সেক্স মানেই তো হাজার তর্ক
সেক্স মানেই তো হাজার তর্ক: সদাচার-কদাচার, সাম্য-অসাম্য, শ্লীলতা-অশ্লীলতা। মানুষের সমাজ পেরিয়ে প্রাণী জগতের নানা আশ্চর্য কাণ্ডকারখানাকে কী ভাবে দেখব আমরা ? মাপবোই বা কোন মানদণ্ডে ?
‘সেক্স’ শব্দটা শুনলেই কুঁচকে যান ক-বাবু। জীবধর্ম পালনের, অর্থাৎ বংশবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে ওটা যেটুকু না করলেই নয়। কিন্তু তার বেশি না। পাশ্চাত্যেও আছেন ক-বাবু, সেখানে তিনি কেলগ সাহেব (বিখ্যাত কেলগ ব্র্যাণ্ডের জনক), জোরদার গলায় বলেছিলেন, বংশবৃদ্ধিই সেক্সের একমাত্র উদ্দেশ্য, বাকি সব কদাচার। এমনকী, ডারউইনবাদী বিজ্ঞানীদের মতেও জীবের পরম ধর্ম বংশবৃদ্ধি। অন্য জীবের তুলনায় আরও বেশি বংশবৃদ্ধির মাধ্যমে আরও বেশি সংখ্যায় নিজের জিন-এর কপি পরবর্তী প্রজন্মে চালান করার নামই প্রাকৃতিক নির্বাচন। অতএব, জীবের আচার আচরণ, চরিত্রাবলি ওই একমুখী। তা হতে পারে, বংশবৃদ্ধি জীবের পরম ধর্ম। কিন্তু সেই বংশবৃদ্ধিরও এমন সব রকম সকম আছে জীবজগতে, সে পদ্ধতির বৈচিত্র্যের বহর জানলে আক্কেল গুড়ুম হয়ে যাবে। অন্তত ক-বাবুদের তো বটেই। মনে হবে, এই রে, কদাচার আর সদাচারের সংজ্ঞাগুলো ফের নেড়েচেড়ে দেখি।
সেক্স ব্যাপারটার গোড়াতেই অসাম্য। বংশবৃদ্ধির জন্যে যৌথ মিলনের প্রকল্পে নারীর বিনিয়োগ অনেক বেশি। ডিম্বাণুর মধ্যে ভবিষ্যৎ ভ্রূণের জন্য কুসুম কুসুম খাদ্য আর অন্যান্য সব প্রয়োজনীয় বস্তু গুছিয়ে রাখে সে। পুরুষের শুক্রাণু শুধু ন্যাজ নাড়াতে নাড়াতে এসে তার মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে নিজের এক সেট জিন রেখে দেয়, যাতে নিজের চরিত্রগুলো হবু সন্তানের মধ্যে যথাসম্ভব ফুটিয়ে তোলা যায়। এই অসাম্যে অবশ্যই পুরুষের সুবিধে, তার বংশ সঞ্চারের ক্ষমতা নারীর থেকে অনেক বেশি। যেমন, মানুষ নারী তার বছর পঁয়ত্রিশ ব্যাপী গর্ভধারণক্ষম জীবনে চারশো সওয়া চারশো ডিম্বাণু তৈরি করতে পারে (মাসে একটি হিসাবে)। সেখানে এক জন পুরুষ মানুষ প্রতি দিন চল্লিশ পঞ্চাশ কোটি শুক্রাণু তৈরি করে!
এই অসাম্য কম বেশি দেখা যায় প্রায় সব প্রজাতিতেই। বিবর্তনে লিঙ্গ অসাম্যের ফল হল, পুরুষ একই সঙ্গে একাধিক নারীতে গর্ভসঞ্চারে সক্ষম, সে চায়, বহু কামিনীর গর্ভে (অর্থাৎ ডিম্বাণুতে) সঞ্চারিত হোক নিজের জিন। অন্য পুরুষ যেন সেখানে ভাগ না বসায়। ও দিকে জন্মসূত্রে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই জনসংখ্যায় নারী পুরুষ প্রায় সমান সমান। অতএব, যা অবশ্যম্ভাবী, তাই ঘটে— পুরুষে পুরুষে নারীর জন্য প্রতিযোগিতা। শিং-এ শিং ঠেকিয়ে, বুক চাপড়ে, দাঁতে দাঁতে, নখে নখে সে লড়াই কাটাকাটি টিভির দৌলতে দেখা যায় ঘরে বসে। খুনোখুনিও বাদ যায় না। বউ-এর জন্য খুনোখুনির লঙ্কা কী ট্রয় কাণ্ড ঘটে প্রাণিজগতেও। যেমন, ডুমুরে পোকার মধ্যে তা ঘটতে দেখেছেন বিল হ্যামিলটন। একটা মাত্র ডুমুরের মধ্যে তিনি এক বার ১৫টি নারীর জন্য লড়াই-এ ৪২টি পুরুষ ডুমুরে পোকাকে ছিন্নভিন্ন, মৃত বা অর্ধমৃত অবস্থায় দেখেছিলেন। বেঁচেছিল মাত্র ১২টি পুরুষ।
নারীর জন্য পুরুষে পুরুষে লড়াই মানেই কি খুনোখুনি? আর, নারী কি একেবারেই মতামতহীনা, কেবলই দখলদার পুরুষের গর্ভাধার? মোটেই না। বিবর্তনের হিসাবে, নারী চায় ‘গুনতিতে না পারি, গুণ দেখে পুষিয়ে নেব’। আর, পুরুষে পুরুষে লড়াইও বেশির ভাগ হয় দেখনদারির। বেশির ভাগ সময়ই, কারটা কত বড়— ল্যাজ, শিং, দাঁত কী পুরো শরীর, তার। নারী সেই দেখনদারির বাহার বহর মেপেই স্বামী নির্বাচন করে। যেমন করে ময়ূরী। ময়ূরের পেখমের বাহার আর বহর মেপে। কিন্তু লাভটা কী? ময়ূরের ওই দেখনদারির পিছনে বংশসঞ্চারী কী গুণ আছে যে, প্রাকৃতিক নির্বাচন ময়ূরীদের এই ‘সুবুদ্ধি’ টিকিয়ে রেখেছে? বাহারে ল্যাজ বানাতে কম পুষ্টি খরচ হয় ময়ূরদেহের? তার পর সেই বাহার তো বাঘ-ভালুকের চোখ টানে। তাদের হাতে ময়ূরের প্রাণটি যাবার সম্ভাবনা প্রবল। এহেন খরচে, বিপজ্জনক জিন বংশধরদের মধ্যে চালান করে ময়ূরীর ক্ষতি বই লাভ কই? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে ডারউইন সাহেবেরও মাথা ঘুরে গিয়েছিল সেই থেকে আজও চলছে নতুন নতুন তত্ত্বের তিরন্দাজি। এদের কয়েকটা বেশ চমকে দেওয়ার মতো।
যেমন, হ্যামিলটন সাহেবদের মতে, স্বয়ম্বরা ময়ূরীর মনে থাকে একটাই চিন্তা— হবু স্বামীটির পেটে কৃমি আছে কি? কেননা, দেহে পরজীবী থাকলে নাকি পেখমের বাহার যায় ধসে। অর্থাৎ, মোহন পেখম ময়ূর মানেই পরজীবীহীন নীরোগ দেহ, পরজীবী-প্রতিরোধী জিন ভরপুর পুরুষ। ছেলেমেয়েরা সেই জিনই পাক— এই চায় ময়ূরী মায়ের মন। আবার, জাহাভি সাহেবের মতটা বেশ মজার। তাঁর মতে, ময়ূরী ভাবে, শো কেসেই যখন এত, গোডাউনে না জানি কত! যে ছেলে এত খরচা করে, রিস্ক নিয়েও বহাল তবিয়তে জীবন কাটাচ্ছে, তার নিশ্চয় জীবনীশক্তিতে অন্যদের টেক্কা দেওয়ার মতো আসলি মাল, অর্থাৎ জিন আছে যথেষ্ট। অতএব, একেই আমি ‘ওগো’ বলি। অন্য দিকে, অ্যালেক্সা বাসালোরা পরীক্ষা টরিক্ষা করে অনেক না মানুষ কন্যাদের মনের কোণে খুঁজে পেয়েছেন দেখনদার পুরুষের প্রতি ব্যাখ্যাতীত এক মোহ। সত্যিই তো, ক্ষত্রিয় কন্যা সীতা কী দ্রৌপদী স্বয়ম্বর সভায় যখন আর্মস চালনায় সেরা পুরুষটির গলায় বরমাল্য পরান, তখন বোঝা যায়। কিন্তু, আধুনিকাটি যখন সানগ্লাস পরা, হুস করে বাইক চালানো ফুটো হিরোটিকে জীবনসঙ্গী নির্বাচন করেন, তখন বোঝা দায়। হয়তো, মেয়েদের মন, ময়ূরীর কী মানুষীর— দেবা ন জানন্তি।
পুরুষে পুরুষে লড়াই যেখানে একাধিক বউকে নিজের একচেটিয়া দখলে রাখার, যাকে বলে, হারেম রাখা, জ্যারেড ডায়মণ্ড সাহেব সেখানে একটা অদ্ভুত হিসেব দেখাবার চেষ্টা করেছেন। এলিফ্যান্ট সিল-এর হারেমে ৪৭-৪৮টা বউ থাকে। হারেম মালিকের দেহের ওজন প্রায় তিন টন, সেখানে এক একটি সিল-বউ মাত্র ৩১-৩২ কেজি। গোরিলা-পুঙ্গবদের হারেম অত বড় নয়, তিন থেকে ছ’টি বউ। বর তার বউয়ের থেকে ওজনে আকারে প্রায় ডবল। উল্লুক সমাজে আবার এক স্ত্রী, এক স্বামী। তাদের আকার ওজন প্রায় সমান। অর্থাৎ, যেন, নারীর তুলনায় পুরুষের যত বড় দেহ, তত বড় তার হারেম। এই সূত্রকে ঘুরিয়ে দেখে ডায়মণ্ড সাহেবের মত— মানুষের ক্ষেত্রে, গড়ে যে এক জন পূর্ণাঙ্গ পুরুষ এক জন পূর্ণাঙ্গী নারীর চেয়ে আকারে কিছুটা বড়— এটাই ইঙ্গিত করে যে, আমাদের প্রজাতির পুরুষদের একটি ছোটখাটো হারেম রাখার আদি প্রবণতা আছে। কু-ইঙ্গিত? হয়তো বা। তবে, আমাদের মেয়েরা যে সাধারণত নিজের চেয়ে একটু লম্বা ছেলেকেই বর হিসেবে পছন্দ করে— সে ব্যাপারটা তো ফেলা যায় না।
যতই দামড়া হও, মাস্ল বাগাও, হারেমে বউ রাখা অত সহজ নয়। যারা হারেমপতির সঙ্গে লড়াইয়ে হেরে বউ হারা, তারা কেউই সন্ন্যাস নেয় না। আশেপাশেই ঘুরঘুর ছোঁকছোঁক করে। সুযোগ পেলেই…নীল মাথা র্যাশ মাছ কী দৈত্যাকার কাট্ল ফিশদের এ রকম কিছু পুরুষ নারীরূপ ধরে হারেমপতির চোখে ধুলো দিয়ে ঢুকে পড়ে অন্দরমহলে। ডলফিন বা ওরাং উটানদের চ্যাংড়া ছেলেরা আবার পরস্ত্রী অনিচ্ছুক হলে জোর খাটাতেও দ্বিধা করে না। হারেম রুদ্ধ পত্নীটি যে সব সময় অনিচ্ছুক হবেন, তাও নয়। বরং, প্রাকৃতিক
নির্বাচনের অঙ্ক অনুযায়ী স্ত্রী জীবটিরও একটু বৈচিত্রের আকাঙ্ক্ষা থাকা স্বাভাবিক। সর্বগুণসম্পন্ন একক পুরুষ আর কোথায়? ভিন্ন ভিন্ন গুণের সন্ধানে কুন্তী দেবীর মতো একেবারে বাছাই করে ভিন্ন ভিন্ন পুরুষ না পেলাম, একাধিক পুরুষ নয় কেন? শুধু হারেমের বন্দিনীরাই নয়, স্বেচ্ছায় দাম্পত্য বরণ করে যারা, সেই সব প্রজাতিতেও স্ত্রীদের এহেন বহুগামী প্রবণতা থাকার কথা। অতএব, পুরুষের মুশকিল। পুরুষ কী করে? পুরুষ কী না করে! বহুগামিতায় সিদ্ধলিঙ্গ মনুষ্য পুরুষদের স্ত্রী’র কামার্তি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় ‘ফিমেল সারকামসিশন’ কিংবা ‘চেস্টিটি লক্’ জাতীয় ভয়ঙ্কর পদ্ধতির কথা শুনেছেন অনেকে। তাঁরা মনুষ্যেতর পুরুষদের এ জাতীয় ইতর কীর্তিকাহিনি জানেন না হয়তো। বেশ কিছু কৃমি কীট ও পোকা পুরুষ একই উদ্দেশ্য নিয়ে মিলনের পরই নিজ দেহনিঃসৃত রস দিয়ে স্ত্রী অঙ্গের মুখ এঁটে দেয়। এ রকম অনেক আছে। তবে, সন্দেহবাতিকে আর স্ত্রী-গর্ভের উপর নিজের দখল একচেটিয়া রাখার পদ্ধতিতে মানবপুঙ্গবদের হারায় কে? সেরাদের সেরা অবশ্য তাং-বংশীয় চিনা সম্রাটরা। নিষিদ্ধ নগরীর প্রাসাদে বন্দি রেখেও তাঁদের কয়েকশো বউ আর রক্ষিতাদের সতীত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারতেন না তাঁরা। তার জন্য নিয়োজিত ছিল বিশাল এক মহিলা কর্মচারী বাহিনী। যাদের একমাত্র কাজ ছিল কাগজে কলমে প্রত্যেকটি হারেম-সুন্দরীর মাসিকচক্রের হিসাব রাখা এবং সেই অনুযায়ী সম্রাটের শয্যাসঙ্গিনী বেছে দেওয়া। যাতে সম্রাট কর্তৃক তাদের গর্ভসঞ্চারের সম্ভাবনা সর্বাধিক থাকে। কোনও সুন্দরীর গর্ভবতী হওয়ার সময়টি এই হিসাব অনুযায়ী সন্দেহজনক হলেই হল, হারেমজাদা সম্রাট সেই হারেমির গর্দান নিতেন। –