সাড়ে ৪১ হাজার কোটি টাকার নতুন করের বোঝা
সাড়ে ৪১ হাজার কোটি টাকার নতুন করের বোঝা
সাড়ে ৪১ হাজার কোটি টাকারো বেশি নতুন করের বোঝা চাপল! চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে কর থেকে প্রাপ্তি ধরা হয়েছে এক লাখ ৪০ হাজার ৬৭৬ কোটি টাকা। আর আগামী অর্থবছরের বাজেটে কর খাত থেকে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলো এক লাখ ৮২ হাজার ২৪৪ কোটি টাকা। ফলে আগামী অর্থবছরে এই খাত থেকেই অতিরিক্ত ৪১ হাজার ৫৬৮ কোটি টাকা আদায় করতে হবে। শুধু কর খাত থেকেই ৩০ শতাংশ অর্থ বেশি আদায় করতে হবে। আর সেটি করা হবে জনগণের ওপর বর্ধিত করের বোঝা চাপিয়ে।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে তার ভাষায় ‘উচ্চাভিলাষী’ কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দিয়ে আগামী ২০১৫-১৬ অর্থবছরের প্রায় তিন লাখ কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেটটি জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেন। অর্জন করা যাবে কী যাবে না, তার কোনো বালাই নেই, বর্ষীয়ান এই অর্থমন্ত্রী বাজেটে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন অসংখ্য; কিন্তু বাস্তবে তা অর্জন করা হবে কঠিন। এক কথায় বলা যায়, বাজেটে ‘লক্ষ্য বিস্তর, অর্জন কঠিন’। সংসদে উপস্থাপনের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে বাজেটটি অনুমোদন করে নেয়া হয়।
লক্ষ্য বিস্তর, অর্জন কঠিন
সাদা পাজামার সাথে ঘিয়ে রঙের সিল্কের পাঞ্জাবির ওপর মুজিব কোর্ট চাপিয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বেলা সাড়ে ৩টায় সংসদে বাজেট বক্তব্য শুরু করেন। ‘সমৃদ্ধির সোপানে বাংলাদেশ-উচ্চপ্রবৃদ্ধির পথ রচনা’ শীর্ষক সবুজ রঙের প্রচ্ছদে মোড়া বাজেট বক্তৃতায় পৃষ্ঠা সংখ্যা রয়েছে ১২৮। আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার নির্ধারণ করা হয়েছে দুই লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে যা রয়েছে দুই লাখ ৩৯ হাজার ৬৬৮ কোটি টাকা। প্রস্তাবিত বাজেটে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে দুই লাখ আট হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা। ফলে ব্যয় ও আয়ের ফারাক থাকছে ৮৬ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা।
বাজেট ঘাটতি হিসাবে বিবেচিত এই ফারাক মেটানোর জন্য আগামী অর্থবছরে সরকারকে মূল ভরসা করতে হবে তিনটি খাতের ওপর। এগুলো হলো : ব্যাংক ঋণ, বিদেশী সহায়তা ও সঞ্চয়পত্র। বেসরকারি খাত ঋণ পাক বা না পাক, বাজেট ঘাটতি মেটানোর জন্য সরকার আগামী অর্থবছরে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে ৩৮ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে যা ছিল ৩১ হাজার ৭১৪ কোটি টাকা। প্রস্তাবিত বাজেটে বিদেশী ঋণ প্রাক্কলন করা হয়েছে ৩২ হাজার ২৩৯ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে যা রয়েছে ২৩ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা। আর আগামীতে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৮ হাজার কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে যা রয়েছে ২১ হাজার কোটি টাকা।
উচ্চাভিলাষী রাজস্ব আদায়ের টার্গেট
অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় উল্লেখ করেছেন, ‘এবারে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা হলো দুই লাখ আট হাজার ৭৭০ কোটি টাকা এবং তাতে রাজস্ব বোর্ডের হিস্যা হলো এক লাখ ৭৬ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। এই অর্থ আদায় হবে চারটি সূত্রে আয়কর, মূসক, সম্পূরক শুল্ক এবং আমদানি শুল্ক খাত থেকে। বর্তমান বছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এই আদায়ের হার হবে ৩০.৬২ শতাংশ বেশি, সত্যিই উচ্চাভিলাষী। কিন্তু গত ছয় বছরে রাজস্ব বোর্ডের জনবল ও দফতর বেড়েছে ব্যাপকভাবে এবং তারা একটি বছরে আদায়ে প্রবৃদ্ধি ২০ শতাংশের বেশি করতে সক্ষম হয়েছেন। এবারে তাদের চ্যালেঞ্জ হলো ৩০.৬২ শতাংশ হারে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি। আয়কর বিভাগ এবার ৮৫টি উপজেলায় কাজ করতে পারবেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের দক্ষতা অনেক উন্নীত হয়েছে বলে আমার মনে হয়।’
বাজেটের প্রকৃত আকার কত?
আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের প্রকৃত আকার কত? এই নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এটি কী দুই লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা। না-কি, দুই লাখ ৯৯ হাজার ৯৬ কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রীর ভাষায় ‘২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাজেটের মোট ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে দুই লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা (জিডিপির ১৭.২ শতাংশ)। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলোর প্রায় তিন হাজার ৯৯৬ কোটি টাকা বরাদ্দ বিবেচনায় নিলে বাজেটের আকার দাঁড়াবে প্রায় তিন লাখ কোটি টাকা।’ কেন তিন লাখ কোটি টাকার বাজেট বলা হলো না। কারণ একটাই, বাজেট ঘাটতিকে জিডিপির ৫ শতাংশের ঘরে রাখতেই হবে। বাজেটের আকার তিন লাখ কোটি টাকা দেখানো হলে এই ঘাটতি ৫ শতাংশের ঘর ছাড়িয়ে যেত। চুপি চুপি অনেকে এই ঘটনাটিকে সংখ্যাতত্ত্বের ‘কারসাজি’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
প্রবৃদ্ধি কমিয়ে ধরা হলো
এবারই প্রথমবারের মতো বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমিয়ে ধরা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি যেখানে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছিল, সেখানে আগামী বাজেটে তা করা হয়েছে ৭ শতাংশ।
মূল্যস্ফীতি
অর্থমন্ত্রী বলেছেন,‘আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলসহ পণ্যমূল্য হ্রাস, সন্তোষজনক কৃষি উৎপাদন, অভ্যন্তরীণ সরবরাহ পরিস্থিতির ধারাবাহিক উন্নয়ন ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সতর্ক মুদ্রানীতির প্রভাবে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি আরো কমে আসবে বলে আমি মনে করি। তাই মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ৬.২ শতাংশ নির্ধারণ করেছি।’
করদাতার সংখ্যা ৩০ লাখে উন্নীত করার টার্গেট
অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন,‘আগামী বছরে সম্পদ কর নিয়ে নতুন উদ্যোগ নেয়া হবে। দেশের সবচেয়ে সচ্ছল গোষ্ঠীতে আছে মোবাইল, তামাক ও ব্যাংকিং খাতের কর্ণধার এবং শিল্পপতি ও বড় ব্যবসায়ীরা। আয়কর ও করপোরেট কর তারাই দিয়ে থাকেন। দেখা যাচ্ছে যে, এ দেশে সবচেয়ে কম কর দেয় তামাক বা সিগারেট শিল্প, অথচ এই শিল্প জনস্বাস্থ্যের ব্যাপক ক্ষতি করে। উন্নত প্রযুক্তির ফসল হিসেবে মোবাইল ব্যবসার লাভ খুব উল্লেখযোগ্য।’
পোশাক শিল্প বড় ধনী সৃষ্টি করেছে
অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমাদের পোশাক শিল্পও অনেক বড় বড় ধনী সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশে আয়কর দেন সামান্য কিছু ব্যক্তি, ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে কম বেশি ১২ লাখ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। কিছু দিন আগে রাজস্ব বোর্ড কয়েকটি এলাকায় জরিপ চালিয়ে অনেক সচ্ছল লোকের সন্ধান পেয়েছে। এদের সবার ওপর এই বছর আয় বা করপোরেট কর ধার্য করা হবে। এরকম জরিপ ভবিষ্যতে আরো চলবে এবং এভাবে করদাতার সংখ্যা বৃদ্ধির উদ্যোগ অব্যাহত থাকবে। আমাদের লক্ষ্য হলো, আমাদের এই মেয়াদের শেষবছর ২০১৮-১৯ সালে সক্রিয় করদাতার সংখ্যা ৩০ লাখে উন্নীত করতে হবে।’
উৎসে আয়কর আদায়ে স্বতন্ত্র কর অঞ্চল গঠন
বর্তমানে উৎসে আয়কর (এআইটি) থেকেই আয়করের বেশির ভাগ আদায় হয়। উৎসে আয়কর কর্তনের জন্য একটি স্বতন্ত্র কর অঞ্চল গঠনের চিন্তাভাবনা চলছে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।
করদাতার সবার ক্ষেত্রে ন্যূনতম কর ৪ হাজার টাকা
বর্তমান আইনে সিটি করপোরেশন, জেলা সদরের পৌরসভা এবং অন্যান্য এলাকার কোম্পানি করদাতা ছাড়া অন্য করদাতাদের তিন হাজার, দুই হাজার ও এক হাজার টাকা ন্যূনতম কর পরিশোধ করতে হয়। আগামী অর্থবছর থেকে বিদ্যমান অঞ্চলভিত্তিক ন্যূনতম করহার প্রয়োগের পরিবর্তে এসব করদাতার অঞ্চলভিত্তিক অবস্থান নির্বিশেষে ন্যূনতম করের হার চার হাজার টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
সিগারেট ব্যবসার কর
সিগারেটের ক্ষতিকারক দিক বিবেচনার পাশাপাশি রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির লক্ষ্যে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি, প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানিসহ সিগারেট উৎপাদন ও বিক্রয় ব্যবসায় নিয়োজিত অন্যান্য সব করদাতা ব্যক্তি, অংশীদারি ফার্ম ইত্যাদির ওপর ৪৫ শতাংশ হারে একটি একক করহার ধার্য করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
সমবায় সমিতির ওপর করারোপ
বিদ্যমান বিধানে কো-অপারেটিভ সোসাইটির কোনো পৃথক করহার নেই। বাজেটে কৃষি ও কুটিরশিল্প সংশ্লিষ্ট খাত ছাড়া কো-অপারেটিভ সোসাইটির অন্যান্য আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ হারে করারোপের প্রস্তাব করা হয়েছে।
অবৈধভাবে বিদেশী নিয়োগ দিলেই জরিমানা
যারা এখন থেকে অবৈধভাবে কোনো প্রতিষ্ঠানে বিদেশীদের কাজে নিয়োগ দেবেন সেই সব প্রতিষ্ঠানের ওপর প্রদেয় আয়করের ৫০ শতাংশ বা পাঁচ লাখ টাকা (যেটা বেশি) অতিরিক্ত কর আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, একই সাথে ওই প্রতিষ্ঠানের সবরকম কর সুবিধা প্রত্যাহার করা হবে এবং এসব দুর্জনকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের লক্ষ্যে জেল ও জরিমানাও করা হবে।
মোবাইলে কথার ওপর সম্পূরক শুল্ক আরোপ
বাজেটে মোবাইলের সিম বা রিম কার্ডের মাধ্যমে প্রদত্ত সেবার ওপর ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। ইতোমধ্যে মোবাইলে কথা বলার ওপর ১৫ শতাংশ মূসক ধার্য রয়েছে। এখন আবার নতুন করে ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করার কারণে এ খাতে মোট কর ভার দাঁড়াল ২০ শতাংশ। অর্থাৎ কেউ ১০ টাকার কথা বললে মোট দুই টাকার কর দিতে হবে।
অর্থমন্ত্রীর ‘অশোধনীয় আশাবাদ’
অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতার শেষ প্যারায় বলেছেন, শত প্রতিকূলতা, বাধা-বিপত্তি, বৈরিতা এবং এক ধরনের নির্বোধ দেশশত্রুতার মধ্যেও এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। সব প্রতিবন্ধকতা তুচ্ছ করে আমাদের কর্মঠ, কষ্টসহিষ্ণু, সাহসী ও প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা সাধারণ জনগণ তাদের শ্রম, মেধা, প্রজ্ঞা ও আন্তরিকতা দিয়ে এই অগ্রগতির চাকা সচল রেখেছেন। আমার দৃঢ়বিশ্বাস, আমাদের এই অগ্রযাত্রা থাকবে নিয়ত সঞ্চারণশীল। আমি বরাবরই এ দেশের অপরিমেয় সম্ভাবনা নিয়ে আশাবাদী। আবারও পুনরাবৃত্তি করবো যে, আমি অশোধনীয় আশাবাদী। ’ এখন সময়ই বলে দেবে অর্থমন্ত্রীর এই ‘অশোধনীয় আশাবাদ’ কতটা বাস্তবে রূপ নেয়?
– See more at: http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/27966#sthash.Td9ihE6N.dpuf