সোহাগ গাজীর বিশ্বরেকর্ড
মহিউদ্দিন পলাশ: টেস্ট ক্রিকেটে এক ম্যাচে সেঞ্চুরির সঙ্গে পাঁচ উইকেট পাওয়ার ঘটনা অহরহ আছে। কিন্তু সেঞ্চুরির সঙ্গে হ্যাটট্রিকের ঘটনা নেই একটিও। কিন্তু তাই বলে কি হবে না? হয়েছে এবং তা ঘটিয়েছেন বাংলাদেশের সোহাগ গাজী। আর এ ঘটনা ঘটানোর মাধ্যমে তিনি বিশ্ব রেকর্ডের জন্ম দিয়েছেন। জায়গা করে নিয়েছেন ইতিহাসের পাতায়। আগামীতে হয়তো এ জাতীয় ঘটনা আরও ঘটবে। কিন্তু বিশ্ব ক্রিকেটে প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে সোহাগ গাজী সব সময় গুরুত্ব পাবেন আলাদাভাবে। যখনই কেউ এ জাতীয় ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাবে, তখনই অবধারিতভাবে নাম চলে আসবে সোহাগ গাজীর। ইচ্ছা করলেও কেউ মুছে ফেলতে পারবে না তাকে।
রোজার ঈদ আনন্দের। উপহার দেয়া-নেয়ার মাঝে থাকে নির্মল আনন্দ। কোরবানির ঈদ ত্যাগের। এখানে আনন্দের চেয়ে ত্যাগের মহিমাই বেশি। কিন্তু এবারের কোরবানি ঈদ ত্যাগের পাশাপাশি উপহারের ডালির পসরা সাজিয়ে বসেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতিমধ্যে ঈদ উপহার হিসেবে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার ও চট্টগ্রামের ফ্লাইওভার উদ্বোধন করেন। এবার সেখানে যোগ হয়েছে সোহাগ গাজীর বিশ্ব রেকর্ড। এক ম্যাচে সেঞ্চুরি আর হ্যাটট্রিক। ত্যাগ আর আনন্দের মহিমায় এবারের কোরবানির ঈদ বাঙালির জাতীয় জীবনে নতুন এক মাত্রা যোগ করবে।
টেস্ট ক্রিকেটের বয়স ১৩৬। সেখানে বাংলাদেশের বয়স মাত্র ১৩ বছর। বলা যায়, এখনও কৈশোর অতিক্রম করেনি। আর সোহাগ গাজী এখনও এক বছর অতিক্রম করেননি। গত বছর ১৩ নভেম্বর খুলনায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে অভিষেক হয়েছিল। অভিষেকেই তিনি দ্যুতি ছড়িয়েছিলেন ইনিংসে ছয় উইকেট নিয়ে। ৭৪ রানে ছয় উইকেট। তার এই ছয় উইকেট ছিল অবশ্য দ্বিতীয় ইনিংসে, যা ছিল অভিষেকে কোনো বাংলাদেশি বোলারের ইনিংসে সেরা বোলিংও। প্রথম ইনিংসের তিন উইকেট যোগ হওয়ার পর ম্যাচে ২১৯ রানে নয় উইকেটও হয়ে যায় অভিষেকে বাংলাদেশের বোলারের সেরা বোলিং। যাত্রাই যার রেকর্ড দিয়ে, পরে সেখানে আরও রেকর্ড জমা হওয়ারই কথা। টেস্টের পর একদিনের ম্যাচে অভিষেকে চার উইকেট নিয়েও তিনি বাংলাদেশের হয়ে সেরা বোলিং করেছিলেন। কিন্তু মাত্র এক বছরেরও কম সময়ের ব্যবধানে সোহাগ গাজী যে এভাবে বিশ্ব রেকর্ডের জন্ম দেবেন তা ছিল অকল্পনীয়।
সোহাগ গাজীর প্রথম পরিচয় তিনি একজন বোলার। অভিষেকে নজর কাড়া নৈপুণ্য দেখানোর পর তার মাধ্যমে একজন সত্যিকারের অফ স্পিনারের অভাব দূর হওয়ার রাস্তা প্রসারিত হয়। বলা যায়, বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে অভিষেক টেস্টের অধিনায়ক নাইমুর রহমান দুর্জয়ের পর সোহাগ গাজীই দ্বিতীয় অফ স্পিনার। নাইমুর রহমানও তার এবং বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টে ছয় উইকেট নিয়েছিলেন। কিন্তু এরপর তিনি আর সেভাবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি। তার বিদায়ের পর শুরু শূন্যতা। যা পূরণ করতে পার হয়ে গেছে এক যুগ!
শূন্যতা পূরণে এক যুগ পার হলেও তার সুফল কিন্তু বেশ ভালোভাবে পেতে শুরু করেছে বাংলাদেশ দল। অনেক সাধনা আর অপেক্ষার ফসল সোহাগ গাজী। সেঞ্চুরি করার পর হ্যাটট্রিকসহ ছয় উইকেট সোহাগ গাজীর পরিচয় হলেও শুধুই অফ স্পিনারের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকেননি। পরিপূর্ণ অলরাউন্ডারের স্বীকৃতি পেয়ে গেছেন। আর এর মাধ্যমে বলা যায়, সাকিব আল হাসানের পর বাংলাদেশ দল আরও একজন জাত অলরাউন্ডারের সন্ধান পেয়েছে। সবার জন্য সুখবর এবং ভাবতে ভালো লাগবে যখন দেখা যাবে, সাকিব ও সোহাগ একই সঙ্গে খেলছেন। একেকটি দল যেখানে একজন জাত অলরাউন্ডারের অভাববোধ করছে প্রচণ্ডভাবে, সেখানে বাংলাদেশ দলে দুই দুইজন অলরাউন্ডার। বাংলাদেশের ক্রিকেটের পালে বসন্ত বাতাস বইতে শুরু করেছে। এর প্রমাণ চট্টগ্রামের প্রথম টেস্ট। নিউজিল্যান্ড দলের বিপক্ষে পুরো পাঁচদিন খেলে ড্র করা। এর আগে ২০০৮ সালে বাংলাদেশ দল নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ড্র করলেও তা ছিল বৃষ্টি বিঘ্নিত।
সোহাগ গাজী যদি হ্যাটট্রিক না করতেন তাহলে তিনি সেঞ্চুরি ও পাঁচ উইকেট নেয়া বিশ্ব তালিকায় ২৯ নম্বরে স্থান পেতেন। আর বাংলাদেশের হয়ে দ্বিতীয়। এর আগে ২০১১ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ঢাকায় সাকিব ব্যাট হাতে ১৪৪ ও বল হাতে ৮২ রানে ছয় উইকেট নিয়েছিলেন।
চট্টগ্রাম টেস্টের নিষ্প্রাণ ড্রতে আলো ছড়িয়েছেন সোহাগ গাজী। টেস্টকে নিষ্প্রাণ করে তোলার পিছনেও রয়েছে আবার তার কারুকাজ। ব্যাট হাতে সেঞ্চুরি করার মাধ্যমেই তিনি টেস্টের গতিপথ ঠিক করে দেন ড্র। পঞ্চম দিনের খেলা ছিল শুধুই আনুষ্ঠানিকতা। সেই আনুষ্ঠানিকতায় আলো ছড়ান সোহাগ গাজী হ্যাটট্রিক করে। ইনিংসের ৮৫তম ওভারে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ বলে যথাক্রমে এন্ডারসন, ওয়াটলিং ও ব্রাসওয়েলকে আউট করেন। তার হ্যাটট্রিক আউটটি ছিল এক কথায় অসাধারণ। এজন্য তিনি সতীর্থ সাকিবের কাছে চিরঋণী হয়ে থাকবেন। এন্ডারসনকে এলবিডব্লিউর ফাঁদে ফেলে, ওয়াটলিংকে উইকেটের পিছনে মুশফিকুর তালুবন্দি করার মাধ্যমে সোহাগ গাজী ইনিংসে সেঞ্চুরি ও পাঁচ উইকেট পাওয়া বোলারদের তালিকায় ঢুকে পড়েন। এই দুই উইকেটের আগে তিনি একে একে আউট করেছিলেন ফুলটন, উইলিয়ামসন ও অধিনায়ক ম্যাককালামকে। সোহাগ গাজীর হ্যাটট্রিক বলে ব্রাসওয়েলের উইকেট হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছিল। তার ব্যাটে লেগে বল মুশফিকুরের প্যাডে লেগে মাথার ওপর দিয়ে বের হয়ে যায়। কিন্তু প্রথম স্লিপে দাঁড়ানো বিশ্বের দুই নম্বর সেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানের নিশানা ব্যর্থ হয়নি। তিনি সামনের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে এক হাতে বল তালুবন্দি করেন। এরপর সে কি উল্লাস। একদিকে মাঠে সোহাগ গাজীকে নিয়ে সতীর্থদের উল্লাস, অপরদিকে গ্যালারিতে দর্শকদের। দুই সংমিশ্রণে মনে হবে বাংলাদেশ ম্যাচ জিতে গেছে। সোহাগ গাজীর এ অর্জন ম্যাচ জয়ের চেয়ে কোনো অংশ কম নয়। সোহাগ গাজীর হ্যাটট্রিকের পরপরই আসে নিউজিল্যান্ডের ইনিংস ঘোষণা। ইনিংসে সেঞ্চুরি ও পাঁচ উইকেট পাওয়া বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের তালিকায় সোহাগ গাজী যেমন দ্বিতীয়, তেমনি হ্যাটট্রিক ম্যান হওয়ার ক্ষেত্রেও তিনি দ্বিতীয় বাংলাদেশি বোলার। এর আগে অলক কাপালি পেশওয়ারে ২০০৩ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম হ্যাটট্রিক করেছিলেন।
সেঞ্চুরি, হ্যাটট্রিক, বিশ্ব রেকর্ড— এক ম্যাচে কত অর্জন। আহ্লাদে আটখানা হওয়ার কথা। উড়বেন আকাশে। অথচ কি নির্লিপ্ত তিনি। বিশ্ব রেকর্ড যে করেছেন তা তিনি জানতেনই না। খেলা শেষে ম্যাচসেরার অনুভূতি জানাতে এসে সংবাদ সম্মেলনে প্রথম তিনি জানতেন পারেন বিশ্ব রেকর্ডের কথা। জানার পরও খুব একটা বাড়তি উচ্ছ্বাস নেই। অন্য কেউ হলে হয়তো সত্যি, তাই, দারুণ তো— এ জাতীয় কথা বলে চেয়ার থেকে হয়তো লাফিয়ে উঠতেন। কিন্তু ব্যতিক্রম সোহাগ গাজী। ‘খুশি’ বলে ব্যক্ত করেছেন ছোট্ট অনুভূতি। পারফরম্যান্সের এ ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে চান বলে জানান তিনি। তার মুখ থেকে কিছু বাড়তি কথা বের করার জন্য সাংবাদিকরা আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। নানা প্রশ্ন করেছেন। কিন্তু সোহাগ গাজী ‘ছোট্ট’ করে উত্তর দেয়া থেকে বের হয়ে আসেননি। কিন্তু মুঠোফোনে বর্তমানকে জানিয়েছেন তার আবেগের কথা।
সেঞ্চুরি ও হ্যাটট্রিক— দুটিই আরাধ্য। অথচ সেখানে তিনি একাই মালিক। কোনটি ছিল কঠিন। সোহাগ গাজীর কাছে সেঞ্চুরি করাটাই ছিল কঠিন। তিনি যেহেতু বোলার, উইকেট পাবেনই। সেঞ্চুরি করার মতো ব্যাটসম্যান তিনি ছিলেন না। কিন্তু নিজেকে প্রমাণ করার জন্য সেঞ্চুরি করাটা ছিল তার খুবই জরুরি। সোহাগ বলেন, সেঞ্চুরি করাটা আমার কাছে কঠিন মনে হয়েছে। আমি যে ব্যাটিং করতে পারি তা প্রমাণ করার প্রয়োজন ছিল। তাছাড়া আমাদের দলের অবস্থাও ভালো ছিল না। এ রকম অর্জনের পর তিনি নিজেকে অলরাউন্ডার ভাবেন কি না জানতে চাইলে সোহাগ গাজী নিরুত্তর থেকেছেন। হয়তো আরও কিছুটা সময় নিতে চান। সেঞ্চুরি ও হ্যাটট্রিকের মাঝে কোনটিকে এগিয়ে রাখবেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি এগিয়ে রেখেছেন হ্যাটট্রিক করাকে। তিনি বলেন, হ্যাটট্রিক ছিল বলার ঊর্ধ্বে। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে আমার হ্যাটট্রিক আছে। কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটে হ্যাটট্রিক আমার কাছে অদ্ভুত মনে হয়েছে। হ্যাটট্রিক করার জন্য তিনি বিশেষভাবে ধন্যবাদ দিয়েছেন মুশফিকুর রহীম ও সাকিবকে। বলেন, তারা দুজনেই দুটি কঠিন ক্যাচ ধরেছেন। এই দুটি ক্যাচ ধরতে না পারলে আমার হ্যাটট্রিক করা হতো না।