সর্বদলীয় অন্তর্বর্তী সরকার : জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব
বিশেষ প্রতিনিধি ॥ নির্বাচনের সময় ‘সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা’ গঠনের ঘোষণা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই মন্ত্রিসভায় অংশগ্রহণে সংসদ সদস্যদের মধ্যে থেকে নাম প্রেরণের জন্য বিরোধী দলের কাছে প্রস্তাব দিয়েছেন। নব্বই দিনের মধ্যে যাতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, সে জন্য সব দলের সঙ্গে, বিশেষ করে মহাজোটের সঙ্গে পরামর্শ করেই রাষ্ট্রপতির কাছে যথাসময়ে লিখিত পরামর্শ দেয়া হবে উল্লেখ করে তিনি এ ক্ষেত্রে বিরোধী দলের কাছেও পরামর্শ প্রত্যাশা করে বলেন, জনতার প্রতি আস্থা রাখুন, সন্ত্রাসের পথ পরিহার করুন। আপনি (খালেদা জিয়া) কী চান তা সংসদে এসে বলুন, আলোচনা করুন। আলোচনার দরজা সব সময়ই আমাদের পক্ষ থেকে উন্মুক্ত আছে। বিরোধী দলসহ দেশবাসীকে আশ্বস্ত করে তিনি বলেন, আগামী সংসদ নির্বাচনও অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে ইনশাল্লাহ।
বিরোধী দলকে সংঘাতের পথ পরিহার করে সমঝোতার মাধ্যমে মানুষের কল্যাণে শান্তির পথে আসার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা সব দলকে সঙ্গে নিয়েই জাতীয় নির্বাচন করতে চাই। বিরোধী দলের কাছে আমার প্রস্তাব, নির্বাচনকালীন আমরা সব দলের সমন্বয়ে সরকার গঠন করতে পারি। আমাদের লক্ষ্য অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন। তাই বিরোধী দলের কাছে আমার প্রস্তাব, বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকেও আপনারা (বিরোধী দল) নাম দিতে পারেন, যাদের আমরা অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রিসভায় সদস্য করে সর্বদলীয় সরকার গঠন করতে পারি। নির্বাচনে যাতে কারও কোন সন্দেহ না থাকে, সব সন্দেহ দূর করে আমরা সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে পারি, যে নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ ভোট দিয়ে তাদের মনমতো সরকার গঠন করতে পারবে।
বুধবার জাতীর উদ্দেশে দেয়া প্রায় ৩৫ মিনিটের ভাষণে তাঁর এই ডাকে সাড়া দেয়ার জন্য বিরোধী দলের নেতার প্রতি অনুরোধ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি আশা করি তিনি (খালেদা জিয়া) আমার এই ডাকে সাড়া দেবেন। আমার এ অনুরোধ তিনি রক্ষা করবেন এবং আমাদের যে সদিচ্ছা, সেই সদিচ্ছার তিনি মূল্য দেবেন। আসুন, দেশ ও জাতির কল্যাণের স্বার্থে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে আরও সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করি। যাতে আমাদের তরুণ প্রজন্ম একটি সুন্দর সমাজ পায়। একটি সুন্দর সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ আমরা সবাই মিলে গড়ে তুলতে পারি। সব ভেদাভেদ ভুলে ২০২১ সালের মধ্যে গড়ে তুলি ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও নিরক্ষরতামুক্ত আধুনিক বাংলাদেশ, জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা।
সন্ত্রাসের পথ পরিহার করে পুনর্বার সংসদে আলোচনায় বসার জন্য বিরোধীদলীয় নেতার প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দা, কুড়াল, বল্লম নিয়ে মানুষ মারার নির্দেশ প্রত্যাহার করার জন্য আমি বিরোধী দলের নেতার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। তিনি বলেন, শান্তি ও ঐক্যের পথই দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে। বোমা মেরে, আগুন জ্বালিয়ে জনগণের জানমালের ক্ষতি করবেন না। কোরান শরীফ পুড়িয়ে, মসজিদে আগুন দিয়ে ইসলাম ধর্মের অবমাননা করা বন্ধ করুন। মাদ্রাসায় বোমা তৈরির কাজে ব্যবহার করতে এতিম বাচ্চাদের লাশ বানানো বন্ধ করুন। নিরীহ পথচারী আর গরিব বাস ড্রাইভারকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারা বন্ধ করুন। মানুষকে শান্তিতে থাকতে দিন। তিনি বলেন, ইসলাম ধর্ম শান্তির ধর্ম। ইসলাম কখনই সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের অনুমোদন দেয় না। যারা নির্দোষ মানুষকে ধর্মের নামে হত্যা করে তাদের চূড়ান্ত ঠিকানা হবে দোজখ।
বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় পাঁচ পৃষ্ঠাব্যাপী জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণটি বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারের মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে এবং আগামী ২৫ অক্টোবরকে ঘিরে প্রধানমন্ত্রী দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে সৃষ্ট উত্তেজনা এবং এ নিয়ে সারাদেশব্যাপী সৃষ্ট উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যেই বিরোধী দলের প্রতি পুনর্বার প্রধানমন্ত্রীর আলোচনার প্রস্তাব কিছুটা হলেও জনমনে স্বস্তি আনবে বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা। এ ছাড়া আগামী নির্বাচন যে সংবিধান অনুযায়ী এবং অ-নির্বাচিত নয়, নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের সমন্বয়েই অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হবে তা-ও জাতির সামনে পরিষ্কার করে দেন প্রধানমন্ত্রী। ভাষণে প্রধানমন্ত্রী আগামীতে সরকার গঠন করতে পারলে মানুষের ঘরে ঘরে বিদ্যুত পৌঁছে দেয়ারও প্রতিশ্রুতি দেন।
সংবিধান অনুযায়ী আগামী ২৫ অক্টোবর থেকে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী সংবিধানের ৭২-এর ১ অনুচ্ছেদ উল্লেখ করে বলেন, এই অনুচ্ছেদে স্পষ্ট বলা আছে যে- ‘সংসদের এক অধিবেশনের সমাপ্তি ও পরবর্তী অধিবেশনের প্রথম বৈঠকের মধ্যে ষাট দিনের অতিরিক্ত বিরতি থাকবে না।’ এখানে আরও উল্লেখ রয়েছে যে, ‘১২৩ অনুচ্ছেদের ৩ দফার ‘ক’ উপধারায় উল্লেখিত নব্বই দিন সময় ব্যতীত অন্য সময়ে।’ তিনি বলেন, সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদের ৩ দফায় নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয় উল্লেখ আছে। ৩ এর (ক)-তে বলা হয়েছে, ‘মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাঙ্গিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে; এবং (খ)-তে মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোন কারণে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাঙ্গিয়া যাইবার পরবর্তী নব্বই দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদ ব্যাখ্যা করে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি সরকার গঠন করে। ২৫ জানুয়ারি বর্তমান সংসদের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সংবিধানের ১২৩ (৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ২৫ অক্টোবর থেকে নব্বই দিনের হিসাব শুরু হবে। তিনি বলেন, সংবিধানের ৭২ অনুচ্ছেদের ১ দফা অনুযায়ী মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া লিখিত পরামর্শ অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করবেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, নব্বই দিনের মধ্যে যাতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, সে জন্য আমি সব দলের সঙ্গে, বিশেষ করে মহাজোটের সঙ্গে পরামর্শ করে রাষ্ট্রপতিকে যথাসময়ে লিখিত পরামর্শ দেব। এ ক্ষেত্রে আমি বিরোধী দলের কাছেও পরামর্শ আশা করি। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার গণতন্ত্রকে একটি সুদৃঢ় এবং প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে বদ্ধপরিকর। গণতন্ত্র তখনই শক্তিশালী হবে যখন তা সাংবিধানিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হবে, জনগণের ভোটে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিরা রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন।
বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দু’বছরে নির্মম নির্যাতন-নিপীড়নের কথা দেশবাসীকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ২০০৭-এর ওয়ান ইলেভেনের মতো কোন তত্ত্বাবধায়ক সরকার যখন জগদ্দল পাথরের মতো জনগণের বুকের ওপর চেপে বসে, তখন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, শিক্ষক-ছাত্র-পেশাজীবী, ব্যবসায়ীসহ সবার ওপর নেমে আসে নির্মম নির্যাতন। এ ধরনের অসাংবিধানিক শাসনের পুনরাবৃত্তি আর কখনই হবে না- এটাই সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পাঁচ বছরের দুঃশাসনের চিত্র দেশবাসীর সামনে তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, চারদলীয় জোট সরকারের এই পাঁচ বছরের শাসনামলে দেশজুড়ে হত্যা-সন্ত্রাস-ধর্ষণ-লুটপাট-দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি দেশকে অন্ধকারের পথে ঠেলে দিয়েছিল। সেই দুঃসহ দহন-জ্বালার আতঙ্ক মানুষকে এখনও তাড়া করে ফেরে। হাওয়া ভবন নামে সরকারের ভেতরে আরেকটি সরকার এদেশের মানুষ ভুলে যায়নি। বিএনপির এই অপকর্মের কারণেই দেশে নেমে এসেছিল ১/১১-এর আরেক যন্ত্রণাময় অধ্যায়। তিনি বলেন, এদেশের মানুষ সেই আতঙ্কের শাসন থেকেও সাহসের সঙ্গে বের হয়ে এসেছে। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে উজ্জ্বল সম্ভাবনার পথ বেয়ে। দেশের মানুষ খেয়ে-পরে শান্তিতে আছে। আইনশৃঙ্খলার উন্নতি হয়েছে।
তিনি বলেন, বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে যে বাংলাদেশ সারাবিশ্বে সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও জঙ্গীবাদের কারণে নিন্দিত ও সমালোচিত হতো, লজ্জায় আমাদের মাথা হেঁট হয়ে যেত, সেই বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল হিসাবে সারাবিশ্বে স্বীকৃতি পেয়েছে। আমরা সুশাসন প্রতিষ্ঠা করেছি। কঠোর হাতে জঙ্গীবাদ দমন করেছি। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করেছি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন করেছি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেছি। দেশবাসী ও প্রবাসী বাঙালীরা এখন মাথা উঁঁচু করে মর্যাদার সঙ্গে চলতে পারেন।
গত ৪, ৫ ও ৬ মে রাজধানীতে বিএনপি-জামায়াত ও হেফাজতের তা-বের কথা দেশবাসীকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিরোধীদলীয় নেত্রীকে আমি সংলাপে ডেকেছিলাম। দুঃখের বিষয় তার জবাবে তিনি আল্টিমেটাম দিয়ে বললেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আমাকে ক্ষমতাচ্যুত ও দেশছাড়া করবেন। এরপর ৪, ৫ ও ৬ মে মতিঝিল শাপলা চত্ব¡রের ধ্বংসযজ্ঞ জাতিকে আতঙ্কিত করেছিল। আমরা সময়োচিত পদক্ষেপ নিয়ে মানুষের মনে স্বস্তি ফিরিয়ে এনেছি, নিরাপত্তা দিয়েছি। তিনি বলেন, বিএনপির পক্ষ থেকে জাতীয় সংসদে মুলতবি প্রস্তাব দেয়া হলো। যখন আলোচনায় আমরা রাজি হলাম, সেই প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নিলেন। একবার বলছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার, আরেকবার নির্দলীয়, আবার বলছেন হাসিনামুক্ত। নানা অবাস্তব কথা বলে যাচ্ছেন। মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন। বিরোধী দলের প্রতি পুনর্বার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, প্রয়োজনে আবারও মুলতবি প্রস্তাব দিন জাতীয় সংসদে এবং সুস্পষ্টভাবে বলুন আপনারা কী চান?
বর্তমান মহাজোট সরকারের আমলে প্রভাবমুক্ত সব নির্বাচন অনুষ্ঠানের চিত্র দেশবাসীর সামনে তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশবাসীর মনে আছে, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান নির্বাচন কমিশন গঠন করার আগে সব রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছিলেন। বিরোধী দলের নেতা ও বিএনপি নেত্রী (খালেদা জিয়া) সেই সংলাপে যোগ দিয়েছিলেন। সবার পরামর্শক্রমেই বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়।
তিনি বলেন, আমরা সরকার গঠনের পর থেকে এ পর্যন্ত ৫ হাজার ৭৭৭টি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচন কমিশন প্রত্যেকটি নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত করেছে। কোন নির্বাচনেই সরকার হস্তক্ষেপ করেনি। অনেক নির্বাচনে বিরোধী দলের প্রার্থীরা জয়লাভ করেছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনও অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে ইনশাল্লাহ।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর বাংলাদেশে নির্বাচন নিয়ে অনেক খেলা হয়েছে। এদেশের মানুষ গত ৩৮ বছরে দেখেছে, প্রতিটি নির্বাচকালীন অশান্ত পরিস্থিতি, হিংস্রতার তা-ব। একমাত্র আওয়ামী লীগ সরকারই ২০০১ সালে সফলভাবে মেয়াদপূর্তির পর শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিল। এদেশের মানুষ আর হানাহানি চায় না, বিশৃঙ্খলা চায় না। তিনি বলেন, মানুষের কল্যাণ, সমৃদ্ধি ও উন্নত জীবনই আমার জীবনের একমাত্র কাম্য। তাই বিরোধী দলের প্রতি আমার আহ্বান, সংঘাতের পথ পরিহার করে সমঝোতার মাধ্যমে মানুষের কল্যাণের পথে আসুন। শান্তির পথে আসুন।
বর্তমান মহাজোট সরকারের আমলে সম্পাদিত বিভিন্ন উন্নয়ন ও সফলতার চিত্র দেশবাসীর সামনে তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৮ সালে বাংলার মানুষ ভোট দিয়ে যে আস্থা এবং বিশ্বাস আমাদের ওপর রেখেছেন, আমরা দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে তাদের সেই আস্থা এবং বিশ্বাসের মর্যাদা রক্ষা করার জন্য কাজ করে যাচ্ছি। আপনাদের ভোটে নির্বাচিত সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর কৃষি, শিক্ষা, খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা, অবকাঠামো উন্নয়ন, বিদ্যুত, কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ ও নারী অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন খাতে যে উন্নয়ন হয়েছে তা সারা বিশ্বের প্রশংসা অর্জন করেছে।
তিনি বলেন, নিম্নবিত্ত মানুষ দারিদ্র্যের শৃঙ্খল থেকে বের হয়ে মধ্যবিত্তের কাতারে উঠে আসছে। জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পাচ্ছে। কৃষক-শ্রমিক-মেহনতী মানুষ ও গার্মেন্টস শ্রমিকদের আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। একজন দিনমজুর সারাদিনের পরিশ্রম শেষে দুই কেজি চাল কেনার মতো মজুরি পেত না। আজ তার মজুরির টাকায় সে ৮ থেকে ১০ কেজি চাল কিনতে পারছে। সংসারের নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্য জিনিসপত্রও কিনতে পারছে। এই কৃতিত্বের দাবিদার দেশবাসীই। আমি বিশ্বাস করি, যে জাতি রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা আনতে পারে সেই জাতির উন্নয়ন কেউ থামিয়ে রাখতে পারবে না।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণের লক্ষ্যে, তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষিত আগামী প্রজন্ম গড়তে আমরা কম্পিউটার শিক্ষার ব্যবস্থা করেছি। প্রতি ইউনিয়নে ইন্টারনেট সংযোগসহ তথ্য সেবাকেন্দ্র খুলে দিয়েছি। তরুণ-তরুণীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। তারা গ্রামে থেকেই নগদ টাকা আয় করে জীবনে সচ্ছলতা আনতে পারছে। তিনি বলেন, মোবাইলের মাধ্যমে বিদেশ থেকে টাকা পাঠানো সহজ হয়েছে। স্কাইপের মাধ্যমে, ভিডিও কলের মাধ্যমে গ্রাম বাংলার মানুষ তাদের প্রবাসী আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাত করতে পারছেন। ছাত্রছাত্রীরা বিনামূল্যে বই পাচ্ছে। প্রাথমিক থেকে ডিগ্রী পর্যন্ত ১ কোটি ১৯ লাখ ছাত্রছাত্রীকে বৃত্তি ও উপবৃত্তি দেয়া শুরু হয়েছে। ঘরের কাছে কমিউনিটি ক্লিনিকসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে ডাক্তার ও নার্সদের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ চিকিৎসাসেবা ও বিনামূল্যে ওষুধ পাচ্ছেন। ফলে শিশুমৃত্যু, মাতৃমৃত্যুর হারও কমে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, প্রশাসন, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সশস্ত্র বাহিনী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা অর্থাৎ পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, আনসার-ভিডিপি, ফায়ার সার্ভিসসহ সব প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ধরনের পেশাগত সমস্যার সমাধান করেছি। বেতন-ভাতা বাড়িয়েছি। চাকরির বয়সসীমা বাড়িয়েছি। তাদের কল্যাণে নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছি। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর জন্য বিশ্বমানের আধুনিক সমরাস্ত্র সংগ্রহ করা হয়েছে এবং আরও সংগ্রহ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যদের জন্য উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। তাদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি করেছি। সব প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন স্তরে পদমর্যাদা বৃদ্ধি করেছি, পদের নাম পরিবর্তন করে মর্যাদাপূর্ণ নামকরণ চলমান রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের সরকার দায়িত্ব নেয়ার সময়ে দেশে ছিল বিদ্যুতের জন্য হাহাকার। আমরা আপনাদের কষ্ট দূর করেছি। দেশে এখন বিদ্যুত উৎপাদন সক্ষমতা ৯ হাজার ৭১৩ মেগাওয়াট। মোট জনগোষ্ঠীর ৬০ শতাংশ মানুষ বিদ্যুত সুবিধা পাচ্ছে। আপনাদের সমর্থন নিয়ে আগামীতে সরকার গঠন করতে পারলে ঘরে ঘরে বিদ্যুত পৌঁছে দেব ইনশাল্লাহ। তিনি বলেন, দেশের প্রতিটি ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলায় রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ করে আমরা যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন এনেছি যা সামনের দিনগুলোতেও অব্যাহত থাকবে।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারের উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে দেশবাসীর উদ্দেশে আরও বলেন, বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা সত্ত্বেও বাংলাদেশ আজ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে চলছে। মানুষের মাথাপিছু আয় ১০৪৪ ডলারে উন্নীত করেছি। প্রবৃদ্ধি ৬ ভাগের ওপরে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছি। মূল্যস্ফীতি ১১ ভাগ থেকে কমিয়ে ৭-৮ ভাগে নামিয়ে এনেছি। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সর্বকালের রেকর্ড অতিক্রম করে বর্তমানে ১৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। রোজার মাসে খাদ্যপণ্যের দাম কমিয়েছি। এবারের ঈদে কোরবানির পশুর দাম আপনাদের ক্রয়ক্ষমতার আওতায় ছিল। সুষ্ঠুভাবে পবিত্র হজ পালনের ব্যবস্থা করেছি। যারা হজ সম্পন্ন করেছেন তাদের মোবারকবাদ জানাচ্ছি এবং মহান আল্লাহতালার দরবারে শুকরিয়া আদায় করছি। তিনি বলেন, আমরা সমুদ্র বিজয় করেছি। বিপুল সমুদ্র সম্পদ জনগণের কল্যাণে ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ শুরু করেছি। ভবিষ্যতে এগুলো বাস্তবায়িত হলে আমাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা আরও উন্নত হবে।
ভাষণের শেষাংশে প্রধানমন্ত্রী আবেগজড়িত কণ্ঠে দেশবাসীর উদ্দেশে বলেন, ১৫ আগস্টের এক রাতে বাবা-মা, ভাইসহ সব মিলিয়ে পরিবারের ১৮ সদস্যকে হারিয়েছি। মানুষ একটা শোক সইতে পারে না। যদি আপনাদের কোন আপনজন মৃত্যুবরণ করে আপনারা জানেন সেই ব্যথা-বেদনা কত কঠিন। পরিবারের সব সদস্যকে হারিয়েও সেই শোক-ব্যথা বুকে নিয়ে শুধু আপনাদের জন্য, এদেশের কৃষক, শ্রমিক, মেহনতী মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য আমি দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছি। কারণ, আমার পিতা এদেশের মানুষকে গভীরভাবে ভালবেসেছেন এবং এদেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের জন্যই তিনি তাঁর জীবন দিয়ে গেছেন। তাঁর একটাই স্বপ্ন ছিল যে বাংলাদেশ হবে একটি ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত বাংলাদেশ। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ উন্নত জীবন পাবে এটাই ছিল তাঁর স্বপ্ন। তাই আজ আমি আপনাদের কাছে দোয়া চাই। দোয়া করবেন। যে গুরু দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি তা যেন যথাযথভাবে পালন করে ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে যেন উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে পারি।