হঠাৎ অস্থিরতা

24/09/2013 7:58 pmViews: 41

72654_f1স্টাফ রিপোর্টার: হঠাৎ চারপাশে অস্থিরতা। গার্মেন্ট শ্রমিকদের মহাসমাবেশের পর থেকে এ খাতে চলছে চরম অস্থিরতা। কর্মস্থল ছেড়ে ন্যায্য
মজুরির দাবিতে রাস্তায় প্রতিদিন বিক্ষোভ করছে শ্রমিকরা। বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ছে ঢাকা ও আশেপাশের জেলায়। এ পর্যন্ত বিক্ষোভ থামাতে কার্যকর কোন উদ্যোগই দৃশ্যমান হয়নি। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়কে ঘিরে আবার রাজপথে সক্রিয় হয়ে উঠেছে জামায়াত-শিবির। প্রতিদিনই কোন না কোন স্থানে সংঘাতে জড়াচ্ছে দলটির কর্মী-সমর্থকরা। হামলা হচ্ছে পুলিশের ওপর। যানবাহনে ভাঙচুর অগ্নিসংযোগ করা হচ্ছে। গত কয়েক দিনে অগ্নিদগ্ধ হয়ে তিনজন গাড়িচালকের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল চট্টগ্রামে দুর্ঘটনায় এক ছাত্রের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ব্যাপক যানবাহন ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এর জের ধরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ২৪ ঘণ্টার পরিবহন ধর্মঘটের ডাক দিয়েছেন মালিকরা। হরতালে অগ্নিদগ্ধ ট্রাক চালকের মৃত্যুর প্রতিবাদে গতকাল বগুড়ায় অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন পরিবহন শ্রমিকরা। দোষীদের গ্রেপ্তারে সাত দিনের আলটিমেটাম দিয়েছেন তারা। তা না হলে আরও কঠোর কর্মসূচি দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন পরিবহন শ্রমিকরা।
এদিকে নেতাদের আটকের প্রতিবাদে গতকাল চট্টগ্রামে মিছিল করেছে ছাত্রশিবির। জেলায় আধাবেলা হরতালও ডেকেছে তারা। বিএনপি’র রাজনৈতিক কর্মসূচি না থাকলেও মাঠে সক্রিয় দলটির সহযোগী সংগঠনগুলো। ছাত্রদল-যুবদল বিভিন্ন এলাকায় কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে সংঘাতে জড়াচ্ছে। সংঘর্ষ হচ্ছে পুলিশ ও সরকারি দলের কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে।
সরকারের শেষ সময়ে নির্বাচনকালীন সরকার এবং অন্যান্য দাবিতে কঠোর আন্দোলনের হুমকি দেয়া হচ্ছে বিরোধী  জোটের পক্ষ থেকে। গত সপ্তাহে আপিল বিভাগে জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয়ার পর দুই দিনের হরতাল পালন করে জামায়াতে ইসলামী। ওই হরতালের আগের দিন সারা দেশে ভাঙচুর ও বিক্ষোভ করে দলটির কর্মী-সমর্থকরা। হরতালেও ছিল ব্যাপক সহিংসতা। দুই দিনের হরতালে মারা যান তিনজন। হরতালে সহিংসতায় আহত আরও তিনজন চালকের মৃত্যু হয় চিকিৎসাধীন অবস্থায়। সর্বশেষ দুই দিনের হরতালে মারমুখো ছিল জামায়াত ও শিবির। হরতাল চলাকালে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। ব্যাপকভাবে যানবাহনে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। হরতালের পর জামায়াত ও শিবিরের দেয়া আলাদা কর্মসূচিতেও সংঘাত-সংঘর্ষ ঘটছে।
গত শনিবার ঢাকায় গার্মেন্ট শ্রমিকদের মহাসমাবেশকে ঘিরে গাজীপুর ও সাভারে শ্রমিকদের বিক্ষোভের শুরু। সমাবেশে আসতে না দেয়ায় শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করে। ন্যায্য মজুরির দাবিতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত সমাবেশের পরদিন থেকে ঢাকা ও আশপাশের জেলার গার্মেন্ট শ্রমিকরা বিক্ষোভ করে আসছে। পরিস্থিতি এখন অনেকটা অশান্ত। গার্মেন্ট মালিকরা বলছেন, এই অস্থিরতা চলতে থাকলে আগামী ঈদের আগে শ্রমিকদের বেতন-বোনাস পরিশোধ করা সম্ভব হবে না। রোববার ঢাকা ও গাজীপুরে ব্যাপক বিক্ষোভের পর গতকালও বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ ও অবরোধ করে গার্মেন্ট শ্রমিকরা।
থামছে না শ্রমিক বিক্ষোভ
কিছুতেই থামছে না শ্রমিক বিক্ষোভ। চার দিন ধরে ঢাকা ও আশপাশের জেলার বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ করে আসছে শ্রমিকরা। গতকাল সব কারখানা খোলার পূর্ব ঘোষণা থাকলেও গাজীপুর, সাভার এবং নারায়ণগঞ্জের অনেক কারখানা শ্রমিক অসন্তোষের কারণে বন্ধ ছিল। গতকাল সকাল থেকে ঢাকার কুড়িল বিশ্বরোড, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা এবং সাভারের আশুলিয়ায় শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করে। বিভিন্ন স্থানে রাস্তা অবরোধ ও ভাঙচুর চালায় শ্রমিকরা। ন্যূনতম বেতন আট হাজার করার দাবিতে আন্দোলন করে আসছে তারা।
রাজধানীতে অবরোধ-বিক্ষোভ: রাজধানীতে গতকালও বিক্ষোভ করেছে গার্মেন্ট শ্রমিকরা। সকালে কুড়িল বিশ্বরোড ও তেজগাঁও এলাকায় সহস্রাধিক শ্রমিক রাস্তায় নেমে আসে। এতে কুড়িল বিশ্বরোডে প্রায় দেড় ঘণ্টা যান চলাচল বন্ধ থাকে। তেজগাঁও এলাকায় শ্রমিকরা রাস্তায় নামলে টিয়ার শেল নিক্ষেপ ও লাঠিচার্জ করে তাদের সরিয়ে দেয়া হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, সকাল ৯টায় প্রায় চার হাজার গার্মেন্ট শ্রমিক কুড়িল বিশ্বরোড অবরোধ করে। এতে বিমানবন্দর সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ইউরো জোন, গাজী টাওয়ার, মোহাম্মদীয়া, ক্লাসিক ও কেনিয়াসহ ৮-১০টি গার্মেন্টের শ্রমিকরা বিক্ষোভ-অবরোধে অংশ নেয়। শ্রমিকরা কুড়িল ফ্লাইওভারের উপরে ও নিচে ব্যারিকেড দিয়ে বিক্ষোভ করে। এতে দুই পাশে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। দুর্ভোগে পড়েন সাধারণ যাত্রীরা। পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে শ্রমিকদের রাস্তা থেকে অবরোধ তুলে নেয়ার জন্য অনুরোধ করে। পরে দেড় ঘণ্টা রাস্তা বন্ধ করে বিক্ষোভ করার পর নেতাদের সঙ্গে সমঝোতার পর শ্রমিকরা রাস্তা থেকে অবরোধ তুলে নেয়।
খিলক্ষেত থানার ওসি শামীম হোসেন জানান, শ্রমিকরা রাস্তা অবরোধ করে যান চলাচলে বাধা দেয়ার চেষ্টা করে। তবে পুলিশ শ্রমিকদের রাস্তা থেকে সরাতে কোন বল প্রয়োগ করেনি। কোন শ্রমিককে আটক করা হয়নি। শ্রমিকদের বুঝিয়ে রাস্তা থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে।
এদিকে সকাল ৯টায় তেজগাঁও এলাকার সেপাল গার্মেন্টের শ্রমিকরা বেতন-ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে কারখানার সামনে বিক্ষোভ করে। একপর্যায়ে গার্মেন্ট ছুটি ঘোষণা করলে শ্রমিকরা কারখানা লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। পরে তারা রাস্তা অবরোধ করে মগবাজার-মহাখালী সড়ক বন্ধ করে দেয়। শ্রমিকদের রাস্তা থেকে সরিয়ে দিতে পুলিশ লাঠিচার্জ ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। প্রায় আধঘণ্টা রাস্তা অবরোধ করে রাখার পর পুলিশ শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পরে সেপাল গার্মেন্ট ও আশপাশের এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। শিল্পাঞ্চল থানা পুলিশ জানায়, শ্রমিকরা রাস্তা অবরোধ করে গাড়ি ভাঙচুরের চেষ্টা করে। পরে পুলিশ টিয়ার শেল নিক্ষেপ ও লাঠিচার্জ করে তাদের রাস্তা থেকে সরিয়ে দেয়।
স্টাফ রিপোর্টার, গাজীপুর থেকে জানান, চতুর্থ দিনের মতো গতকাল গাজীপুরে শ্রমিক অসন্তোষ অব্যাহত থাকে। বিক্ষোভ করে সড়ক অবরোধ ও ভাঙচুরের পর পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষ হয়। পুলিশ লাঠিচার্জ ও টিয়ার শেল ছুড়ে পরিস্থিতি আয়ত্তে আনে। এসব ঘটনার সময় বিভিন্ন স্থানে অন্তত ১০ জন আহত হয়। দিনভর শ্রমিক বিক্ষোভে গাজীপুর মহানগর, কালিয়াকৈর, শ্রীপুরের বিভিন্ন এলাকার অন্তত ৪০টি কারখানা ছুটি হয়ে যায়, তবে গত তিন দিনের তুলনায় শ্রমিক বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশ ছিল কঠোর অবস্থানে। শ্রমিকরা সড়কে নামার সঙ্গে সঙ্গে তাদের হটিয়ে দিতে পুলিশ ঝাঁপিয়ে পড়ে।
গার্মেন্ট কারখানা শ্রমিকদের বেতন ও সোয়েটার কারখানা শ্রমিকদের উৎপাদন মজুরি নির্ধারণ করে ঘোষণার দাবিতে মঙ্গলবার সকালে গাজীপুর মহানগরের ওয়ারলেস গেট এলাকা ও রওশন সড়ক এলাকায় কয়েকটি গার্মেন্ট কারখানার শ্রমিকরা কাজ ছেড়ে সড়কে নেমে ঢাকা-গাজীপুর সড়কে বিক্ষোভ করে। বিক্ষোভ চলাকালে চালু থাকা একটি কারখানায় ইটপাটকেল ছুড়ে ভাঙচুর করা হয়। এ সময় বিপুল সংখ্যক পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে টিয়ার শেল ছোড়ে ও লাঠিপেটা করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। ঘটনার জের ধরে ওই এলাকার অন্তত সাতটি কারখানা ছুটি ঘোষণা করা হয়। অন্যদিকে নাওজোর এলাকার বন্ধ থাকা কারখানা শ্রমিকরা ঢাকা-টাঙ্গাইল মহসড়ক অবরোধ করলে পুলিশ ধাওয়া দিয়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। উত্তেজনার প্রেক্ষিতে ওই এলাকার আরও সাতটি কারখানা ছুটি দেয়া হয়। কালিয়াকৈরের পল্লীবিদ্যুৎ এলাকার শ্রমিকরা সড়কে বিক্ষোভ করলে পুলিশ ধাওয়া দিয়ে তাদেরও সরিয়ে দেয়। গাছের গুঁড়ি ফেলে ও টায়ারে আগুন ধরিয়ে পোশাক শ্রমিকরা অবরোধ করলে কালিয়াকৈরের শফিপুর-পল্লীবিদ্যুৎ এলাকায় ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে প্রায় এক ঘণ্টা যান চলাচল বন্ধ থাকে। মঙ্গলবার সকাল ৯টায় ওই এলাকার এপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেড, ডিভাইন টেক্সটাইল, এটিএস, সেজাপ সোয়েটার, ইন্টার স্টপসহ কয়েকটি কারখানার শ্রমিকরা সকালে এসে কর্মবিরতি শুরু করে। পরে তারা বিক্ষোভ শুরু করে পাশের ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে অবস্থান নেয়। এ সময় গাছের গুঁড়ি ফেলে ও টায়ারে আগুন ধরিয়ে মহাসড়ক অবরোধ করে রাখে। পরে থানা পুলিশ ও শিল্প পুলিশ টিয়ার শেল ছোড়ে ও লাঠিপেটা করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দিলে সকাল ১০টায় যান চলাচল স্বাভাবিক হয়। পরিস্থিতির অবনতি ঠেকাতে আশপাশের অন্তত সাতখানা ছুটি ঘোষণা করে মালিক পক্ষ। ন্যূনতম মজুরি আট হাজার টাকা ঘোষণা এবং সোয়েটার কারখানা শ্রমিকদের উৎপাদন মজুরি বাড়ানোর দাবিতে গাজীপুর সদর, কালিয়াকৈর ও শ্রীপুরে পোশাক শ্রমিকরা চতুর্থ দিনের মতো বিক্ষোভ করে। মঙ্গলবার বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা গাজীপুর সদরের নাওজোর, রওশন সড়ক, ওয়ারলেস গেট, কালিয়াকৈরের শফিপুর-পল্লীবিদ্যুৎ, শ্রীপুরের নয়নপুর-এমসি বাজার এলাকায় বিক্ষোভ ও মহাসড়কে অবরোধ করে। এ সময় ইটপাটকেল ছুড়ে ওয়ারলেস গেট এলাকার সান নিট নামক কারখানাসহ কয়েকটি কারখানা ভাঙচুর করা হয়েছে। কারখানায় ইটপাটকেল নিক্ষেপ এবং ঢাকা-গাজীপুর সড়ক, ঢাকা- টাঙ্গাইল ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে অবরোধে পুলিশ বাধা দিলে শ্রমিকদের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ লাঠিচার্জ ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করেছে। এসব ঘটনার সময় অন্তত ১০ জন আহত হয়েছেন। নাশকতার আশঙ্কায় গাজীপুরের নাওজোর এলাকার দিগন্ত সোয়েটার ফ্যাক্টরি, কোস্ট টু কোস্ট, অ্যারো এপারেলসসহ কয়েকটি কারখানায় ছুটির নোটিস ঝুলিয়ে দেয়া হয় সোমবার। মঙ্গলবার এ কারখানাগুলো খোলেনি। বন্ধ থাকা দিগন্ত কারখানার শ্রমিকরা সকাল ১০টায় জড়ো হয়ে কারখানার সামনের ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক কিছুক্ষণ অবরোধ করে। গত তিন দিনের তুলনায় মঙ্গলবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন অনেক বেশি তৎপর ছিল। সকাল থেকেই শ্রমিকদের কোন ধরনের ছাড় না দিয়ে শক্ত অবস্থানে থাকে তারা। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা সড়কে ওঠার কিংবা বিশৃঙ্খলার চেষ্টা করার সঙ্গে সঙ্গেই একজনে যায়। শিল্প ও জেলা পুলিশের গাড়ির বহর ও জলকামান নিয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায়। র‌্যাবের টহলও দেখা যায় দিনভর। বিভিন্ন বড় কারখানার নিজস্ব নিরাপত্তাকর্মীরাও রয়েছেন সতর্ক অবস্থানে। গাজীপুরের ওয়ারলেস গেট ও রওশন সড়ক এলাকায় সফি প্রসেসিং, ফাং ফুয়াং, ওডেসা সোয়েটার ফ্যাক্টরি, কুজিমা লিরিক কারখানার শ্রমিকরা ঢাকা-গাজীপুর সড়কে অবস্থান নেয়। এ সময় সান নিট গার্মেন্ট কারখানায় ভাঙচুর হলে ওই কারখানাসহ আশপাশের কয়েকটি কারখানা সকাল ৯টার পরই ছুটি হয়ে যায়। গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় জরুন-কাশিমপুর-নয়াপাড়া এলাকার কয়েকটি কারখানা শ্রমিকরা কাজ ছেড়ে ওই এলাকার সড়কে নেমে বিক্ষোভ করতে থাকে। জিরানী এলাকার মাছিহাতা কারখানার শ্রমিকরা দুপুর ১২টায় কর্মবিরতি করে বিক্ষোভ করতে থাকে। এতে আতঙ্কিত হয়ে ওই এলাকার ডিবিএল, মণ্ডল ফেব্রিকস, কেয়া স্পিনিংসহ অন্তত ১৫টি কারখানা ছুটি ঘোষণা করা হয়। এদিকে বিকাল ৩টায় কালিয়াকৈরের শফিপুর এলাকার সামসুদ্দিন স্পিনিং কারখানার শ্রমিকরা লাঠিসোটা নিয়ে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক অবরোধ করলে পুলিশ ধাওয়া দিয়ে যান চলাচল স্বাভাবিক করে। মঙ্গলবার দিনভর শ্রমিক বিক্ষোভে গাজীপুর মহানগর, কালিয়াকৈর, শ্রীপুরের বিভিন্ন এলাকার অন্তত ৪০টি কারখানা ছুটি হয়ে যায় একদিনের জন্য। তবে শ্রমিক ও মালিক পক্ষ বর্তমান অবস্থার দ্রুত সমাধান চান। শ্রমিকরা তাদের বেতন-ভাতা ও উৎপাদন মজুরি বাড়ানো ব্যাপারে সুস্পষ্ট ঘোষণা চান। টানা চতুর্থ দিনের মতো শ্রমিক বিক্ষোভের বিষয়ে লক্ষ্মীপুরা এলাকার এডভান্স সোয়েটার কারখানার মার্চেনডাজিং ম্যানেজার এএসএম নাইম বলেন, এতে আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে। উৎপাদন বন্ধ থাকায় সময়মতো পোশাক রপ্তানি নিয়ে সবাই উদ্বিগ্ন। দ্রুত এর সুরাহা হওয়া প্রয়োজন। গত কয়েক দিনের তুলনায় মঙ্গলবার পুলিশের মনোভাব ছিল অনেক কঠোর। গাজীপুর পুলিশ সুপার আবদুল বাতেন জানান, শিল্প এলাকার যে কোন ধরনের বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে পর্যাপ্তসংখ্যক নিরাপত্তাকর্মী মোতায়েনসহ সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে পুলিশ প্রশাসনের। তবে শুধু বল প্রয়োগ করে এর সমাধান সম্ভব নয়। এ পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকেই আন্তরিকতার সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। টানা তিন দিন পর মঙ্গলবার চালু হয়েছে গাজীপুরের প্রায় সব গার্মেন্ট কারখানা। সকালে শ্রমিকরা ঢুকেছেন তাদের কারখানায়। তবে নাশকতার আশঙ্কায় নাওজোর, বাঘেরবাজার, কালিয়াকৈরের কয়েকটি কারখানা বন্ধ রাখা হয়। কারখানা এলাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে এবং কারখানাগুলোর নিরাপত্তা দিতে বিপুল সংখ্যক নিরাপত্তাকর্মী মোতায়েন করা হয়েছে।
শ্রীপুর (গাজীপুর) প্রতিনিধি জানান, জেলার কালিয়াকৈর উপজেলার ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের পল্লীবিদ্যুৎ, চন্দ্রা ও শ্রীপুর উপজেলার ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের মুলাইদ এলাকায় শ্রমিক বিক্ষোভ চলছে। সকাল আটটার পর থেকে শ্রমিকরা বিক্ষোভ শুরু করে। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা সকাল আটটা থেকে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক দেড় ঘণ্টা অবরোধ করে রাখে। সকাল ১০টা থেকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে রাখে। শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ চলছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল আটটা থেকে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের পল্লীবিদ্যুৎ এলাকার অ্যাপেক্স টেক্সটাইল লিমিটেডের শ্রমিকদের সঙ্গে কর্মবিরতি নিয়ে স্টাফদের বাকবিতণ্ডা হয়। পরে শ্রমিকরা কাজে যোগ না দিয়ে কারখানায় ভাঙচুর করে বাইরে বেরিয়ে যায়। বিক্ষুব্ধরা আশপাশের আয়মন টেক্স, ইন্টারস্টফ অ্যাপারেল লিমিটেড, ডিভাইন টেক্স লিমিটেডে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে। পরে ওই তিনটি কারখানার শ্রমিকরা তাদের সঙ্গে অংশ নিয়ে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে টায়ার জ্বালিয়ে অবরোধ সৃষ্টি করে। কমপক্ষে ১০ হাজার শ্রমিক অবরোধে অংশগ্রহণ করে। এ সময় শিল্প পুলিশের সদস্যরা তাদের অনুরোধ জানালে তারা সড়কে কমপক্ষে ১০টি যাত্রীবাহী বাস, পিকআপভ্যান, প্রাইভেট কারের গ্লাস ভাঙচুর করে। এ সময় সড়কের দু’পাশে চার কিলোমিটারের যানজট সৃষ্টি হয়।
স্টাফ রিপোর্টার, নারায়ণগঞ্জ থেকে জানান, মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে পোশাক কারখানার শ্রমিকরা দুই ঘণ্টা নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা লিংকরোড অবরোধ করে। এ সময় বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা ৮-১০টি গাড়ি ভাঙচুর করে। মঙ্গলবার সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত শিবু মার্কেট এলাকায় অবরোধের কারণে ওই সড়কে সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে। ফলে দুর্ভোগে পড়ে সাধারণ মানুষ। শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছে। প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ জানান, সকাল ১০টায় ফতুল্লার শিল্পাঞ্চলের লিবার্টি, মাইক্রো ফাইবার, পলমল গ্রুপ ও ওসমান নিটেক্স পোশাক কারখানার শ্রমিকরা মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে কারখানা ভেতরে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। একপর্যায়ে তারা কারখানা থেকে রাস্তায় নেমে আসে। এ সময় তারা আশপাশের অন্যান্য কারখানার শ্রমিকদের নামিয়ে আনার চেষ্টা করে। শ্রমিকদের বের হতে না দিলে শ্রমিকরা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে কারখানার গ্লাস ভাঙচুর করে। পরে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা লাঠিসোটা নিয়ে ফতুল্লার শিবু মার্কেট এলাকায় সড়ক অবরোধ ও ৮-১০টি যানবাহন ভাঙচুর করে। বড় ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে রামারবাগ, কতুবাইল, কাঠেরপুল, শিবু মার্কেট, লামাপাড়া এলাকার মাইক্রো, লিবার্টি, মেট্রো, পলমল, ক্যাডটেক্স গার্মেন্টে ছুটি ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। শ্রমিকদের অভিযোগ, শ্রমিকরা বিক্ষোভ মিছিল বের করলে কয়েকটি কারখানা মালিক পক্ষের লোকজন তাদের মারধর করেছে। তারা ন্যূনতম মজুরি ৮ হাজার টাকাসহ তাদের সব দাবি মেনে নেয়ার আহ্বান জানান। ফতুল্লা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আকতার হোসেন জানান, মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে ফতুল্লার শিল্পাঞ্চলের বেশ কয়েকটি কারখানার শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে আসে। এ সময় সড়ক অবরোধ ও ভাঙচুর করেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। লিংকরোডে দুপুর সোয়া ১২টা থেকে যান চলাচল শুরু হয়েছে।
স্টাফ রিপোর্টার, সাভার থেকে জানান, ন্যূনতম আট হাজার টাকা মজুরির দাবিতে শ্রমিক বিক্ষোভের কারণে মঙ্গলবার আশুলিয়ার ১০টি পোশাক কারখানা ছুটি ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। বিক্ষোভরত শ্রমিকদের দমাতে পুলিশ মৃদু লাঠিচার্জ করেছে। এতে কয়েক শ্রমিক আহত হয়েছেন। শিল্প পুলিশের আশুলিয়া জোনের পরিদর্শক আবদুস সাত্তার বলেন, আশুলিয়ার জিরাবো-বিশমাইল সড়কের দু’পাশে অবস্থিত প্রায় ১০টি কারখানার শ্রমিকরা বিক্ষোভ করলে কর্তৃপক্ষ ছুটি ঘোষণা করেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকালে পুকুরপাড় এলাকার মাসকট গ্রুপের শ্রমিকরা কাজে যোগ না দেয়াই মূল ফটকের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ দেখাতে থাকে। এ সময় পার্শ্ববর্তী রেডিয়েন্স গ্রুপের শ্রমিকরা দ্বিতীয় দিনের মতো বিক্ষোভরত শ্রমিকদের সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দেয়। পরে তারা পার্শ্ববর্তী সাউদার্ন ফ্যাশন, টি-ডিজাইন লিমিটেড ও সিলভার টেক্সসহ বেশ কয়েকটি কারখানায় ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে।
পরে অবস্থা বেগতিক দেখে কর্তৃপক্ষ ছুটি ঘোষণা করে। শ্রমিকরা জিরাব বাসস্ট্যান্ডে সড়কে ওঠার চেষ্টা করলে পুলিশ মৃদু লাঠিচার্জ করে ছত্রভঙ্গ করে দেয় বলে শিল্প পুলিশের ওই কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
মির্জাপুরে শ্রমিক-পুলিশ সংঘর্ষ সাংবাদিক, পুলিশসহ আহত ১৫
স্টাফ রিপোর্টার, টাঙ্গাইল থেকে জানান, টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের গোড়াই শিল্পাঞ্চলে গার্মেন্ট শ্রমিক ও পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ কয়েক রাউন্ড রাবার বুলেট ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। ক্ষুব্ধ শ্রমিকরা দুইটি কারখানা, কয়েকটি যানবাহনে ভাঙচুর চালালে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে কমপক্ষে দুই ঘণ্টা যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে। সংঘর্ষে এক সাংবাদিক ও পুলিশসহ কমপক্ষে ১৫জন শ্রমিক আহত হয়েছে। এ ঘটনায় গোড়াই শিল্পাঞ্চলের সকল গার্মেন্ট কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আহত সাংবাদিককে মির্জাপুর কুমুদিনী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে এবং আহত অন্যদের বিভিন্ন ক্লিনিকে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

Leave a Reply