সাংসদ ফজলে রাব্বীর বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ, পাশে নেই আওয়ামী লীগ

21/09/2013 8:58 amViews: 12

image_63939ঢাকা: তিনি সংসদ সদস্য। আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিও। নিজেও আইনজীবী। এত আইন নিয়ে যার নাড়াচাড়া তার বিরুদ্ধেই স্বেচ্ছাচারিতা, সরকারি ত্রাণ ও টাকা আত্মসাতসহ ক্ষমতার অপব্যবহারের বিস্তর অভিযোগ। তিনি গাইবান্ধা-৫ (সাঘাটা-ফুলছড়ি) আসনের সাংসদ ফজলে রাব্বী।
স্থানীয় সূত্র ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানায়, গত প্রায় পাঁচ বছরে নিজ এলাকায় সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের টাকা আত্মসাতের ভয়াবহ অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। একটি মসজিদ নির্মাণের কথা বলে দু-দুবার সরকারি টাকা তুলে লোপাট করেছেন সাংসদ ফজলে রাব্বী। বিশেষ টিআর (টেস্ট রিলিফ), কাবিখা, কাবিটার চাল-গম লুট, ক্ষমতার অপব্যবহার করে স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হস্তক্ষেপ, নিয়োগে স্বজনপ্রীতির তকমা তার পেছনে এমনভাবেই লেগেছে যে, নিজ দলের নেতাকর্মীরাই এখন আর তাকে চান না। তাছাড়া নির্বাচনী এলাকার জনগণও তার ওপর চরম ক্ষুব্ধ।
জানা গেছে, সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই এলাকায় নানা অনিয়ম, দুর্নীতিতে গা ভাসিয়েছেন। এছাড়া আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গেও তার যোগাযোগ-সম্পর্ক ভাল না। এলাকায় নিজের অনুসারী গোছের কয়েকজনকে নিয়েই ওঠাবসা সাংসদ ফজলে রাব্বীর। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের অভিযোগ, সাংসদের একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টায় দলের নেতাকর্মীরা তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। এতে দলীয় কর্মকা-ের স্থবিরতা নেমে এসেছে। তার অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার কথা জানিয়ে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্থানীয় সরকার মন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী বরাবরও লিখিত অভিযোগ করেছেন দলের সাঘাটা ও ফুলছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।
সূত্রে জানা গেছে, এবছরের জুনে সাঘাটা-ফুলছড়ি উপজেলার দুস্থ মানুষের জন্য ১০০ মেট্রিকটন চাল বরাদ্দ দেয়া হয় সহকারি ত্রাণ তহবিল থেকে। কিন্তু ওই চাল একদিনের মধ্যেই সব ফুরিয়ে যায়। অভিযোগ আছে, সাংসদ ফজলে রাব্বী ও তার লোকজন এসব ত্রাণের চাল লোপাট করেছে। শুধু তাই নয় এর আগেও সাংসদ ও তার আত্মীয়স্বজনের বিরুদ্ধে টিআর-কাবিখা-কাবিটার চাল-গম লোপাটের অভিযোগ রয়েছে। এব্যাপারে খাদ্যমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাকের কাছে চিঠিও দিয়েছে ফুলছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতারা। চিঠিতে বলা হয়, সাংসদ ফজলে রাব্বী তার ভাই, ভাতিজা, মেয়ের জামাই, ভাগিনাদের নিয়ে নিজস্ব পরিম-ল তৈরি করেছে। বিগত প্রায় পাঁচ বছরে সাঘাটা ও ফুলছড়ি উপজেলায় সরকারি বরাদ্দকৃত টিআর, কাবিখা, কাবিটার কয়েক হাজার মেট্রিকটন চাল, গম আত্মসাতের ব্যবস্থা করেন। নামে-বেনামে ভুয়া প্রকল্প দাখিল এবং আত্মীয়-স্বজনদের প্রকল্প কমিটিতে সভাপতি করে লুটপাটের রাজত্ব গড়ে তুলেছেন।
এছাড়া সাংসদ ফজলে রাব্বীর নির্বাচনী এলাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সূত্র ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানায়, সাংসদের ডিও লেটারের মাধ্যমে তার ভাগিনা জাকির হোসেন সাঘাটা উপজেলার কচুয়াহাট বালক উচ্চবিদ্যালয়ের সভাপতি হয়েছেন। এ ছাড়া তার ডিও লেটারের মাধ্যমে তার মেয়ের শ্বশুর মজিবর রহমান একই উপজেলার সন্যাসদহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, ছোট ভাই ফেরদৌস রাব্বী শিমুলবাড়ি হামিদন্নেচ্ছা বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে, চাচাতো ভাই আজিজুল ইসলাম ভরতখালি উচ্চবিদ্যালয়ে, সাংসদের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত নাসিরুল আলম বোনারপাড়া ইসলামিয়া উচ্চবিদ্যালয়ে ও লুৎফর রহমান হলদিয়া বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে, মেয়ে ফারজানা রাব্বী ফুলছড়ি উপজেলার বুড়াইল স্কুল ও কলেজ, ভাতিজা হাবিবুর রহমান ফুলছড়ি পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ে পরিচালনা কমিটির সভাপতি নিয়োগ পেয়েছেন। এসব ব্যক্তিকে প্রতিষ্ঠানগুলোর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনের বিষয়টি জেলা শিক্ষা কার্যালয় সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
সাংগঠনিকভাবেও সাংসদ ফজলে রাব্বীর বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। এসব নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা একাধিকবার প্রকাশ্যে অসন্তোষ জানিয়েছে। সাংগঠনিকভাবে তার অযাচিত হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন, মিছিল করেছে তারা। একের পর এক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে দলের নেতাকর্মীরা তাকে প্রকাশ্যে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছেন। এসব নিয়ে দলীয় প্রধানের কাছে লিখিত অভিযোগও করেছেন নেতাকর্মীরা।
সাঘাটা উপজেলা আওয়ামী লীগের (ভারপ্রাপ্ত) সভাপতি ওয়ারেছ আলী প্রধান মনে করেন, আগামী নির্বাচনে সাংসদ ফজলে রাব্বীকে মনোনয়ন দেয়া হলে আওয়ামী লীগকে গাইবান্ধা-৫ আসনে চরম ভরাডুবির মুখে পড়তে হবে। তিনি ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে অভিযোগ করে বলেন, ‘ফজলে রাব্বী জাতীয় পার্টির রাজনীতি থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে এলেও এখনও জাপা নেতাদের সঙ্গেই তার বেশ সখ্যতা। এখনও জাপা নেতার চরিত্র বদলাতে পারেননি তিনি।’
ওয়ারেছ আলী জানান, তার উপজেলায় একটি মসজিদের নামে দু-দুবার সরকারি টাকা তুলে আত্মসাত করেছেন তিনি। শুধু তাই নয়, সরকারি উন্নয়নের বিভিন্ন বরাদ্দও লুটপাট করেছেন সাংসদ। এসব কারণে স্থানীয় জনগণ বরাবরই তার ওপর চরম ক্ষুব্ধ বলে জানান তিনি।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ফুলছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জি. এম সেলিম পারভেজ ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘সাংসদ ফজলে রাব্বী নির্বাচিত হওয়ার পর চেহারা পাল্টে ফেলেছেন। নির্বাচনের আগে রাত বিরাতে চরাঞ্চলে তাকে নিয়ে ঘুরে বেরিয়েছি। কিন্তু নির্বাচিত হওয়ার পর দলীয় নেতাকর্মীরা তার কাছে কোনো পাত্তা পায়নি। একারণে ২০১০ সালের ৩ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে দলের স্থানীয় রাজনীতিতে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে।’
সেলিম জানান, ‘ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলায় ১৪৩ টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তার মধ্যে নয়টি প্রতিষ্ঠানের ম্যানিজিং কমিটির সভাপতি তিনি। বাকিগুলো তার ভাই, ভাতিজা, মেয়ের জামাইসহ নিকট আত্মীয়রা দখল করে রেখেছেন। তার এসব স্বেচ্ছচারি আচরণে স্থানীয় জনগণ চরম ক্ষুব্ধ।’
এদিকে নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকারের একাধিক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে সাংসদ ফজলে রাব্বীর আসনকে আওয়ামী লীগের জন্য চরম ঝুঁকিপূর্ণ বলা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে গত প্রায় পাঁচ বছরে সাংসদের অনিয়মের চিত্র। দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের বিষয়টিও প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরেছেন সংশ্লিষ্টরা। সূত্র জানায়, আগামীতে গাইবান্ধার ওই আসনটি আওয়ামী লীগের ঘরে রাখতে অন্য প্রার্থী দেয়ার দাবি জানিয়েছেন তৃণমূলের নেতারা। তা না হলে আওয়ামী লীগকে চরম ভরাডুবির মুখে পড়তে হবে বলেও হুঁশিয়ার করে দেয়া হয়েছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী নির্বাচনে গাইবান্ধা-৫ আসন থেকে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মাহমুদ হাসান রিপন আওয়ামী লীগের টিকিট চাইবেন। তিনি এব্যাপারে এলাকায় পুরোদমে প্রস্তুতিও নিচ্ছেন। তাছাড়া স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও তার সঙ্গে আছেন বলে জানিয়েছেন সাঘাটা ও ফুলছড়ি উপজেলার আওয়ামী লীগ নেতারা।
তবে নিজের বিরুদ্ধে সকল অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সাংসদ ফজলে রাব্বী। তিনি ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘আগামী নির্বাচনে আমার আসনে কোনো ঝুঁকি নেই। আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরা আমার সঙ্গে আছেন। তবে মুষ্ঠিমেয় কয়েকজন আমার ব্যাপারে নানা অপপ্রচার ছড়াচ্ছে। তাদের সুযোগ-সুবিধা না দেয়ায় তারা খেপেছেন। এনিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই।’
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তিনি নিজে ও তার আত্মীয়স্বজনের আধিপত্যের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যারা এসব অভিযোগ করে তাদেরও সভাপতি করা হয়েছিল। কিন্তু নানা অনিয়মের অভিযোগ পেয়ে তাদের সরিয়ে দেয়া হয়েছে।’

Leave a Reply