সিরিয়া এবং নতুন শীতল যুদ্ধের শুরু
যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া দ্বন্দ্ব
সিরিয়া এবং নতুন শীতল যুদ্ধের শুরু
দামেস্কের উপকণ্ঠ দুমায় সম্প্রতি সিরীয় বাহিনীর কথিত রাসায়নিক হামলার প্রতিক্রিয়ায় মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট বাহিনী যে বিমান হামলা চালিয়েছে, তা থেকে পশ্চিমা বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, সিরিয়া ইস্যুতে ওয়াশিংটন তার নীতি পরিবর্তন করেছে। রাশিয়া এত দিন বিনা বাধায় সেখানে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছিল। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের এই যৌথ অভিযান রাশিয়ার সেই একক আধিপত্যকে এখন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে।
মাত্র দুই মাস আগে মার্কিন বিমান থেকে দেইর আল জুর এলাকায় বাশার আল-আসাদপন্থী বাহিনীর ওপর হামলা চালানো হয়। সেখানে কয়েক ডজন ভাড়াটে রুশ যোদ্ধা নিহত হয়। রাশিয়া এই হতাহতের খবর স্বীকার করতে বেশ কয়েক দিন সময় নেয় এবং এর প্রতিক্রিয়ায় তারা পাল্টা কোনো হামলা এখনো চালায়নি।
১৪ এপ্রিল জোট বাহিনী দেইর আল জুর এলাকায় যে হামলা চালিয়েছে, আপাতদৃষ্টিতে সেটির প্রভাব খুব কম মনে হলেও প্রতীকী দিক থেকে এর গুরুত্ব অনেক। কারণ এর মাধ্যমে সিরিয়ায় রাশিয়ার আধিপত্যকে জোরালোভাবে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। তার চেয়ে বড় কথা হলো, এর মাধ্যমে বড় শক্তিগুলোর ক্ষমতার দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য হয়ে উঠেছে। যৌথ বাহিনীর হামলার আগেই রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের উত্তেজনা বোঝা যাচ্ছিল। সেদিকে ইঙ্গিত করে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছিলেন, ‘প্রতিহিংসার শীতল যুদ্ধ ফিরে আসছে।’
গত কয়েক মাসে সিরিয়ায় যা ঘটছে তা থেকে বোঝা যায়, শীতল যুদ্ধের সময়কার পরিস্থিতির সঙ্গে এখনকার এই দ্বন্দ্বের মিল রয়েছে। সেই সময়ের মতো এখন রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের ইতিবাচক কূটনৈতিক তৎপরতা অনেকটাই কমে এসেছে। সামরিকভাবে মুখোমুখি হওয়ার মতো পরিস্থিতি এড়াতে যে মাত্রায় দুই পক্ষের মধ্যে কূটনৈতিক যোগাযোগ থাকা দরকার, এখন তা নেই। দুই পক্ষের মধ্যেই একটা যুদ্ধংদেহী মনোভাব ক্রমে বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে।
শীতল যুদ্ধের সময় উত্তেজনা খুব দ্রুত পাকিয়ে উঠত, আবার অপ্রত্যাশিতভাবে সেই উত্তেজনা মিইয়ে যেত। সে সময় কিউবায় ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিস্থাপন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বড় উত্তেজনা দেখা দিয়েছিল। মাত্র ১৩ দিনের মধ্যে পরিস্থিতি এতটাই ঘোলাটে হয়ে উঠেছিল যে তখন মনে হচ্ছিল যেকোনো সময়ে দুই পক্ষের মধ্যে লড়াই বেধে যাবে। দুই পক্ষই তাদের সেনাবাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রেখেছিল। কিন্তু সেই উত্তেজনা বেশি দূর গড়ায়নি। এই উত্তেজনার মধ্যে কিউবান সেনাদের গুলিতে মাত্র একজন মার্কিন পাইলটের মৃত্যু হয়েছিল। এর বেশি কিছু হয়নি।
এখন সিরিয়া ইস্যুতে আবার সেই পুরোনো দুই প্রতিপক্ষ চাঙা হয়ে উঠেছে। উভয় রাজধানী থেকে গরম-গরম রাজনৈতিক বক্তব্য আসছে। এর সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের এক হয়ে অভিযান চালানো চলমান ঘটনায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে এবং ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী এমানুয়েল মাখোঁ বলেছেন, বাশার বাহিনী যাতে ভবিষ্যতে আর এ ধরনের রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করার সাহস না করে, সে জন্য এই হামলা। কিন্তু শুধু রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার ঠেকাতে ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য সেখানে নাক গলাবে, সেটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। এর পেছনে সাম্প্রতিক ঘটনাবলির ধারাবাহিকতা আছে বলে মনে করা হচ্ছে।
সম্প্রতি সালিসবারিতে রুশ গুপ্তচর ও তাঁর মেয়েকে বিষ প্রয়োগে হত্যার চেষ্টা নিয়ে যুক্তরাজ্য ও রাশিয়ার উত্তেজনা বেড়ে গেছে। দুই পক্ষই পাল্টাপাল্টি কূটনীতিক বহিষ্কার করেছে। কয়েক বছরের মধ্যে এই দুই দেশের মধ্যে এখন সবচেয়ে বেশি মাত্রার তিক্ত সম্পর্ক বিরাজ করছে।
গত কয়েক বছরে রাশিয়ার সঙ্গে ফ্রান্সেরও তিক্ত সম্পর্ক চলছে। ফ্রান্সের ২০১৭ সালের ভোটে রাশিয়া হস্তক্ষেপ করেছে এবং প্রার্থীদের নিয়ে রাশিয়া মিথ্যা তথ্য প্রচার করেছে বলে মনে করা হয়। এই বিষয়টি ফ্রান্সকে ক্ষুব্ধ করেছে। ক্রেমলিনের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বলা যায়, নিজের ঘর থেকে দূরে সরে গিয়ে যাতে রাশিয়ার সঙ্গে বোঝাপড়া করা যায়, সে জন্য ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য সিরিয়ায় তাদের সামরিক উপস্থিতি বাড়াচ্ছে।
মস্কো ও ওয়াশিংটনের এখনকার উপলব্ধি হলো একে অন্যকে শূলবিদ্ধ করার মোক্ষম জায়গা হলো সিরিয়া। তারা ইতিমধ্যে সিরিয়ায় যে পরিমাণ অর্থ ও সামরিক শক্তি বিনিয়োগ করেছে, তার ফায়দা তুলে আনতে চাইবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মস্কো এবং ওয়াশিংটন যেভাবে জার্মানিকে পূর্ব ও পশ্চিম-এই দুই ভাগে ভাগ করেছিল, ঠিক একই কায়দায় সিরিয়াকেও তারা এভাবে ভাগ করতে চাইতে পারে। আর বিশ্বশক্তিগুলোর এই ক্ষমতার রশি-টানাটানিতে স্বাভাবিকভাবেই সিরিয়ার ওপর আরও বড় দুর্দশা নেমে আসতে পারে।
ক্ষমতাধরদের দ্বন্দ্বের মাঝে পড়ে সিরিয়ার সাধারণ মানুষ তাদের নিজেদের লক্ষ্য ঠিক রাখার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে পারে। শেষ পর্যন্ত দুর্দশার শিকার হতে হবে তাদেরই।
আল-জাজিরা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত