সাংবাদিককে ‘হুমকি’, কেন্দুয়ার ইউএনওকে সতর্ক করলেন ডিসি
সাংবাদিককে ‘হুমকি’, কেন্দুয়ার ইউএনওকে সতর্ক করলেন ডিসি
বায়েজিদ ভুইয়া বিশেষ প্রতিনিধি: নেত্রকোণায় স্থানীয় এক সাংবাদিককে ‘মামলায় জড়ানোর হুমকি’ দেওয়ার পর কেন্দুয়ার ইউএনওকে সতর্ক করেছেন জেলা প্রশাসক।
উপজেলার বলাইশিমুল মাঠে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের নির্মাণাধীন ঘরে আগুন দেওয়া নিয়ে ইউএনও মাহমুদা বেগমের সংবাদ সম্মেলনের একটি বক্তব্যের ভিডিও শনিবার সন্ধ্যায় নিজের ফেইসবুক অ্যাকাউন্টে শেয়ার করেছিলেন দৈনিক সংবাদের উপজেলা প্রতিনিধি হুমায়ূন কবীর। তারপরই মোবাইল ফোনে ইউএনও ‘হুমকি’ দেন বলে অভিযোগ করেন হুমায়ূন।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে নেত্রকোণার জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ রোববার বলেন, “ইউএনওকে সতর্ক করা হয়েছে। ইউএনওর এসব কথা বলা ঠিক হয়নি। আর তিনি এ ধরনের কথা বলতেও পারেন না। বিষয়টি এরই মধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।”
‘হুমকি’ দেওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করলে কেন্দুয়ার ইউএনও মাহমুদা বেগম বলেন, “সাংবাদিক হুমায়ূন প্রথম থেকেই এজেন্ডা নিয়ে কাজ করছেন। নানা সময়ে এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। এসব স্ট্যাটাসের কমেন্টে অশালীন ও অশ্রাব্য কথাবার্তা লেখা হয়েছে। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেননি।”
বলাইশিমুল মাঠে গৃহহীন ও ভূমিহীনদের জন্য প্রধানমন্ত্রী উপহারের ঘর নির্মাণ নিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে প্রশাসনের দ্বন্দ্ব চলছে। সেখানে পুলিশি প্রহরায় ঘরের নির্মাণকাজ চলছে। এর মধ্যেই শনিবার ভোরে সেখানকার দুটি ঘরের চালে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে।
বিকালে এ নিয়ে নিজের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন ইউএনও মাহমুদা বেগম। সেই সংবাদ সম্মেলনে ঘরে আগুন দেওয়ার জন্য বলাইশিমুল মাঠ রক্ষার আন্দোলনকারীদের তিনি দোষারোপ করেন। এর পেছনে স্থানীয় একজন সাবেক সংসদ সদস্য, একজন ‘মনোনয়ন প্রত্যাশী’ আওয়ামী লীগ নেতার ‘হাত’ রয়েছে বলেও গোয়েন্দা সংস্থার বরাতে তিনি অভিযোগ করেন।
কেন্দুয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. নুরুল ইসলাম এবং কেন্দুয়া থানার ওসি আলী হোসেন সে সময় মঞ্চে ছিলেন।
ইউএনও মাহমুদা বেগম বলেন, “সরকারি দলের কিছু লোক, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, বামদল সবাই মিলে দূরভীসন্ধিমূলক ষড়যন্ত্র করছে। আমরা প্রশাসন অনেক ধৈর্য্য ধরেছি। আর নয়। দরকার হলে পুরো বলাইশিমুল ইউনিয়নকে গ্রেপ্তার করব। এটা হল আমাদের সিদ্ধান্ত। কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কাউকে ছাড় দেব না।”
এই বক্তব্যের ভিডিওই নিজের ফেইসবুকে দিয়েছিলেন দৈনিক সংবাদের উপজেলা প্রতিনিধি ও উপজেলা প্রেসক্লাবের সদস্য হুমায়ূন কবীর। তারপরই তিনি ইউএনওর ফোন পান বলে কেন্দুয়া প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক লিয়াকত আলী চৌধুরী কাজল জানান।
তিনি বলেন, “শনিবার বিকালে ইউএনও উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলন করেন। সেখানে তিনি যা বলেছেন তার ভিডিও ধারণ করেন সাংবাদিক হুমায়ূন কবীর। পরে তিনি সেই ভিডিও নিজের ফেইসবুক পেইজে পোস্ট করেন।”
“সন্ধ্যায় হুমায়ূন কবীর প্রেসক্লাবে বসা ছিলেন। তখন আমিও প্রেসক্লাবে ছিলাম। এ সময় ইউএনও ফোন করেন হুমায়ূন কবীরকে।”
ইউএনও ফোনে সংবাদিক হুমায়ূন কবীরকে প্রশ্ন করেন, তিনি কেন প্রেস রিলিজ থেকে প্রতিবেদন না করে সংবাদ সম্মেলনে ওই বক্তব্যের ভিডিও ফেইসবুকে ছেড়ে দিয়েছেন। সাংবাদিক হুমায়ূন কবীর তখন বলেন, প্রকাশ্যে অনুষ্ঠানে ইউএনওর দেওয়া বক্তব্য তিনি ভিডিও করেছেন এবং সাংবাদিক হিসেবে ফেইসবুকে দিয়েছেন, সেখানে সমস্যা কোথায়। ইউএনও তখন হুমকি দেন বলে সাংবাদিক হুমায়ূন কবীরের ভাষ্য। তিনি বলেন, “ইউএনওর বিরোধিতা করতে থাকলে ঘর পোড়ানোর মামলায় ঢুকাতে বাধ্য হবেন বলে তিনি হুমকি দেন।” প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক কাজল বলেন, সংবাদ সম্মেলনের ভিডিও ফেইসবুকে প্রচার করে হুমায়ূন কবীর কোনো অপরাধ করেছেন বলে তিনি মনে করেন না।
“কেন তিনি (ইউএনও) মামলায় আসামি করার হুমকি দিলেন বুঝতে পারছি না। এসবই গণমাধ্যম কর্মীদের হয়রানি করার জন্যে করা হয়।” “এ রকম দায়িত্বশীল পদে থেকে তিনি যে হুমকি দিয়েছেন তা ন্যক্কারজনক। আমরা তার প্রতিবাদ জানাই। প্রতিকার চাই।”
এলাকাবাসী, স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ জানায়, বলাইশিমুল গ্রামের একটি মাঠে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। গ্রামের মানুষদের একটি অংশ মাঠটি রক্ষা করে অন্য কোথায় আশ্রয়ণ প্রকল্পের দাবি তোলে। অপরদিকে উপজেলার প্রশাসন দাবি করে, বেদখল হয়ে যাওয়া জমি উদ্ধার করে ঘর তৈরি করা হচ্ছে। মাঠও সেখানে থাকবে।
তারা আন্দোলনকারী, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও এলাকাবাসীর সঙ্গে মতবিনিময় করে মাঠের পূর্ব-উত্তর পাশে ঘর নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। ওইদিনই জায়গাটির মাপ দিয়ে ঘর নির্মাণের স্থান নির্ধারণ করেন তারা।
পরদিন ৩০ মে একদিকে ঘর নির্মাণের জন্য ইট, বালুসহ অন্যান্য নির্মাণসামগ্রী পাঠিয়ে কাজ শুরু করা হয়। অপরদিকে একইদিন মাঠ রক্ষার দাবি নিয়ে প্রশাসনে বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করেন আন্দোলনকারীরা।
মামলার বাদী হন বলাইশিমুল গ্রামের বাসিন্দা হাবিবুর রহমান মণ্ডলসহ আটজন। মামলায় বিবাদী করা হয় কেন্দুয়ার ইউএনও, সহকারী কমিশনার (ভূমি), উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও নেত্রকোণা জেলা প্রশাসককে।
শুনানি শেষে আদালত মামলাটি খারিজ করে দিলে গ্রামবাসীদের একাংশ মাঠ রক্ষার দাবিতে আন্দোলন চালানোর ঘোষণা দেন। এরপর থেকে আন্দোলনকারীরা অন্তত পাঁচটি মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছেন। ঢাকার শাহবাগেও ওই মাঠ রক্ষার সমর্থনে মানববন্ধন হয়।
৩০ জুন রাত ৯টার দিকে ‘একদল দুর্বৃত্ত’ প্রকল্পে পাহারারত গ্রাম পুলিশকে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে নির্মাণাধীন ঘর ভাঙচুর করে বলে অভিযোগ উঠে। এ ঘটনায় দ্রুত বিচার আইনে মামলা হয়। এর আড়াই মাসের মাথায় ঘরে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে।