স্তন ক্যান্সার : করণীয়
স্তন ক্যান্সার মহিলাদের নানা রকম ক্যান্সার রোগের মধ্যে অন্যতম অসুখ। বিভিন্ন বয়সের মহিলারা নানাবিধ স্তন সমস্যায় ভোগেন, সেগুলোর বেশির ভাগই কিন্তু ক্যান্সার নয়। লিখেছেন অধ্যাপক ডা: এম খাদেমুল ইসলাম
প্রায় সবাই ক্যান্সার দুশ্চিন্তা নিয়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হন। স্বাস্থ্যসচেতনতা বাড়ার কারণে শহুরে মহিলারা যদিও স্তন সমস্যায় দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন, তথাপি এখনো গ্রামগঞ্জ থেকে আসা অনেক স্তন ক্যান্সারের রোগী পাওয়া যায়, যাদের অসুখ অনেকটা বর্ধিত আকার ধারণ করেছে এবং সে ক্ষেত্রে চিকিৎসার ফল খুব একটা ভালো হয় না। অথচ প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় হলে আধুনিক চিকিৎসায় সম্পূর্ণ রোগ মুক্ত হওয়া সম্ভব।
কাদের স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বেশি
নিম্নোক্ত মহিলাদের স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বেশি-
১. দেরিতে প্রথম সন্তান ধারণ।
২. প্রলম্বিত সন্তান উৎপাদনকাল অর্থাৎ আগাম ঋতুবতী হওয়া ও দেরিতে স্থায়ী ঋতু বন্ধ হওয়া।
৩. বন্ধ্যত্ব অথবা এক সন্তানের পর আর সন্তান না হওয়া।
৪. রক্ত সম্পর্কিত আত্মীয় অর্থাৎ নানী, দাদী, মা ও খালা স্তন কিংবা ডিম্বাশয়ের ক্যান্সারে ভোগা।
৫. মেদবহুল ও মেদযুক্ত খাবার অতি মাত্রায় ভক্ষণ।
৬. বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে স্তন ক্যান্সার বৃদ্ধির হার বাড়তে থাকে। সাধারণত ৩০ বছর বয়সের নিচে কদাচিত স্তন ক্যান্সার রোগী পাওয়া যায়। আমার ২৯ বছরের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় অর্ধডজনের মতো স্তন ক্যান্সারের রোগী ২৫ বছর বয়সের কেউ স্তনে কোনো চাকা বা দলা অনুভব করলে স্তন ক্যান্সার হয়েছে মনে করে অতি মাত্রায় উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই।
৭. যাদের এক দিকের স্তনে ক্যান্সার হয়েছে এবং যথাযথ চিকিৎসা নিয়ে ভালো আছেন, তাদের অন্য স্তনে ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কাজেই সে ব্যাপারে অবশ্যই সচেতন থাকতে হবে।
৮. দীর্ঘ দিন জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি খাওয়া কিংবা স্থায়ী ঋতু বন্ধের পর দীর্ঘমেয়াদি মহিলা হরমোন গ্রহণ স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
৯. সন্তানকে মাতৃদুগ্ধ পান না করানো।
স্তন ক্যান্সারের লক্ষণ : মূল লক্ষণ হলো স্তনে কোনো চাকা বা দলা অনুভব করা, যা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হয় ব্যথাহীন। ব্যথাযুক্ত চাকা ক্যান্সার গোত্রের হওয়ার আশঙ্কা কম। ব্যথাহীন হওয়ার কারণে অনেকেই তেমন গুরুত্ব দেন না বা কমপক্ষে কয়েক মাস দেরি করে চিকিৎসার জন্য আসেন। স্বল্প সময়ের মধ্যে স্তনে ব্যথা ও ফোলা নিয়ে অর্থাৎ স্তন প্রদাহের মতো উপসর্গ নিয়ে কিছুসংখ্যক মহিলা আসেন। এ জাতের ক্যান্সার অতি তেজি চরিত্রের। কাজেই এ অবস্থায় স্তন প্রদাহের চিকিৎসায় আশানুরূপ উন্নতি না হলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ শল্য চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত। চাকা-দলা ছাড়া অন্য উপসর্গগুলো হচ্ছে- স্তনের বোঁটা দিয়ে রক্ত বা রক্তমিশ্রিত পদার্থ বের হওয়া, বোঁটা বেঁকে যাওয়া বা দেবে যাওয়া, একজিমার মতো ক্ষত হয়ে বোঁটা ক্ষয় হয়ে যাওয়া, সব স্তন শক্ত হয়ে যাওয়া বা বগলের মধ্যে দলা অনুভব করা ইত্যাদি। এখানে একটা কথা বলা খুবই জরুরি মনে করছি, তা হলো ত্রিশোর্ধ্ব মহিলাদের স্তনে কোনো চাকা থাকলে তার আপাতত বৈশিষ্ট্য যতই নির্দোষ মনে হোক না কেন তা অবশ্যই গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে সঠিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা উচিত।
রোগ নির্ণয় : রোগ নির্ণয়ের মূল পরীক্ষা হচ্ছে, অনুভূত চাকা বা দলা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে হিস্টো বা সাইটোপ্যাথলজি পরীক্ষার মাধ্যমে ক্যান্সার কোষের উপস্থিতি শনাক্তকরণ। নমুনা সংগ্রহের বিভিন্ন পদ্ধতি আছে। বিভিন্ন পদ্ধতির মধ্যে সূক্ষ্ম সুই ফুটিয়ে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা এখন বিশ্বজুড়ে আধুনিক পদ্ধতি হিসেবে প্রচলিত আছে। এই পরীক্ষা পদ্ধতিকে ইংরেজিতে বলা হয় FNAC. এই FNAC পরীক্ষা নির্ভুল করার জন্য নমুনা সংগ্রহ করার সময় আল্ট্রাসনোগ্রাফির সহায়তা নেয়া যেতে পারে। FNAC পরীক্ষায় শত ভাগ নিশ্চিত না হলে পরিকল্পিত অস্ত্রোপচারের শুরুতে Frozen Section হিস্টো প্যাথলজি করে নিশ্চিত হয়ে যথাযথ অস্ত্রোপচার করা যায়। কাজেই সনাতন পদ্ধতিতে কেটে নমুনা সংগ্রহ করা, অর্থাৎ Open Biops- করা এখনকার দিনে আর প্রয়োজন হয় না। নমুনা সংগ্রহের আগে ক্ষেত্রবিশেষে স্তনের বিশেষ ধরনের X-ray ম্যামোগ্রাফি কিংবা আল্ট্রাসনোগ্রাফি করে চাকা বা দলার কিছু বৈশিষ্ট্য যাচাই করা যেতে পারে, যা রোগ নির্ণয়ে সহায়ক ভূমিকা পালন করে মাত্র। কাজেই সুনিশ্চিতভাবে চাকা বা দলা অনুভব করা গেলে প্রথম পরীক্ষা হিসেবে সুই ফুটিয়ে নমুনা সংগ্রহ করাই যৌক্তিক বা বাস্তবভিত্তিক পরীক্ষা। স্তন সমস্যা হলে ঢালাওভাবে গধসড়মৎধঢ়যু করা আদৌ যৌক্তিক নয়, বরং তাতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই স্তনে অপ্রয়োজনীয় রেডিয়েশন প্রবাহের ঘটনা ঘটে, যা পরবর্তীকালে ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। আর ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর বয়সের নিচের মহিলাদের Mamography করাই উচিত নয়। তাই স্তনের ইমেজিং বা ছবির মাধ্যমে নিরীক্ষণ দরকার হলে হাই রেজুলেশন আল্ট্রাসনোগ্রাফি করা উত্তম ও নিরাপদ। তা ছাড়া ভালো আল্ট্রাসনোগ্রাফি মেমোগ্রাফি থেকে বেশি তথ্য প্রদানে সক্ষম। তাই আমি ব্যক্তিগতভাবে আল্ট্রাসনোগ্রাফিকেই প্রথম বিবেচ্য ইমেজিং পরীক্ষা হিসেবে অনুমোদন করি, যদি ইমেজিংয়ের নিতান্তই প্রয়োজন হয়। রোগ নির্ণয়ের পর অনেক পরীক্ষা করা হয়, তা মূলত অসুখের পর্যায় নির্ণয় ও সঠিক চিকিৎসার যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ করার জন্য। অপারেশনের পর টিউমার নমুনা থেকে আরো অনেক পরীক্ষা করা হয়, যেমন- বিভিন্ন ধরনের হরমোন রিসেপ্টর পরীক্ষা, যেগুলো ক্যান্সারের জৈবিক চরিত্র বিশ্লেষণে সহায়ক এবং হরমোন চিকিৎসার যৌক্তিকতা ও ফলাফলপ্রাপ্তির ব্যাপারে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।
চিকিৎসা : সুনিশ্চিতভাবে স্তন ক্যান্সার নির্ণয় হলে সঠিক চিকিৎসা নির্ভর করে কিছু বিষয়ের ওপর। বিষয়গুলো হলো- রোগীর বয়স, ক্যান্সারের আকার-আকৃতি ও অবস্থান, ক্যান্সারের পর্যায় ও বিস্তৃতি, বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসাপ্রাপ্যতার সুযোগ এবং সর্বোপরি রোগীর ব্যক্তিগত ইচ্ছা ও পছন্দ ইত্যাদি। আধুনিক বিশ্বে স্তন ক্যান্সার চিকিৎসার পরিকল্পনা করা হয় সম্মিলিত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে এবং সে সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণ করেন ব্রেস্ট সার্জন, অনকোলজিস্ট, রেডিও থেরাপিস্ট, প্লাস্টিক সার্জন ও ক্যান্সার আক্রান্ত রোগী নিজে। সব বিষয় বিবেচনা করে একটি সুষ্ঠু চিকিৎসা পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়, যা সমন্বিতভাবে কিংবা পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা হয়। চিকিৎসার বিভিন্ন পন্থা হলো অস্ত্রোপচার, ক্যামোথেরাপি, রেডিওথেরাপি, হরমোনথেরাপি। প্রাথমিক পর্যায়, অর্থাৎ স্তন ক্যান্সার শুধু স্তন কিংবা স্তনসংলগ্ন বগলের লসিকাগ্রন্থির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চিকিৎসার প্রথম ও মৌলিক ধাপ হিসেবে অস্ত্রোপচার সর্বজনস্বীকৃত। এই অস্ত্রোপচার স্তন সংরক্ষণ করে শুধু টিউমার অপসারণ ও বগলের লসিকাগ্রন্থির নমুনা সংগ্রহ কিংবা টিউমারসহ সমস্ত স্তন কর্তন এবং সেই সাথে বগলের লসিকাগ্রন্থির নমুনা সংগ্রহ বা লসিকাগ্রন্থিগুলোর অপসারণ হতে পারে। কার বেলায় কোন ধরনের অস্ত্রোপচার প্রযোজ্য তা নির্ণিত হয় ক্যান্সারের বিভিন্ন ধরনের বৈশিষ্ট্য ও রোগীর ইচ্ছার ওপর। তারপর বিস্তারিত তথ্যের ভিত্তিতে সম্পূরক চিকিৎসা হিসেবে ক্যামোথেরাপি, রেডিওথেরাপি কিংবা হরমোনথেরাপি দিতে হবে। যদি স্তন ক্যান্সার স্থানীয়ভাবে অগ্রবর্তী বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়, সে ক্ষেত্রে প্রথমেই ক্যামো (নিওঅ্যাডজুভেন্ট) কিংবা রেডিওথেরাপি প্রয়োগ করে টিউমারের বিস্তৃতি নিম্নগামী (ডউন স্টেজিং) করে তার অস্ত্রোপচার করা যেতে পারে। অস্ত্রোপচারের পর অবশ্যই সম্পূরক চিকিৎসা হিসেবে ক্যামো, রেডিও বা হরমোনথেরাপি দিতে হবে। স্তন ক্যান্সার নির্ণয়ের পর্যায়ে যদি দেখা যায়, রোগ স্তনের বাইরে অনেক অংশেই বিস্তার লাভ করেছে, সে ক্ষেত্রে তা আর নিরাময়যোগ্য পর্যায় হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসার নীতিমালা হলো রোগীর বিভিন্ন ধরনের কষ্টদায়ক উপসর্গ বা উপসর্গগুলোর উপসর্গ ভিত্তিক চিকিৎসা প্রদান করে কষ্ট লাঘব করা। এ ক্ষেত্রে কষ্ট লাঘবের জন্য ক্যামো বা রেডিওথেরাপি, ব্যথানাশক ও অন্যান্য অনুষঙ্গিক চিকিৎসা প্রদান করাই বাঞ্ছনীয়। স্তন ক্যান্সারের এমন অগ্রবর্তী পর্যায়ে রোগ নিরাময়ের চিন্তা করা আদৌ সমীচীন নয়।
প্রতিকার : স্তন ক্যান্সার প্রতিকার বা প্রতিরোধ করতে হলে আগে উল্লিখিত কারণগুলোর মধ্যে যেগুলো পরিহার বা পরিত্যাগ করা যায় তা পালন করা। তবে সত্যিকার অর্থে প্রাথমিক প্রতিকার বা প্রতিরোধ করা হয়তো সম্ভব নয়। তাই প্রাথমিক প্রতিকারের চেয়ে প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয়কেই মূলত প্রাধান্য দেয়া উচিত। যারা স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি গোত্রের পর্যায়ে পড়েন, তাদের স্বাস্থ্য সচেতনতা ও নিয়মিতভাবে যথাযথ পদ্ধতিতে নিজে নিজে স্তন পরীক্ষা করা উচিত এবং সে পরীক্ষায় সন্দেহজনক কিছু মনে হলে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।
লেখক : চিফ কনসাল্ট্যান্ট সার্জন
জেনারেল অ্যান্ড ল্যাপারোস্কপিক সার্জারি বিভাগ
ল্যাব এইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল, ঢাকা