সিঙ্গাপুর ছাড়তে বাংলাদেশিসহ অভিবাসী শ্রমিকদের চাপ
সিঙ্গাপুর ছাড়তে বাংলাদেশিসহ বিদেশি শ্রমিকদের চাপ ও হুমকি দেয়া হচ্ছে। চাকরির মেয়াদ শেষ হবার আগেই প্রতিশ্রুতি অর্থ না দিয়ে জোরপূর্বক সিঙ্গাপুর ত্যাগে বাধ্য করছে দেশটির নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠান। একাজে তারা ব্যবহার করছে সেখানকার প্রত্যাবর্তন কোম্পানিগুলোকে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদ সংস্থা এসোসিয়েট প্রেস (এপি) রোববার এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে এক বাংলাদেশি শ্রমিকের ওপর নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, জমি-জমা বিক্রি ও বহু টাকা ঋণ করে এক বছর মেয়াদে চাকরি নিয়ে সিঙ্গাপুরে এসেছিলেন বাংলাদেশের জাকির ব্যাপারি। কাজ নিয়েছিলেন এক নির্মাণ কারখানায়। কিন্তু চাকরির মেয়াদ শেষ হবার আগেই ২০১২ সালের আগস্ট মাসে ‘প্রত্যাবর্তন কোম্পানি’র অফিসে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়। বিনা পারিশ্রমিকে অতিরিক্ত পরিশ্রমে রাজি না হওয়ায় জাকিরকে কাজে রাখতে চায়নি মালিকপক্ষ। এরপর মালিকের যোগসাজশে কোন কারণ ছাড়াই প্রত্যাবর্তন কোম্পানি জাকিরকে সিঙ্গাপুর ছাড়তে চাপ দেয়।
জাকিরকে বদ্ধ রুমে আটক রাখা হয়। ‘মালিকের কাছে কোন পাওনা নেই’ লিখিত কাগজে স্বাক্ষর নিতে জবরদস্তি চালায় দুবৃর্ত্তরা। এতে প্রত্যাবর্তন সহজে হবে বিধায় জাকির স্বাক্ষর করেনি। এরপর তার গলায় ছুরি ধরা হয়।
তবে ভাগ্য ভালো। এ সময় জাকির তার এক বন্ধুকে ডাকতে সক্ষম হয়। ওই বন্ধু দ্রুত সেখানে আসেন এবং অভিবাসী অধিকার কর্মী জোলোভান হোয়ামের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। জাকির পালাবে না কিংবা পালালে ওই বন্ডের জন্য হোয়াম দায়ী থাকবেন মর্মে আন্ডারটোকেন দেয়ার পর জাকির এবারের যাত্রায় রক্ষা পান। জাকির বর্তমানে তার এক বন্ধুর বাসায় আছেন এবং তার আবেদনের মামলা চলছে।
এদিকে জাকির জানিয়েছেন, যে এজেন্ট তাকে সিঙ্গাপুরে পাঠিয়েছে তাদের ৯ হাজার সিঙ্গাপুরি ডলার ঋণ শোধ করতে তিনি সিঙ্গাপুরে কাজ করতে চান। তিনি এপিকে বলেন, ‘আমার বাবা অসুস্থ, তিনি কোন কাজ করতে পারেন না। বাড়িতে আর টাকা না পাঠাতে পারায় আমার ছোট দুই ভাইয়ের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে। এ সময় আমি তাদের ফোনও করতে পারিনি। তারা এখন কী করছে তা নিয়ে আমি শঙ্কিত।’
জাকিরের মামলা দেখভাল করছে সিঙ্গাপুরের সর্ববৃহৎ প্রত্যাবর্তন কোম্পানি ইউটিআর। এক ই-মেইল বার্তায় কোম্পানির প্রধান জে. রাভি এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি এটিকে মনগড়া বলে আখ্যা দিয়েছেন।
তিনি দাবি করেন, আমরা শ্রমিকদের দেশে ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে ভালো সর্ম্পক বজায় রাখি। বাস্তবে অনেক শ্রমিক যারা সিঙ্গাপুরে ফেরত এসেছেন তারা নিজেরাই আমাদের অফিসে আসে। যখন কোন শ্রমিক ফেরত যেতে অস্বীকৃতি জানান তখন প্রথমেই আমরা এর কারণ খুঁজে বের করি। যখন কারণ যুক্তিযুক্ত হয় তখন আমরা নিয়োগদাতা কোম্পানিকে তার চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর জন্য সুপারিশ করি। গত বছর ১২০০ শ্রমিককে তারা দেশে পাঠিয়েছি। এজন্য কোম্পানিগুলো শ্রমিকপ্রতি ২৫০ থেকে ৩৫০ সিঙ্গাপুরি ডলার দিয়ে থাকে।
এদিকে সিঙ্গাপুরের অভিবাসন মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, জাকিরের মামলাটি বর্তমানে পুলিশ দেখছে। প্রত্যাবর্তন কোম্পানি শ্রমিক আইন মানতে বাধ্য বলে জানিয়েছে তারা।
প্রসঙ্গত, চাকরির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে সিঙ্গাপুর আর রাখতে চায় না। এবং শ্রমিকরা না গেলে জরিমানা করে। এনিয়ে দেশটিতে ‘প্রত্যাবর্তন কোম্পানি’র এক বাজার তৈরি হয়েছে।
দেশটির আইন অনুযায়ী, অভিবাসী শ্রমিকরা সিঙ্গাপুর ছাড়ার সময় কেটে রাখা ৫ হাজার সিঙ্গাপুরি ডলার পাবেন। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, নিয়োগদাতারা এটা অনেক সময় মানেন না এবং এক্ষেত্রে প্রত্যাবর্তন কোম্পানিগুলোকে ব্যবহার করেন।
সিঙ্গাপুরে বর্তমানে ৫০ লাখ ৩০ হাজার অভিবাসীর মধ্যে ১০ লাখ ১০ হাজারই অভিবাসী শ্রমিক। নিম্নমানের মজুরিতে এখানে উন্নয়নশীল দেশ বিশেষত বাংলাদেশ, ভারত ও চীনের নাগরিকরা আসেন। আন্তর্জাতিক সুনাম বৃদ্ধি ও উন্নতির চরম পর্যায়ে নিয়ে যাবার পরও দেশটিতে শ্রমিকদের নির্যাতন, শোষণ ও হুমকির ঘটনা ঘটছে। এর প্রতিবাদে গতবছরের ডিসেম্বরে দেশটির ৪০ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো শ্রমিক বিক্ষোভ হয়। তবে কঠোর নিয়ন্ত্রণাধীন দ্বীপরাষ্ট্রটিতে প্রত্যাবর্তন কোম্পানির কার্যক্রম অভিবাসীদের জন্য বড় হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে।