স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে পুলিশের কড়া চিঠি
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে পুলিশের কড়া চিঠি
‘জেলা প্রশাসক-পুলিশ সুপার দ্বন্দ্বে মাঠ প্রশাসনের চেইন অব কমান্ডে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা’- শিরোনামে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনের বিপরীতে কড়া জবারের চিঠি দিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। গত ৩১শে মে পুলিশের এআইজি (সংস্থাপন) মো. আমিনুল ইসলামের স্বাক্ষরে পাঠানো ওই চিঠিতে তাদের বক্তব্য উল্লেখ করা হয়েছে। চিঠি পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা মানবজমিনকে বলেন, প্রতিবেদনের ভিত্তিতে পুলিশ জবাব পাঠিয়েছে। এসব জবাব আমরা যাচাই বাছাই করে দেখবো। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ পুলিশের বক্তব্য শিরোনামে ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, মাঠ প্রশাসনে ডিসি-এসপি স্থানীয় রাজনীতিবিদদের সঙ্গে সমন্বয় করে দেশের আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। হাতে অস্ত্র থাকা ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা হওয়ায় পুলিশের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের সখ্য বেশি। পুলিশি শক্তির সঙ্গে রাজনৈতিক শক্তির অলিখিত সন্ধির কারণে এমপিরা নিজেদের মতো করে চলার চেষ্টা করছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা এমন বক্তব্যের বিপরীতে বলা হয়েছে, প্রতিবেদনের এ বক্তব্য রাজনীতিবিদসহ বাংলাদেশ পুলিশের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী ও সুশৃঙ্খল বাহিনীকে হেয় করা এবং গণতন্ত্র সমুন্নত রাখতে ভূমিকা পালনকারী একটি সংস্থার মনোবল ক্ষুণ্য করার অপপ্রয়াস মাত্র। এখানে বর্ণিত বক্তব্য সুশৃঙ্খল গণতান্ত্রিক কাঠামোতে আঘাত হানার শামিল। পুলিশ ও রাজনীতিবিদদের সন্ধির ন্যূনতম কোন অবকাশ নেই। মাঠপর্যায়ে ৬৪টি জেলায় ১০ম থেকে ১৩তম ব্যাচের ডিসিদের সঙ্গে ১৫তম থেকে ২০তম ব্যাচের এসপিরা সমন্বয়ের মাধ্যমে চমৎকার কর্মপরিবেশের মধ্যে অর্পিত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। যার প্রতিফলন সর্বোচ্চ রাজনৈতিক ব্যক্তি, সব সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, সুশীল সমাজ, দেশের আপামর জনসাধারণের কাছে সুস্পষ্ট। উল্লেখ্য, প্রশাসন ক্যাডারের ৮৪ ব্যাচের সচিবদের সঙ্গে পুলিশ ক্যাডারের ৮৪ ব্যাচের ডিআইজি বা এডিশনাল ডিআইজিদের চমৎকার প্রশাসনিক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, সিভিল প্রশাসন ও পুলিশ একে অপরের পরিপূরক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজনৈতিক ও অবৈধ অর্থের জোরে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার থেকে প্রমোশন পেয়েই জেলার এসপি হিসেবে পোস্টিং পেয়ে যায়। তাদের অনেকের মূল টার্গেট থাকে রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থেকে অর্থ উপার্জন। পুলিশের চিঠিতে এ বিষয়ে বলা হয়েছে, প্রতিবেদনের এ বক্তব্যের মাধ্যমে প্রকারান্তরে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীসহ প্রমোশন ও পোস্টিংয়ের ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনকারী প্রশাসনযন্ত্রের প্রত্যেকের কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। সার্বিক বিবেচনায় যা অযৌক্তিক, অবমাননাকর ও মর্যাদা হানিকর। প্রতিবেদনে উদাহরণ দিয়ে বলা হয়, নারায়ণগঞ্জের উপ-নির্বাচন উপলক্ষে পুলিশ সুপার কর্তৃক মতবিনিময় সভার আয়োজন করে চিঠি ইস্যুকরণ সংক্রান্তে বলা যায় যে, নারায়ণগঞ্জ জেলায় ডিসি ও এসপির মধ্যে আন্তরিক ও সৌহার্দপূর্ণ কর্মপরিবেশ বিরাজমান। উপ-নির্বাচনের সময় মতবিনিময় সংক্রান্ত এসপি কর্তৃক ইস্যুকৃত চিঠি ডিসি কর্তৃক আয়োজনকৃত সভার আগে ইস্যু করা হয়েছিল। পরে জেলা প্রশাসন সভা আহ্বান করার প্রেক্ষিতে পরস্পরের সমন্বয়ের মাধ্যমেই এসপি মতবিনিময় সভা স্থগিত করেন। পুলিশের চিঠিতে বলা হয়েছে, এ ঘটনাটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এ বিচ্ছিন্ন ঘটনাটি দ্বারা ৬৪টি জেলার সার্বিক চিত্র এককভাবে প্রতিফলিত হয় না। এ ঘটনার প্রেক্ষিতে দায়ী সব পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে বিদ্যমান আইন ও বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এ অনুচ্ছেদেও সংসদ সদস্য ও পুলিশকে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়েছে। সিভিল প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কুলীন মানসিকতা প্রসঙ্গটি দু’একজন কর্মকর্তার ব্যক্তিপর্যায়ে পরিলক্ষিত হলেও সামষ্টিক ক্ষেত্রে এ ধরনের বক্তব্যের কোন সত্যতা পাওয়া যায় না। পুলিশ ও প্রশাসন পারস্পরিক সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও সুসম্পর্কের মাধ্যমে অত্যন্ত আন্তরিক পরিবেশে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। দু’একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে প্রত্যেক নিজ নিজ দায়িত্ব অত্যন্ত নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে পালন করে যাচ্ছে। তাই রাষ্ট্রীয় প্রশাসনযন্ত্রের বিরুদ্ধে এ ধরনের প্রতিবেদন অপ্রত্যাশিত ও অনভিপ্রেত। পুলিশের চিঠিতে বলা হয়েছে, দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে দু’একটি জেলার ঘটনার ক্ষেত্রে অদক্ষ পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। প্রশাসনের ক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে অনুরূপ ব্যবস্থা নেয়া হয়। এ ক্ষেত্রে দু’এক জেলার বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে সারা দেশের চিত্র হিসেবে উদ্ধৃত করার মাধ্যমে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের মধ্যে বিদ্যমান সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কে নষ্ট করতে এরূপ বিভ্রান্তিকর ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রতিবেদন উপস্থাপন সর্বোতভাবে অনাকাঙ্ক্ষিত। সারা দেশে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের মধ্যে বিদ্যমান সুসম্পর্কের ফলে দেশের জনসাধারণ আগের কোন সময়ের চেয়ে বেশি দৃশ্যমান সেবা পাচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে ৬ নং অনুচ্ছেদে বর্ণিত বিষয সম্পর্কে পুলিশের চিঠিতে বলা হয়েছে, এ অনুচ্ছেদের আলোকে বলা যায় যে, বাংলাদেশ পুলিশের মতো একটি দায়িত্বশীল ও সুশৃঙ্খল সংস্থার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত ছাড়া এ ধরনের অভিযোগ সংবলিত প্রতিবেদন প্রকাশ কোনভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয়। তাছাড়া এ ধরনের মন্তব্য আন্তঃবিভাগীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এ ধরনের বিষোদগার পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের মনোবল ক্ষুণ্ন করে, যা তাদের সার্বিক কার্যকলাপে নেতিবাচক প্রভাব ফেরতে পারে। পুলিশের চিঠি’র সর্বশেষ প্যারায় বলা হয়েছে, দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিধান, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও মানবাধিকার রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত অন্যতম প্রধান প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পুলিশ। বাংলাদেশ পুলিশের রয়েছে স্বাধীনতা যুদ্ধে সংগ্রামী ও সাহসিকতাপূর্ণ গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। স্বাধীনতা সংগ্রাম ছাড়াও দেশের সকল ক্রান্তিকালে বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যগণ দেশমাতৃকার সেবায় এগিয়ে এসেছে। পুলিশ বাহিনী দেশ ও জাতির সেবায় প্রতিনিয়ত তাদের উপর অর্পিত পবিত্র দায়িত্ব একনিষ্ঠভাবে এ সাহসিকতার সঙ্গে পালন করছে। গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষা, সামাজিক স্থিতিশীলতা অর্জন এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ইতিমধ্যে পুলিশের আন্তরিকতা, কর্মকুশলতা ও পেশাদারিত্ব দেশবাসীর কাছে প্রশংসিত হয়েছে। জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস দমন এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন কর্তৃক আহূত হরতাল এবং আইনশৃঙ্খলা পরিপন্থি, সংঘাতপূর্ণ কর্মতৎপরতা ও নাশকতা রোধে এবং সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে বাংলাদেশ পুলিশের দক্ষতা ও সক্ষমতা ইতিমধ্যে সর্বমহলে স্বীকৃতি লাভ করেছে। ভবিষ্যতেও পুলিশ বাহিনী তাদের উপর অর্পিত সাংবিধানিক এবং আইনগত দায়িত্ব পালনসহ জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধানে যে কোন ত্যাগ স্বীকার করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। কাজেই আন্তঃবিভাগীয় সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক অক্ষুণ্ন রাখার স্বার্থে যে কোন প্রতিবেদনে মন্তব্য করার ক্ষেত্রে আরও আন্তরিক ও যত্নবান হওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে নির্দেশনা দেয়ার জন্য অনুরোধ করছি।