিষ্পত্তি হওয়া দরকার। আদালতের আমলে নেয়ার দরকার নেই। ‘বাই মেজরিটি, রুল ইজ মেড এ্যাবসলিউট এ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন গিভেন টু জামায়াত বাই ইলেকশন কমিশন ইজ ডিক্লেয়ার্ড ইলিগ্যাল এ্যান্ড ভয়েড।’ বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক বলেছেন, এটা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিধায় নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। যেতেতু এটা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়েছে, সংবিধান সংশোধন করেনি। সে জন্য নিবন্ধন বাতিল বলে ঘোষণা করা হলো। ‘জামায়াত এবং নির্বাচন কমিশন যুক্তি দেখিয়েছে, নিবন্ধনটি সাময়িক ছিল। কিন্তু সাময়িক নিবন্ধন দেয়া যায় বলে আমরা কোন বিধান গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে পাইনি। নিবন্ধন সনদেও সাময়িক নিবন্ধন বলে কোন বিষয় আমরা পাইনি।’ অন্য বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম বলেন, অত্র রুলটি নিরুঙ্কুশ করে বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক যে রায় ও সিদ্ধান্ত প্রদান করেছেন তার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত পোষণ করে আমি আমার কিছু নিজস্ব অভিমত ব্যক্ত ও সংযোজন করছি।
২০০৮ সালে ৩৮টি দলের সঙ্গে আগের সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী জামায়াতও নিবন্ধন পায়। আইন অনুযায়ী, শুধু নিবন্ধিত দলগুলোই বিগত নির্বাচনে অংশ নিতে পারে। জামায়াতকে নিবন্ধন দেয়ার সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে তরিকত ফেডারেশনের সেক্রেটারি জেনারেল সৈয়দ রেজাউল হক চঁাঁদপুরী, জাকের পার্টির মহাসচিব মুন্সি আবদুল লতিফ, সম্মিলিত ইসলামী জোটের প্রেসিডেন্ট মাওলানা জিয়াউল হাসানসহ ২৫ জন ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে একটি রিট আবেদন করেন।
ওই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৯ সালের ২৭ জানুয়ারি হাইকোর্ট একটি রুল জারি করে। রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন কেন আইনগত কর্তৃত্ব-বহির্ভূত এবং গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের লঙ্ঘন ঘোষণা করা হবে না- তা জানতে চাওয়া হয় ওই রুলে। পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়, ‘সংশ্লিষ্ট বিধিতে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে এটা বলেছে, শর্ত পূরণ না করে দেয়া গঠনতন্ত্রের ভিত্তিতে এ ধরনের কোন নিবন্ধন দেয়ার এখতিয়ার নির্বাচন কমিশনের নেই। অথবা নির্বাচন কমিশন ওই গঠনতন্ত্র সংশোধনের মাধ্যমে শর্ত পূরণে জামায়াতকে অনুরোধ করতে পারে না। কারণ, ওই নিবন্ধন প্রথম আইনী কর্তৃত্ব-বহির্ভূতভাবে করা হয়েছে।’
‘এর মাধ্যমে আমরা এটা বলতে পারি, এ বিষয়ে জারি করা রুলের সারবত্তা রয়েছে। রুলকে চূড়ান্ত করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে ২০০৮ সালের ৪ নবেম্বর জামায়াতকে দেয়া নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন কর্তৃত্ব-বহির্ভূত এবং ফলহীন ঘোষণা করা হচ্ছে।’ এম ইনায়েতুর রহিম কাজী রেজা-উল হকের রায়ের সঙ্গে একমত পোষণ করে একটি সংযুক্তি দেন। অন্যদিকে বিচারপতি এম মোয়াজ্জাম হোসেন তাঁর দুই সহকর্মীর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে তাঁর রায়ে বলেন, জামায়াতের নিবন্ধন নিয়ে করা রিট আবেদন গ্রহণযোগ্য নয়। ‘আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন নির্বাচন কমিশন নিষ্পত্তি করার নির্দেশনা দিয়ে রুল নিষ্পত্তি করলে ন্যায়বিচার হবে। সে মতে, যুক্তিযুক্ত দ্রুত সময়ে আইন অনুসারে জামায়াতের নিবন্ধন ইস্যু নিষ্পত্তি করার নির্দেশনা দিচ্ছি।’
পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়, প্রতিবাদী পক্ষের আইনজীবী আব্দুর রাজ্জাক আলোচ্য রুলটি খারিজের সপক্ষে অত্যন্ত জোরালো যুক্ত উপস্থাপন করে নিবেদন করেন যে, রুলটি অপরিপক্ব ও রক্ষণীয় নয়। এ প্রসঙ্গে তিনি প্রতিপক্ষ নির্বাচন কমিশন কর্তৃক দাখিলকৃত হলফনামার সংযুক্ত ২৪, ২৫, ২৬ ও ২৭ এর প্রতি আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন যে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী দলটিকে সাময়িক গঠনতন্ত্রের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এর অনুচ্ছেদ ৯০ডি-এর ব্যতিক্রম বিধান অনুযায়ী শর্তসাপেক্ষে নিবন্ধন করা হয়। অনুচ্ছেদ ৯০ডি-এর ব্যতিক্রম বিধান অনুযায়ী জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে বিভিন্ন সময়ে সংশোধনকৃত দলীয় গঠনতন্ত্র নির্বাচন কশিমনে দাখিল করা হয়েছে এবং চাহিদা অনুসারে গঠনতন্ত্রের সর্বশেষ সংশোধিত কপি কমিশনে প্রদান করা হয়েছে।
পূর্ণাঙ্গ রায়ে আরও বলা হয়েছে, কমিশনের হলফনামায় যুক্ত সম্পূরক জবাবের অনুচ্ছেদ ৯ এ সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, কমিশনের ২৭০/২০১০ সভায় কমিশন অভিমত ব্যক্ত করেছে যে, (ক) জামায়াতে ইসলামী প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তাদের সংবিধান অনুসমর্থন করেনি (খ) জামায়াতে ইসলামীর গঠনতন্ত্রের ধারা ৩ এ উল্লেখিত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সংবিধানের প্রস্তাবনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক (গ) জামায়াতে ইসলামীর গঠনতন্ত্রের ধারা ৫(৩) এবং ৬(৪) সংবিধানে বর্ণিত রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় (ঘ) জামায়াতে ইসলামী গঠনতন্ত্রের ধারা ৭(১)-৪ এবং ধারা ১১(২), যা অমুসলিমদের সদস্য পদ এবং শপথসংক্রান্ত, তা বাস্তবসম্মত নয় এবং জামায়াতে ইসলামীর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক (ঙ) জামায়াতে ইসলামীর গঠনতন্ত্রে ধারা ১৮(৪)(চ) গণপ্রতিনিধত্ব আদেশের অনুচ্ছেদ ৯০ বি (১) (বি) (১) এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
নির্বাচন কমিশনের সম্পূরক হলফনামায় উপরোক্ত বক্তব্যসমূহ হতে এটা সুপষ্ট যে, নিবন্ধনের সময় দাখিলকৃত জামায়াতে ইসলামীর গঠনতন্ত্রের উল্লেখযোগ্য ধারা বা বিধানসমূহ সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ছিল অর্থাৎ গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২-এর অনুচ্ছেদ ৯০সি এ উল্লেখিত শর্তসমূহ পূরণে সক্ষম হয়নি। যেহেতু গঠনতন্ত্রটি নিবন্ধনকালীন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২-এর অনুচ্ছেদ ৯০সি এর শর্তসমূহ পূরণ করে দাখিল করা হয়নি। সুতরাং নির্বাচন কমিশন বেআইনী ও আইনবহির্ভূতভাবে তর্কিত নিবন্ধনটি প্রদান করেছে। যা আইনসঙ্গত কর্র্তৃক ব্যতিরেকে করা হয়েছে এবং এর কোন আইনগত কার্যকারিতা নেই।
রায়ে আরও বলা হয়েছে, প্রাসঙ্গিকভাবে এখানে আরেকটি বিষয় আলোচনা করা প্রয়োজন। নির্বাচন কমিশন কর্তৃক দাখিলকৃত হলফনামা ও সম্পূরক হলফনামা হতে এটা প্রতীয়মান যে, বিদ্যমান সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশন আইন প্রয়োগে নমনীয় মনোভাব দেখিয়েছে। সে কারণে কমিশন জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় আইন সম্পাদক জসিমউদ্দিন সরকারকে শর্তসাপেক্ষে দাখিলকৃত গঠনতন্ত্রের কিছু বিধান নিজ হাতে কর্তন করার সুযোগ প্রদান করেছিলেন।
জামায়াতে ইসলামী নিবন্ধনের আবেদনপত্রের সঙ্গে দাখিলকৃত গঠনতন্ত্রের সঙ্গে আইনের বিধান অনুযায়ী সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণকারী কর্তৃপক্ষ অর্থাৎ কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা ‘দলটি নবম জাতীয় সংসদের প্রথম বৈঠকের আইনে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তাদের গঠনতন্ত্রে দলের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমোদন করিয়ে কমিশনে জমা প্রদান করবে মর্মে কোন লিখিত সিদ্ধান্ত দাখিল করেনি এবং সংশ্লিষ্ট পক্ষগণ তা দাবিও করছে না। নির্বাচন কমিশনের হলফনামায় শুধু উল্লেখ করা হয়েছে যে, নিবন্ধন আবেদনের সঙ্গে নিবন্ধনের সমর্থনে জামায়াতে ইসলামীর কার্যনির্বাহী কমিটির সিদ্ধান্ত জমা দেয়া হয়েছিল। তবে ১-৩ নং প্রতিবাদী পক্ষ কর্তৃক তাদের দাখিলকৃত রুলটি খারিজের আবেদনপত্রের সংযুক্তি-৪ (পৃষ্ঠা ২০৭) হতে দেখা যায় ৩ নং প্রতিবাদী ২০-৬-২০০৮ তারিখে নির্বাচন কমিশন সচিবের বরাবরে একটি পত্র দিয়ে অবহিত করেছিলেন যে, নবম জাতীয় সংসদের পর ছয় মাসের মধ্যে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নির্ধারিত ফোরামে উক্ত প্রস্তাবনা বিবেচনা করে অনুমোদন করা হবে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ৩ নং প্রতিবাদীর উক্ত চিঠিতে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণকারী কর্তৃপক্ষের এ-সংক্রান্ত কোন সিদ্ধান্তের বিষয় উল্লেখ নেই।
হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায়ে আরও বলা হয়েছে, জামায়াতে ইসলামীর বক্তব্য নির্বাচন কমিশন ও উক্ত দল কর্তৃক দাখিলকৃত দলিলাদির সঙ্গে একেবারেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়। কমিশনের সম্পূরক হলফনামায় সংযুক্তি-২৪ হতে প্রতীয়মান যে, ১৯ এপ্রিল ২০১০ ও ৪ নবেম্বর ২০১২ সালে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল, ৩ নং প্রতিবাদী বরাবরে যথাক্রমে তাগিদপত্র-১ ও তাগিদপত্র-২ দেয়া হয়। তাগিদপত্র-২ এর দ্বারা ৫ ডিসেম্বর ২০১২ মধ্যে সংশোধিত গঠনতন্ত্র কমিশনের দাখিলের জন্য অনুরোধ করা হয়। ওই তািগদপত্রের জবাবে জসিমউদ্দিন সরকার ২০ নবেম্বর ২০১২ তারিখে কমিশনের সচিব বরাবর একটি পত্র দিয়ে সংশোধিত গঠনতন্ত্রের কপি দাখিলের জন্য ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ সাল পর্যন্ত সময় বর্ধিত করার আবেদন করেন।
কমিশনের সম্পূরক হলফনামায় সংযুক্তি ২৭ হতে স্পষ্টতই দৃশ্যমান যে, জামায়াতে ইসলামী সর্বশেষ যে গঠনতন্ত্রটি কমিশনে জমা দিয়েছে সে গঠনতন্ত্রটি সংবিধানের অনেক বিধানের এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এমতাবস্থায় ১-৩ নং প্রতিবাদী পক্ষের যে বক্তব্য ও দাবি ‘নির্বাচন কমিশন তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবহিত হয়ে নিবন্ধন প্রদান করেছে’ তার কোন বাস্তব ভিত্তি ও উৎকর্ষতা নেই এবং ওই বক্তব্য ও দাবি অন্তসারশূন্য এবং স্ববিরোধী। উপরোক্ত আলোচনা হতে এটা অত্যন্ত সুস্পষ্ট যে, জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় আইন সম্পাদক জসিমউদ্দিন সরকার দলের পক্ষে নির্বাচন কমিশনকে সংবিধানের আলোকে যথাযথভাবে দলীয় গঠনতন্ত্রের সংশোধনক্রমে আইন অনুযায়ী কমিশনে জমা প্রদান করবেন এহেন মৌখিক প্রতিশ্রুতি ও আশ্বাস প্রদান করেই দলের নিবন্ধন হাসিল করেছেন। কিন্তু প্রতিশ্রুতি ও আশ্বাস অনুযায়ী পরবর্তী সংবিধানের আলোকে গঠনতন্ত্র সংশোধন না করে বরং এখন দাবি করা হচ্ছে যে, দলটির নিবন্ধন সঠিকভাবেই দেয়া হয়েছে এবং তা হস্তক্ষেপযোগ্য নয়। জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে সংবিধানের আলোকে দলের গঠনতন্ত্র সংশোধন করার যে প্রতিশ্রুতি ও আশ্বাস কমিশনে প্রদান করা হয়েছিল তা ১-৩ নং প্রতিবাদীগণ তাদের দাখিলকৃত হলফনামা ও সম্পূরক হলফনামায় কখনও অস্বীকার করেননি।
উক্ত উপায়ে তর্কিত নিবন্ধনটি হাসিলের পর ৩নং প্রতিবাদী তার দাখিলীয় রিট পিটিশন নং ৬৮১২/২০০৮টি আদালতে উপস্থাপিত হয়নি মর্মে খারিজ করিয়ে নেন। রায়ে বলা হয়, জামায়াতে ইসলামী নিবন্ধন হাসিলের জন্য নির্বাচন কমিশনের এ ধরনের মৌখিক প্রতিশ্রুতি ও আশ্বাস ছিল প্রকারান্তরে নির্বাচন কমিশনকে বিভ্রান্ত করে কৌশল ও শঠতার আশ্রয়গ্রহণের মাধ্যমে তর্কিত নিবন্ধনটি হাসিল করা এবং অবশেষে দলটি তা করতে সক্ষম হয়েছে। অধিকন্তু উক্ত রিট মোকদ্দমাটি দায়েরের উদ্দেশ্য ছিল নির্বাচন কমিশনের ওপর মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করা। মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান (সাবেক প্রধান বিচারপতি) এবং আনিসুজ্জামান (অধ্যাপক আনিসুজ্জামান) কর্তৃক সঙ্কলিত ও সম্পাদিত ‘আইন শব্দ কোষ’ গ্রন্থে ভৎধঁফ শব্দের অর্থ ও ব্যাখ্যায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, কোন বস্তুগত সুবিধালাভের উদ্দেশ্যে কথায় বা কাজে জ্ঞাতসারে বা বেপরোয়াভাবে কৃত কোন মিথ্যা বর্ণনা। ব্যাখ্যায় ফবপরঃ শব্দটি ভৎধঁফ-এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের রায়ে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ফবপরঃ বা প্রতারণা, প্রবঞ্চনা এর ব্যাখ্যায় করা হয়েছে যে, যদি কেহ জ্ঞাতসারে অথবা হঠকারিতাপূর্বক কোন ঘটনা সম্পর্কে এমন উদ্দেশ্যে মিথ্যা কথা বলেন যে, অপর ব্যক্ত তাহার ওপর নির্ভর করে কাজ করেন। প্রতারণা বা প্রতারকের কৌশল একটি সূক্ষ্ম ধূর্ত ফন্দি বা পরিকল্পনা যাহার কোন নাম নেই। সকল ধরনের শঠতা, সূক্ষ্মতা, চাতুর্য, প্রবঞ্চনা, ধূর্ততা, অবজ্ঞা, দক্ষতা, গোপন চুক্তি, আচরণ ও আক্রমণ এবং অন্যকে প্রতারিত করার যে কোন উপায়, যার ‘অপরাধ’ ব্যতীত কোন যথার্থ বা সুনির্দিষ্ট নাম নাই। আইনের সুপ্রতিষ্ঠিত নীতি হলো যে, শঠতাপূর্ণ যে কোন কার্যক্রমই অশুদ্ধ ও অকার্যকর। উপরোক্ত বিবেচনা করলে এ অভিমত ব্যক্ত করা যায় যে, জামায়াতে ইসলামী তর্কিত নিবন্ধনটি হাসিলের জন্য নির্বাচন কমিশনে প্রবঞ্চনা বা প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছিল। অতএব ওই নিবন্ধনটি অশুদ্ধ ও অকার্যকর।
রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে, নবম জাতীয় সংসদে প্রথম বেঠকের বারো মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পর জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন-সংক্রান্ত সব কার্যক্রমেই বেআইনী ও ক্ষমতাবহির্ভূত এবং সব কার্যক্রম অশুদ্ধ হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের মতো একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের এ ধরনের বেআইনী ও ক্ষমতাবহির্ভূত কার্যক্রমকে অনুমোদন দেয়া যায় না। রায়ে বলা হয়েছে, ত্রয়োদশ সংশোধনী-সংক্রান্ত মামলায় প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক মতামত ব্যক্ত করেছেন যে, জাতীয় সংসদ যে কোন সংশোধনী করিতে পারিলেও সংশোধনীর শর্তভঙ্গ বা নধংরপ ংঃৎঁপঃঁৎব-এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোন সংশোধন আইন জাতীয় সংসদ করতে পারে না। (৬৪ ডি এল আর (এডি ) পৃষ্ঠা ৩০৪ ,অনুচ্ছেদ ৪৯১)।
রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে, বিখ্যাত সাংবাদিক রবার্ট পেইন তাঁর সাড়া জাগানো ‘ম্যাসার্কার নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, বুদ্ধিজীবী হত্যার দীর্ঘ তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছিল আলবদর নামে ধর্মোন্মত্ত দলকে নিয়ে। এরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রদের গোপনে হত্যার চক্রান্ত করে। শুধু গোপন চক্রান্তের নয়, আলবদররা এ সব হত্যাকা- ঘটিয়েছিল লোকচক্ষুর অন্তরালে।
পূর্ণাঙ্গ রায়ে আরও বলা হয়েছে, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯০ ডি ও ৯০ সি এ একটি রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের জন্য যে সব শর্ত উল্লেখ করা হয়েছে, সেখানে এমন কোন শর্ত সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ নাই যে, কোন রাজনৈতিক দল ধর্মের অপব্যবহার কিংবা অপব্যাখ্যা করলে এ দলটিকে নিবন্বন দেয়া যাবে না। বর্তমান গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের অনুচ্ছেদ ৯০ সিতে যে সব শর্ত উল্লেখ আছে, তার আলোকে ধর্মের অপব্যাখ্যা কিংবা অপব্যবহারের কারণে কোন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। যদিও বা সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১২ (গ) এর রাষ্ট্র পরিচালনার একটি উল্লেখযোগ্য মূলনীতি হলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অপব্যবহার বিলোপ করা ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাস্তবায়নের জন্য। আদালত রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিসমূহ বলবত করতে পারে না। রাষ্ট্রকেই ওই মূলনীতিসমূহের আলোকে কার্য সম্পন্ন করতে হয় এবং হবে। সে কারণে বিদ্যমান আইনের দুর্বলতাকে দূর করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের তথা আইনসভা জাতীয় সংসদের।
যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবি জোরালো হয়ে ওঠার মধ্যেই হাইকোর্ট গত আগস্টে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের রায় দেয়। রায়ের প্রতিবাদে দু’দিন হরতাল ডাকে দলটি। দলের বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা বিভিন্ন স্থানে ভাংচুর ও গাড়িতেও আগুন দেয়। জামায়াতে ইসলামীর সূচনা হয় উপমহাদেশের বিতর্কিত ধর্মীয় রাজনীতিক আবুল আলা মওদুদীর নেতৃত্বে ১৯৪১ সালের ২৬ আগস্ট, তখন এর নাম ছিল জামায়াতে ইসলামী হিন্দ।