সাকা চৌধুরীর ফাঁসির আদেশ
প্রতিবেদক : বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য, সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায়ে ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আদালত। এ রায়ে সাকার বিরুদ্ধে আনা ২৩ টি অভিযোগের মধ্যে গণহত্যাসহ ৯টি অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। তার বিরুদ্ধে ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ৮, ১৭ ও ১৮ নং অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। অন্য অভিযোগগুলো প্রমাণিত হয়নি।
মঙ্গলবার দুপুরে এ রায় ঘোষণা করেন আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান এটিএম ফজলে কবীর। এই প্রথম কোনো সংসদ সদস্য ও বিএনপি নেতার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় ঘোষণা হল।
এর আগে মঙ্গলবার সকাল ১০টা ৪২ মিনিটে এজলাসে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর উপস্থিতিতে রায় পড়া শুরু করেন ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারপতি আনোয়ারুল হক। মূল রায় ১৭২ পৃষ্ঠার। এর আগে ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর সূচনা বক্তব্য দেন। এরপর তিনি বিচারপতি আনোয়ারুল হককে রায় পড়ার জন্য বলেন। রায় পাঠ শুরুর আগে ট্রাইব্যুনালের জেলখানা থেকে সাকা চৌধুরীকে এজলাসে আনা হয়।
বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীরের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১ সোমবার রায়ের জন্য এই দিন ধার্য করেন। এ রায়কে কেন্দ্র করে যে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি মোকাবিলায় সোমবার থেকেই সুপ্রিমকোর্ট এলাকায় অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পুলিশ মোতায়েন করা হয়।
সাকার বিরুদ্ধে প্রমাণিত ২নং অভিযোগে বলা হয়েছে-১৩ এপ্রিল সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর নেতৃত্বে পাকিস্তানি সৈন্যরা গহিরা গ্রামে হিন্দু অধ্যুষিত পাড়ায় অভিযান চালিয়ে হিন্দুদের ডাক্তার মাখন লাল শর্মার বাড়িতে জড়ো করা হয়। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর উপস্থিতিতে পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে।
অভিযোগ-০৩-এ বলা হয়েছে, ১৩ এপ্রিল সকাল ৯টার দিকে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর নির্দেশে পাকিস্তানি সৈন্যরা গহিরা শ্রী কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা মালিক নূতন চন্দ্র সিংহকে ব্রাশফায়ার করে। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী নিজে তাকে গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করেন।
অভিযোগ-০৪-এ বলা হয়েছে, ১৩ এপ্রিল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে নিয়ে হিন্দু অধ্যুষিত জগত্মল্লপাড়ায় অভিযান চালান। এ সময় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর দুই সহযোগীর আহবানে সেখানকার হিন্দু নর-নারীরা কিরণ বিকাশ চৌধুরীর বাড়ির আঙিনায় জড়ো হয়। সেখানে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর উপস্থিতিতে তাদের ওপর গুলিবর্ষণ করা হয়। এতে ৩২ নারী-পুরুষ মারা যান।
অভিযোগ-০৫ -এ বলা হয়েছে ১৩ এপ্রিল বেলা একটার দিকে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী তার অনুসারীদের নিয়ে চট্টগ্রাম জেলার রাউজানের সুলতানপুর গ্রামে হামলা চালান। সেনা সদস্যরা বণিকপাড়ায় প্রবেশ করে ধর্মীয় বিদ্বেষপ্রসূত হয়ে অভিযান চালিয়ে নেপাল চন্দ্র ধর, মনীন্দ্র লাল ধর, উপেন্দ্র লাল ধর ও অনিল বরণ ধরকে গুলি করে। এতে প্রথম ৩ জন শহীদ ও শেষের জন আহত হন। হত্যাকাণ্ড শেষে বাড়িঘরে আগুন দিয়ে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও তার বাবা ফজলুল কাদের চৌধুরী তাদের অনুসারী ও পাকিস্তানি সৈন্যদের সুলতানপুর গ্রাম ত্যাগ করেন।
অভিযোগ-০৬ এ বলা হয়েছে, ১৩ এপ্রিল বিকেল ৪টায় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর উপস্থিতিতে রাউজানের ঊনসত্তরপাড়ায় ক্ষিতীশ মহাজনের বাড়ির পেছনে পুকুর পাড়ে শান্তি মিটিংয়ের নামে হিন্দু নর-নারীদের একত্রিত করে পাকিস্তানি সৈন্যরা ব্রাশফায়ারে হত্যা করে।
অভিযোগ-০৭ -এ বলা হয়েছে, ১৪ এপ্রিল দুপুর ১২টার দিকে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর নির্দেশে পাকিস্তানি সৈন্যরা রাউজান পৌরসভার সতীশ চন্দ্র পালিতের বাড়িতে প্রবেশ করে তাকে গুলি করে হত্যা করে এবং তার লাশ কাঁথাকাপড় দিয়ে মুড়িয়ে তাতে পাউডার ছিটিয়ে আগুন দিয়ে লাশ পুড়িয়ে ফেলে।
অভিযোগ-০৮ এ বলা হয়েছে, ১৭ এপ্রিল সকাল আনুমানিক ১১টার দিকে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মোজাফফর আহম্মদ ও তার ছেলে শেখ আলমগীরসহ তার পরিবারের কয়েকজন সদস্য প্রাইভেটকারযোগে চট্টগ্রামের রাউজান থেকে চট্টগ্রাম শহরে আসছিলেন। পথে হাটহাজারী থানার খাগড়াছড়ি-রাঙ্গামাটি তিন রাস্তার মোড়ে পৌঁছামাত্র সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সঙ্গে থাকা পাকিস্তানি সৈন্যরা শেখ মোজাফফর আহম্মেদ ও তার ছেলে শেখ আলমগীরকে গাড়ি থেকে নামিয়ে স্থানীয় পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখান থেকে তাদের আর উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
অভিযোগ-১৭ এ বলা হয়েছে, ৫ জুলাই সন্ধ্যা রাতে চট্টগ্রাম জেলার কোতোয়ালি থানার হাজারী লেনের জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর পোড়োবাড়ি থেকে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক নিজাম উদ্দিন আহম্মেদ, সিরাজ ও ওয়াহেদ ওরফে ঝুনু পাগলাকে অপহরণ করে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর গুডসহিলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে মেজর গজনফরের নেতৃত্বে ঘণ্টা দেড়েক তাদের ওপর নির্যাতন করা হয়। পরে ওইদিন রাত ১১/১২টায় নিজাম উদ্দিন ও সিরাজকে চট্টগ্রাম কারাগারে নিয়ে গিয়ে কারারুদ্ধ করা হয়। সেখানে তারা দেশ স্বাধীন হওয়ায় আগ পর্যন্ত বন্দী ছিলেন।
অভিযোগ-১৮ -এ বলা হয়েছে, জুলাই মাসের তৃতীয় সপ্তাহে একদিন ভোর সাড়ে ৫টার দিকে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বাবা ফজলুল কাদের চৌধুরীর অনুসারীরা চট্টগ্রাম জেলার চান্দগাঁও থানার মোহারা গ্রামে আব্দুল মোতালেব চৌধুরীর বাড়িতে যান। সেখানে গিয়ে তারা সালেহউদ্দিনকে অপহরণ করেন। এরপর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গাড়িতে নিয়ে তাকে গুডসহিলে টর্চার সেলে নেওয়া হয়। বাড়ির বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসে থাকা সাকা চৌধুরীর বাবা ফজলুল কাদের চৌধুরী এবং ছোট ভাই গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীও উপস্থিত ছিলেন। ওই সময় সালেহউদ্দিনকে উদ্দেশ করে ফজলুল কাদের চৌধুরী জানতে চান, তিনি সালেহউদ্দিন কিনা। এ কথা বলতে বলতে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এগিয়ে গিয়ে সালেহউদ্দিনের বাম গালে সজোরে একটি চড় মারেন।