সাকার রায় ফাঁসে আইনজীবী ব্যারিস্টার ফখরুল জড়িত
নিজস্ব প্রতিবেদক: বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মামলার রায়ের খসড়া ফাঁস হওয়া নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের অস্থায়ী কর্মচারী নয়ন আলী আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।বৃহস্পতিবার ঢাকা মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট তারেক মঈনুল ইসলাম ভূইয়ার কাছে তিনি ওই জবানবন্দি দেন।
জবানবন্দিতে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আইনজীবী ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম, সাকা চৌধুরীর ম্যানেজার ও ২ নম্বর ট্রাইব্যুনালের অফিস সহকারী ফারুক আহমেদ জড়িত বলে প্রকাশ পেয়েছে।
স্বীকারোক্তিতে তিনি জানিয়েছেন, তাদের মধ্যে কথা বলার গোপনীয়তা রক্ষার জন্য ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম নিজ হাতে তাকে সিমফোনি এক্সপ্লোরার মোবাইল ফোন দিয়েছিলেন।
গত ৫ অক্টোবর নয়ন ও ফারুক আহমেদের ৮ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। নয়ন ৫ দিন রিমান্ড শেষেই স্বীকারোক্তি দিতে রাজি হলে মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ইন্সপেক্টর মোহাম্মাদ শাহজাহান বৃহস্পতিবার স্বীকারোক্তি গ্রহণের জন্য আদালতে আবেদন করেন।
তবে ফারুক স্বীকারোক্তি দিতে রাজি না হওয়ায় তিনি এখনো রিমান্ডে রয়েছেন।
নয়ন স্বীকারোক্তিতে জানিয়েছেন, ২০১২ সালের ২০ এপ্রিল তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে পরিচ্ছন্নকর্মী হিসেবে যোগ দেন। তার কাজ আলমারি থেকে মামলাল নথিপত্র এজলাসে নেয়া এবং আনা। তিনি কম্পিউটারও চালাতে পারতেন। তাই ট্রাইব্যুনালে ছোটখাটো কাজ বেঞ্চ অফিসার এবং পিওর কম্পিউটারে বসে মাঝে মধ্যে টাইপ করতেন।
জবানবন্দিতে তিনি আরও বলেছেন, গত ১৯ সেপ্টেম্বরের ৩/৪ দিন আগে ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার অফিসের অফিস সহকারী ফারুক তার কাছে সাকা চৌধুরীর মামলার আদেশের তারিখগুলো চাইলে তিনি জানান মূল ফাইল স্যারের (বিচারপতি) বাসায় তাই কীভাবে দেবো। পরে ফারুক কম্পিউটার থেকে এনে দিতে বলে। নয়ন ওইদিন কম্পিউটার থেকে একশটা আদেশ ও সাকা চৌধুরী নামের ফোলডার বাছাই করে রাখেন। ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলামের জুনিয়র মেহেদী হাসান এবং ফারুক তার ২ দিন পর তাকে খাবার রুমে ডেকে নিয়ে একটি পেনড্রাইভ দিলে তা এনে দেন। ওইদিন রোববার ছিল। ফারুক তখন মেহেদীকে বলেন, ‘টাকা কই?’ মেহেদী বলেন, ‘টাকা আনি নাই।’ তখন ফারুক নিজ পকেট থেকে নয়নকে ৫০০ টাকা দেয়। ওইদিন বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে নয়ন চা খেতে আসলে মেহেদীর সঙ্গে দেখা হয়। কাজ না থাকলে মেহেদী তাকে চেম্বারে যেতে বললে ব্যারিস্টার ফখরুলের কাকরাইলের চেম্বরে যায়। চেম্বারে যাওয়ার পর মেহেদী ব্যারিস্টার ফখরুলের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিলে ব্যারিস্টার ফখরুল ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করে তাকে ৫০০ টাকা দেন।
নয়ন আরও জানান, টাকা দেয়ার পর মেহেদী বাইরে এসে ওইদিন তাকে আরেকটি পেনড্রাইভ দিয়ে বলেন ‘আরেকদিন বাকী আদেশগুলো নিয়ে আসবেন।’ এর ২ দিন পর বেঞ্চ অফিসার গৌরিচন্দ্র তার বেতনের স্ট্রেটমেন্ট টাইপ করতে বলেন। ট্রাইপ করাকালে তিনি দেখতে পান সাকা চৌধুরী নামে যে ফোলডারটি তিনি মেহেদীকে দিয়েছেন তাতে রায়ের কপি আছে।
এরপর ব্যারিস্টার ফখরুলের চেম্বরে গিয়ে মেহেদীকে রায় ডিলেট করতে বলেলে মেহেদী জানায়, ডিলেট করা যাবে না, ফখরুল সাহেব ডিলেট করতে নিষেধ করেছেন। এরপর ব্যারিস্টার ফখরুলের কাছে গেলে সেখানে থাকা সাকা চৌধুরীর ম্যানেজার হুমকি দিয়ে বলেন, ‘রায়ের বাকী অংশ এনে দিবি না দিলে জানে মেরে ফেলবো।’ সঙ্গে ব্যারিস্টার ফখরুলও তাকে হুমকি দেন। পরে তিনি ভয়ে চলে আসেন। এরপর ২২ সেপ্টেম্বর আবার চেম্বারে গেলে মেহেদী তাকে ব্যারিস্টার ফখরুলের কাছে নিয়ে যায়। ব্যারিস্টার ফখরুল তাকে বলেন, ‘নয়ন তুমি তো আমাদের অনেক উপকার করেছো। তোমার কি আনরেজিস্ট্রার্ড সিম আছে?’ আছে জানালে তখন ব্যারিস্টার ফখরুল তাকে একটা সিমফোনি এক্সপ্লোরার মোবাইল ফোন দিয়ে বলেন, ‘ওই সিম এই মোবাইলে ভরে শুধু মেহেদীর সঙ্গে কথা বলবা।’
নয়ন আরও জানায়, এরপরও প্রায় ৪ থেকে ৫ দিন ধরে সাকা চৌধুরীর মামলা নিয়ে যা টাইপ হতো তা তিনি পেনড্রাইভে করে মেহেদীকে ২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দিয়েছেন। ১ অক্টোবর রায়ের দিন বেঞ্চ অফিসারের মুখে শুনতে পান রায় অনলাইনে প্রকাশ হয়ে গেছে। শুনে তিনি মেহেদীকে ফোন দিলে চেম্বারে যেতে বলেন।
চেম্বরের যাওয়ার পর মেহেদী জানায়, সাকা চৌধুরীর ম্যানেজার ও তার পরিবারের লোকজন ওই কপি নিয়ে গেছে। ওরাই হয়তো এটা অনলাইনে দিয়েছে। চিন্তা করতে নিষেধ করে মেহেদী বলেন, ‘ওরা দিয়ে থাকলে ওদের কাছ থেকে তোমাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা এনে দেবো।’ চলে আসার পর বিকেলে মেহেদী তাকে ফোন করে আর যোগাযোগ করতে নিষেধ করেন। সেই সঙ্গে মেরে ফেললেও তাদের নাম বলতে নিষেধ করেন। এরপর বেঞ্চ অফিসার অফিসে ডাকলে সে ঘটনা বলে দেয়।
উল্লেখ্য, গত ৪ অক্টোবর মধ্যরাতে নয়ন আলী ও ফারুক আহমেদকে গ্রেপ্তার ডিবি পুলিশ। নয়ন আলী ওই ট্রাইব্যুনালের মাস্টাররোলের পরিচ্ছন্ন কর্মী এবং ফারুক ২ নম্বর ট্রাইব্যুনালের অফিস সহকারী।