সরকার গঠনের প্রস্তুতি নিচ্ছে ইমরান খানের দলের
পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচনে নাটকীয় ফলাফলের পর কেন্দ্রীয় সরকার গঠন নিয়েও শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের দল বলছে, তারা দুই-তৃতীয়াংশ আসনে বিজয়ী হয়েছে এবং এককভাবে সরকার গঠনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রেসিডেন্ট তাদের সরকার গঠনের আমন্ত্রণ জানাবেন বলে মন্তব্য করেছেন দলটির বর্তমান শীর্ষ নেতা। এদিকে, নজিরবিহীন জালিয়াতির অভিযোগের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের পর ফলাফল প্রকাশেও অভাবনীয় সময়ক্ষেপণ দেখেছে পাকিস্তানের মানুষ। ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার দু’দিন পরও জাতীয় পরিষদের পূর্ণাঙ্গ ফল প্রকাশ করেনি দেশটির নির্বাচন কমিশন। সেনাবাহিনী জালিয়াতির ষোলোকলা পূর্ণ করার জন্যই এ কৌশল অবলম্বন করছে বলে অভিযোগ করেছে ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)।
শনিবার দেশটির জিও নিউজের সঙ্গে আলাপকালে বিলাওয়াল বলেন, ‘আমরা এখনও ভোটের পুরো ফলাফল জানি না, বিজয়ী স্বতন্ত্র পার্লামেন্ট সদস্যরা কী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বা নিচ্ছেন, সেটাও জানি না। পিএমএল-এন, পিটিআই বা অন্যদের সঙ্গে জোট সরকার গঠনের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো আলোচনা হয়নি।’ বিলাওয়াল বলেন, ‘পিপিপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আমার নাম প্রস্তাব করেছে। এখন আমাদের যদি সেটা পরিবর্তন করতে হয়, তাহলে আমাদের আরেকটি বৈঠক করতে হবে এবং সেই বৈঠকে আমরা কীভাবে এগোব, সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব।’
এ খবরের পরপরই আরও উত্তেজনাপূর্ণ সংবাদ নিয়ে হাজির হন পিটিআইয়ের চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার গহর আলি খান। তিনি বলেন, পিটিআই সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা মিলে একক সরকার গঠনের পরিকল্পনা করছেন। গহর আলি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত যে ফলাফল এসেছে তাতে এটা স্পষ্ট, পিটিআই এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে যাচ্ছে। তা ছাড়া পাঞ্জাবের প্রাদেশিক আইনসভায় আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছি। পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের ২৬৫ আসনের মধ্যে ১৭০টিতে পিটিআই জিতেছে দাবি করে ব্যারিস্টার গহর বলেন, ‘যেহেতু এককভাবে সরকার গঠনের সুযোগ আমাদের রয়েছে, তাই জোট গঠনের কোনো পরিকল্পনা নেই। পিএমএল-এন অথবা পিপিপির সঙ্গে কোনো যোগাযোগও আমাদের হয়নি।’ তিনি বলেন, এখন পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, তা ইমরান খানই নির্ধারণ করবেন। তিনিই আমাদের মূল নেতা, সেটা মুক্ত থাকলেও, আবার কারাগারে থাকলেও।’
এদিকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি শিগগির পিটিআইকে সরকার গঠনের জন্য আহ্বান করবেন বলে জানিয়েছেন গহর। এ ছাড়া শনিবার রাতের মধ্যে বাকি আসনের ফলাফল ঘোষণা করা না হলে পিটিআই সমর্থকরা আজ রোববার রাজধানী ইসলামাবাদে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ মিছিল করবেন বলেও জানিয়েছেন তিনি। এবারের নির্বাচনে সব জল্পনাকল্পনাকে মিথ্যা প্রমাণ করে পিটিআই সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা সবচেয়ে বেশি আসনে জয়ী হয়েছেন। ফলে এ দলটিরই সরকার গঠনের কথা। তবে দেশটির শক্তিধর সেনাবাহিনী তাদের শত্রু ইমরানকে ক্ষমতার বাইরে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে। পিটিআই বাদে অন্যান্য দলের সমন্বয়ে জোট সরকার গঠনের জোর চেষ্টা চলছে। এ অবস্থায় পাকিস্তানের মানুষের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ বাড়ছে। পিটিআই সমর্থকরা দেশটির বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ করছেন। এরই মধ্যে শনিবার গভীর রাতে জেলে থেকেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে ভাষণে ইমরান খান নির্বাচনে বিজয় দাবি করেছেন। তিনি নেতাকর্মীকে বিজয় উদযাপন এবং নফল নামাজ পড়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
দেখা গেছে, কারারুদ্ধ ইমরান খানের দল সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জাতীয় পরিষদের ২৬৫ আসনের মধ্যে ১০০টি আসনে জয় পেয়েছেন। অবশ্য এর মধ্যে আটজন পিটিআইবহির্ভূত বলে দাবি করা হয়েছে। পিএমএল-এন প্রার্থীরা ৭৬টি এবং পিপিপি পেয়েছে ৫৪টি আসন। এ ছাড়া জমিয়তে উলেমা-ই-ইসলাম (জেইউআই-এফ) তিনটি ও অন্যরা পেয়েছে বাকি আসন। একটি আসনে ভোট স্থগিত হয়েছে এবং সাতটি আসনের ফলাফল ঘোষণা বাকি আছে।
তবে নির্বাচন কমিশন ঘোষিত ফলে এটা স্পষ্ট হয়েছে, কোনো দলই পার্লামেন্টে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা বা ১৩৪ আসন পাচ্ছে না। ফলে একটি ‘ঝুলন্ত’ পার্লামেন্টই পেতে যাচ্ছে পাকিস্তান।
এর আগে বলা হয়েছিল, পিটিআই জোট গঠনের আলোচনা শুরু করবে। দলটির প্রভাবশালী নেতা গহর আলি খান এবং আসাদ কাইসার ও আমি মুহাম্মাদ খানসহ শীর্ষ নেতারা জোট গঠন সম্পর্কিত বৈঠকে থাকবেন বলে দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকার গঠনে মিত্রদের সঙ্গে বৈঠকে আলোচনা হবে। তবে পিএমএল-এন ও পিপিপির সঙ্গে কোনো প্রকার জোটের আলোচনা হচ্ছে না বলে জিও টিভিকে বলেছেন গহর আলি।
এদিকে পিএমএল-এন চাচ্ছে, নতুন জোট গঠিত হলে সেই জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী হবেন নওয়াজ শরিফ। তবে আসন পাওয়ার দিক থেকে তৃতীয় স্থানে থাকা পিপিপি জানিয়েছে, নতুন জোটে যেতে কোনো সমস্যা না থাকলেও নওয়াজ শরিফকে পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে আপত্তি রয়েছে দলটির। দলটি চায় পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হবেন পিপিপির চেয়ারম্যান বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি।
পাকিস্তানি বিশ্লেষক জাইঘাম খান বলেছেন, প্রাথমিক ফলাফল ঘোষণার পর দুটি সম্ভাব্য পরিস্থিতি রয়েছে। তিনি আলজাজিরাকে বলেন, সবচেয়ে সম্ভাবনা রয়েছে একটি জোট সরকার গঠনের, যাতে পিটিআই বাদে সব রাজনৈতিক দল অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এর মধ্যে দুটি বৃহত্তম রাজনৈতিক দল পিপিপি ও পিএমএল-এন, পাশাপাশি এমকিউএম, জামায়াতে ইসলামী ও অন্যরাও অন্তর্ভুক্ত থাকবে। তিনি বলেন, দ্বিতীয় দৃশ্যকল্প কম সম্ভাবনাময়, তবে তাত্ত্বিকভাবে সম্ভব পিপিপি ও পিটিআই হাত মেলাবে এবং সরকার গঠন করবে।
তবে জাইঘাম খান বলেন, কারচুপির অভিযোগের মধ্যে পাকিস্তানের অনেক লোকই পরবর্তী সরকারকে বৈধ বলে বিশ্বাস করবে না এবং এটি পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর প্রভাব ফেলবে। ফলে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা আগামী কিছু সময়ের জন্য পাকিস্তানকে তাড়িয়ে বেড়াবে।
রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্যেই ৭১ বছর বয়সী ইমরানকে গতকাল ১৪ মামলায় জামিন দিয়েছেন ইসলামাবাদের সন্ত্রাসবাদবিরোধী আদালত। পাশাপাশি পিটিআইর জ্যেষ্ঠ নেতা শাহ মেহমুদ কোরেশিকেও ১৩ মামলায় জামিন দেওয়া হয়েছে। যেসব মামলায় ইমরান ও কোরেশি জামিন পেয়েছেন, তার সবই গত বছরের ৯ মে সংঘটিত দাঙ্গার সঙ্গে সম্পর্কিত।
ইসলামাবাদ হাইকোর্টে হাজিরা দিতে গিয়ে ওই দিন আদালত চত্বরে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ইমরান। এর পর নজিরবিহীন বিক্ষোভে ফেটে পড়েন তাঁর দলের নেতাকর্মী-সমর্থকরা। পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সেবার সেনানিবাস ও সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা হয়। যেসব মামলায় জামিন পেয়েছেন ইমরান, সেগুলোর মধ্যে ১২টি ওই দাঙ্গায় উস্কানিসংক্রান্ত।
এবারের নির্বাচনের ফলাফলে দেশটির সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, সেনাবাহিনী এখন ‘গণশত্রুতে’ পরিণত হয়েছে।
এ পরিস্থিতিতে সেনাপ্রধান আসিম মুনির শনিবার বিবৃতিতে বলেছেন, ‘পাকিস্তানের বৈচিত্র্যময় রাজনীতি ও বহুত্ববাদ সব গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্যবদ্ধ সরকারের মাধ্যমে জাতীয় স্বার্থে প্রতিফলিত হওয়া উচিত।’
আইএসপিআরের মাধ্যমে দেওয়া বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘নির্বাচন জয়-পরাজয়ের শূন্য সমষ্টি নয়; বরং গণরায় নির্ধারণের একটি মহড়া। রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও তাদের কর্মীদের স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে জনগণের শাসন ও সেবা করার প্রচেষ্টাকে একত্রিত করা উচিত, যা গণতন্ত্রকে কার্যকর ও উদ্দেশ্যমূলক করার একমাত্র উপায় হতে পারে।’ তাঁর মতে, ‘নির্বাচন ও গণতন্ত্র পাকিস্তানের জনগণকে সেবা করার উপায়।’ তিনি মনে করেন, ‘পাকিস্তানের জনগণ যেহেতু সংবিধানের প্রতি তাদের সম্মিলিত আস্থা রেখেছে, এখন রাজনৈতিক পরিপক্বতা ও ঐক্যের সঙ্গে এর প্রতিদান দেওয়া সব রাজনৈতিক দলের কর্তব্য।’