সারাদেশে বৃষ্টি অব্যাহত ॥ তিন নম্বর সতর্ক সঙ্কেত
স্টাফ রিপোর্টার ॥ দু’দিনের অব্যাহত বৃষ্টিতে দুর্ভোগে পড়েছে দেশবাসী। স্বাভাবিক জীবন যাপন হয়েছে ব্যাহত। অবিরাম বর্ষণে উপকূলীয় এলাকার বেড়িবাঁধ হুমকির সম্মুখীন। বাগেরহাটের ২৫টি গ্রাম প্লাবিত। মংলা বন্দরে পণ্য বোঝাই খালাস কাজ মারাত্মক ব্যাহত হচ্ছে। বন্দরে অবস্থানরত সার, গম ও ক্লিংকারবাহী জাহাজের পণ্য খালাস কাজ বন্ধ থাকে । কলাপাড়ায় শত শত একর আমন ধানের ক্ষেত তলিয়ে গেছে। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট গভীর সঞ্চালনশীল মেঘমালার কারণে শনিবার ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মংলা উপকূলীয় অঞ্চলে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া বিরাজ করছিল। সমুদ্র বন্দরসমূহকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সঙ্কেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। আগামী দু’দিনে আবহাওয়ার সামান্য পরিবর্তন আসতে পারে। আর আগামী ৫ দিনের মধ্যে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যেতে পারে। থেমে থেমে পড়তে থাকে ঝিরঝির বৃষ্টি।
আবহাওয়া অধিদফতর জানায়, উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারসমূহকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত উপকূলের কাছাকাছি থেকে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে। আজ রবিবারও ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় এবং রংপুর বিভাগের অনেক জায়গায় অস্থায়ী দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারি থেকে ভারি বর্ষণের সম্ভাবনা রয়েছে।
গত দু’দিন ধরে রাজধানীসহ সারাদেশে বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। শনিবার ময়মনসিংহে ৩ মিলিমিটার, ফরিদপুরে ৪ মিমি, মাদারীপুরে ১২ মিমি, চট্টগ্রামে ৩৫ মিমি, সন্দ্বীপে ৩৫ মিমি, সীতাকু-ে ১৫ মিমি, রাঙ্গামাটিতে ৮ মিমি, কুমিল্লায় ৮ মিমি, চাঁদপুরে ১৫ মিমি, মাইজদীকোর্টে ২১ মিমি, ফেনীতে ১৭ মিমি, হাতিয়ায় ৬০ মিমি, কক্সবাজারে ৫৮ মিমি, কুতুবদিয়ায় ৩২ মিমি, টেকনাফে ১৭ মিমি, সিলেটে ৫ মিমি, শ্রীমঙ্গলে ১ মিমি, খুলনায় ৫ মিমি, সাতক্ষীরায় ৫ মিমি, যশোরে ১৪ মিমি, চুয়াডাঙ্গায় ৬ মিমি, বরিশালে ৬১ মিমি, পটুয়াখালীতে ৭০ মিমি, খেপুপাড়ায় ৭৪ মিমি ও ভোলায় ৪৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়।
স্টাফ রিপোর্টার, খুলনা অফিস থেকে জানান, খুলনায় বৃষ্টিতে জনজীবন স্থবির হয়ে পড়েছে। শ্রমজীবী মানুষ চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। অবিরাম বর্ষণে উপকূলীয় এলাকার বেড়িবাঁধ হুমকির সম্মুখীন। শুক্রবার সকাল থেকে শুরু হওয়া বৃষ্টি শনিবার দিনভর বিরামহীনভাবে হতে থাকে। কখনও মাঝারি, কখনও ভারি কখনও টিপ টিপ বৃষ্টি হয়। এতে নগরীর জীবনযাত্রা থমকে যায়। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া লোকজন তেমন ঘর থেকে বের হয় না। রাস্তাঘাটে যানবাহন চলাচল এবং পথচারীদের চলাফেরা অস্বাভাবিক কম দেখা যায়। বৃষ্টির জন্য সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগের শিকার হয় শ্রমজীবী মানুষ। বিশেষ করে দিনমজুর, রিকশা চালক এবং খোলা জায়গায় বসা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। শ্রমজীবী অধিকাংশ মানুষ কাজ করতে না পারায় তারা আর্থিক দুরাবস্থার মধ্যে পড়েছে। খুলনা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আমিরুল আজাদ জানান, শনিবার সকাল ৬টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত খুলনা অঞ্চলে ৪৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। চলতি অক্টোবর মাসের ২৫ তারিখ পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হয়েছে ২৪৪ মিলিমিটার। এদিকে অবিরাম বর্ষণে খুলনার দাকোপ উপজেলার বিভিন্ন স্থানের বেড়িবাঁধ মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। স্থানীয়রা জানান, দাকোপের সুতারখালী ইউনিয়নের তেলিরকোনা, কালাবগী, গোনারী, তিলডাংগা ইউনিয়নের বটবুনিয়া বাজার, ঝালবুনিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে বেড়িবাঁধ খুব ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। যে কোন সময় বাঁধের যে কোন স্থান ভেঙ্গে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হতে পারে বলে এলাকাবাসী আশঙ্কা করছে।
নিজস্ব সংবাদদাতা, বাগেরহাট থেকে জানান, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট গভীর মেঘমালার কারণে শুক্রবার রাত থেকে বাগেরহাটেসহ সুন্দরবন উপকূলে অবিরাম বৃষ্টিপাত ও মাঝে মাঝে দমকা হাওয়া বইছে। সাগর প্রচন্ড উত্তাল থাকায় মাছ ধরা নৌকা ও ট্রলারগুলো সুন্দরবনের খাল ও নদীতে নিরাপদে আশ্রয় নিয়েছে। শনিবার টানা বৃষ্টিপাতে রাস্তাঘাট প্রায় জনশূন্য ও শহরের অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। তলিয়ে গেছে শহরের রাস্তাঘাট নিম্নাঞ্চল। যানবাহনও চলছে না। মোরেলগঞ্জ, মংলা ও বাগেরহাট পৌরসভা প্রায় সকল বস্তিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। দুর্ভোগে পড়েছে খেটে খাওয়া দিনমজুররা। মংলা সমুদ্রবন্দরকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কতা সঙ্কেত দিয়েছে আবহাওয়া অফিস। এ কারণে মংলাবন্দরে পণ্য বোঝাই-খালাস কাজ মারাত্মক ব্যাহত হচ্ছে। বন্দরে অবস্থানরত সার, গম ও ক্লিংকারবাহী জাহাজের পণ্য খালাস কাজ বন্ধ রয়েছে। বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ, খাউলিয়া, কুমারখালী, সন্ন্যাসী, পাঠামার, বদনীভাঙ্গা, কালিকাবাড়ি, শ্রেনীখালী, বহরবুনিয়া, শোনাখালী, পঞ্চকরণ, হেড়মা, তেলীগাতি, ফুলহাতাসহ কমপক্ষে ২৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
নিজস্ব সংবাদদাতা, কলাপাড়া থেকে জানান, সাগরপাড়ের জনপদ কলাপাড়ায় দু’দিনের টানা বৃষ্টিতে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে উঠেছে। শনিবার সকাল থেকে হচ্ছে ভারি বৃষ্টিপাত। একই সঙ্গে থেমে থেমে মৃদু দমকা ঝড়ো হাওয়া বইছে। টানা বৃষ্টিতে বড় ধরনের ঝড়ো হাওয়ার শঙ্কায় কৃষকরা উদ্বিগ্ন। কলাপাড়া ঝড় সতর্কীকরণ কেন্দ্রসূত্রে (রাডার স্টেশন) জানা গেছে, শনিবার সকাল ছয়টা থেকে বিকেল তিনটা পর্যন্ত এখানে ৭৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচটায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। বিভিন্ন ইউনিয়নে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইতোমধ্যে নিচু এলাকার হাজার হাজার আমনচারা পানিতে তলিয়ে গেছে।
সংবাদদাতা, আমতলী থেকে জানান, গত দু’দিন অবিরাম বর্ষণে আমতলী ও তালতলীর জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বিরামহীন বর্ষণে দিন ও ক্ষেতমজুরা কোন কাজ করতে পারছে না। বিভিন্ন স্থানে আমন ক্ষেতে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। মাঠ ঘাট তলিয়ে গেছে। জানা গেছে, উপজেলার আঠারোগাছিয়া, কুকুয়া, হলদিয়া, চাওড়া, আমতলী, আরপাঙ্গাশিয়া, কড়াইবাড়িয়া, শারিকখালী, ছোটবগী ও বড়বগী ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে জলাবদ্ধতায় আমন ধানের ক্ষেত তলিয়ে গেছে। গাবতলী গ্রামের মোঃ রমজান মিয়া জানান, এ বৃষ্টি আমন ধানের ব্যাপক ক্ষতি করবে। খেপুপাড়া আবহওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে শুক্রবার সকাল ৬ টা থেকে শনিবার সকাল ৯টা পর্যন্ত ১৯ মিলি মিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আমতলী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শাহ আলম মিয়া জানান, এ বৃষ্টিতে আমন ধানের ক্ষেতে বড় ধরনের ক্ষতি হবে না।
নিজস্ব সংবাদদাতা, গৌরনদী থেকে জানান, বরিশালে গত তিনদিনের টানা বর্ষণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। সবশেষ শনিবার ভোর ৬টা থেকে শুরু হওয়া বৃষ্টি দিনভর অব্যহত রয়েছে। ফলে বরিশাল নগরীর প্রাণকেন্দ্র সদর রোড, গীর্জা মহল্লা, ফজলুল হক এ্যাভিনিউ ও কাউনিয়া এলাকার প্রধান সড়কে হাঁটু সমান পানি জমে তীব্র জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছে স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থীরা। বেলা ১২টার দিকে নগরীর কাউনিয়া এলাকার মনষাবাড়ী রোডে একটি রিকশা ড্রেনে পড়ে চালকসহ তিনজন স্কুলছাত্রী আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। বরিশাল আবহাওয়া অফিসের সিনিয়র অবজারভার আব্দুল মফিজুল ইসলাম জানান, সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত ৩৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। তবে বাতাসের গতিবেগ স্বাভাবিক রয়েছে। তিনি জানান অপরদিকে টানা বর্ষণের কারণে বরিশাল-ঢাকা মহাসড়কের গৌরনদী বাসস্ট্যান্ডে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়ে যানবাহন ও পথচারীদের চলাচলে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
নিজস্ব সংবাদদাতা, ঝালকাঠি থেকে জানান, ঝালকাঠিতে শুক্রবার মধ্যরাত থেকে শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত মাঝারি ধরনের টানা বৃষ্টিপাত চলছিল। অসময়ে এ বৃষ্টিপাতের কারণে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়েছে। এ বৈরী আবহাওয়ার ফলে শনিবার স্কুল কলেজে ছাত্রছাত্রীর উপস্থিতি খুব কম ছিল। কৃষি বিভাগের একটি সূত্রে দাবি করা হয়েছে, জেলায় উচ্চ ফলনশীল জাতের আমন ধানের শীষ বের হচ্ছে এবং রাতে বৃষ্টিপাতের কারণে এ ফলনের কিছু অংশ চিটে হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে আমন ফসলের স্থানীয় জাতের ধানের শীষ বের না হওয়ায় এ বৃষ্টিপাত এই জাতের ধানের জন্য বিকল্প সার হিসেবে কাজ করছে।