সরকারের এই মেয়াদে জিএসপি সুবিধা পাচ্ছে না বাংলাদেশ
আওয়ামী লীগ শাসিত বর্তমান সরকারের মেয়াদে আর যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্কমু্ক্ত সুবিধা (জিএসপি) পাচ্ছে না বাংলাদেশ। বিভিন্ন সময়ে সরকারের প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, উপদেষ্টাসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জিএসপি নিয়ে নানা কথা বললেও এবারই প্রথম ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা সরাসরি বলে দিয়েছেন আগামী ডিসেম্বরে জিএসপি পুনর্বিবেচনার শুনানি হবে। বর্তমান সরকারের সাংবিধানিক মেয়াদ শেষ হতে আর অল্প কয়েকদিন বাকি। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী অক্টোবরেই আওয়ামী লীগ বর্তমান সরকার থেকে সরে দাঁড়াবে। সেই হিসেবে এ সরকারের মেয়াদে আর জিএসপি সুবিধা পাচ্ছে না বাংলাদেশ।
এ নিয়ে বর্তমান সরকারের সমালোচনা করেছেন সংশ্লিষ্ট অনেকেই। বিশেষ করে বাংলাদেশের এত বড় একটি সুবিধাকে ধরে রাখতে না পারার দায়ভার সরকারের বড় ধরনের একটি ব্যর্থতার চিত্র অংকন করবে বলেও অনেক বিশেষজ্ঞ মত দেন। তারা বলেন, জিএসপি সুবিধা হারিয়ে পুনরুদ্ধার করার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা বিশ্বের কাছে আমাদের মাথানত করে দিয়েছে। সরকার বারবার মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে এর ঘাড়ে ওর ঘাড়ে দোষ চাপালে সরকার কি করে? এমন প্রশ্নও তুলেছেন অনেকে।
সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি দাবি করেছেন, যে কোনো সময়ের চেয়ে বর্তমান সরকারের আমলে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের সর্বাধিক সুসম্পর্ক রয়েছে। এর সমালোচনা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যাপক ও গবেষক ড. ইমতিয়াজ আহম্মেদ চৌধুরী বলেন, সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ বক্তব্য হাস্যকর এবং কৌতুক সমতুল্য।
তিনি বলেন, সরকারপ্রধান যেখানে জিএসপি স্থগিতকরণের জন্য প্রধান বিরোধী দল নেতা এবং নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে দায়ী করে সংসদে বক্তব্য দেন এবং সরকারের এ বক্তব্য যদি আমি সত্যি মনে করি তাহলে সেখানে তো আমার মনে হয়, সরকারের চেয়ে বিরোধী দলের নেতা এবং ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক বেশি ভালো। তিনি বলেন, আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শুধু বিদেশেই ঘুরেছেন, পার্সপোট ভারি করেছেন, তাতে দেশের জন্য কাজের কাজ তেমন কিছুই হয়নি।
ড্যান মজিনার বক্তব্যের প্রসঙ্গ ধরে ইমতিয়াজ আহম্মেদ চৌধুরী বলেন, আগামী ডিসেম্বরে জিএসপি পুনর্বিবেচনার শুনানিতে কি অপেক্ষা করছে বাংলাদেশের জন্য তাও নিশ্চিত করে বলা যায় না। যেহেতু জিএসপি নিয়ে আজ পর্যন্ত কেউ দায়িত্ব নিতে পারলো না তাই সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
তিনি বলেন, জিএসপি পুনরুদ্ধারে বিজিএমই চাইলেই হবে। যদি বিজিএমই তাদের বেআইনি অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকা ভবনটা সরিয়ে ফেলে তাহলে তা জিএসপি পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রভাব ফেলবে বলে আমি মনে করি।
সরকারের এই মেয়াদে জিএসপি সুবিধা হারিয়ে তা ইউরোপের বাজারেও বাংলাদেশের পোশাক বাজারকে হুমকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্ট অনেক বিশেষজ্ঞ। যুক্তরাষ্ট্রের এমন সিদ্ধান্তের পর ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোতেও বাংলাদেশের বাজার নিয়ে শঙ্কা থেকে যাচ্ছে বলে জানান তারা।
এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি মীর নাসির বলেন, এটা এখন অনেকটা সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এখন শুধু বর্তমান সরকারের যে কয়েক মাস মেয়াদ আছে তার মধ্যে তাদের যুক্তরাষ্ট্রের শর্তগুলো পালনে কাজ করে যেতে হবে।
তিনি জানান, জিএসপি স্থগিতকরণের ফলে আমাদের বাজার যতটা না পিছিয়ে গেছে তার চেয়েও বেশি সুনাম নষ্ট হয়েছে। যার ফলে আন্তর্জাতিক বিশ্বে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে অনুকূল পরিবেশ অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে।
জিএসপি সুবিধা স্থগিতকরণের ক্ষেত্রে বিজিএমইএ’র কতটা গাফলতি ছিল তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে মূল কাঠামোটাই বিজিএমইএ’র। তাই এক্ষেত্রে বিজিএমইএকেই মূল দায়ভার নিতে হবে। তবে জিএসপি নিয়ে যে শুনানি হয়েছিল সেই অবস্থানে বিজিএমইএর পাশাপাশি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও আরো শক্তিশালী হয়ে কাজ করা উচিত ছিল বলে মনে করে করেন সাবেক এ সভাপতি।
বর্তমান সরকারের মেয়াদে জিএসপি পুনরুদ্ধার হচ্ছে না এটা সরকারের ব্যর্থতাকে কতটুকু ভারী করবে এমন প্রশ্নের জবাবে সাবেক রাষ্ট্রদূত ফারুক আহম্মেদ চৌধুরী বলেন, জিএসপি সুবিধা স্থগিতের ফলে শুধু সরকারের ব্যর্থতার পাল্লাই ভারী হয়নি, দেশের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন হয়েছে। যা আমাদের জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক। তিনি বলেন, বিশ্বায়নের এ যুগে আমাদের জিএসপি স্থগিতের ফলে আমাদের গার্মেন্ট শিল্প অনেকটাই পিছিয়ে গেছে।
ফারুক আহম্মেদ চৌধুরী বলেন, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী, এমপিরা জিএসপি নিয়ে রাজনৈতিকভাবে বিভিন্ন কথা বললেও বাস্তবতা হলো আমাদের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। যা পূরণ হওয়া অনেক কঠিন হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি সুবিধা স্থগিতের ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারের আমাদের গার্মেন্ট শিল্প আশঙ্কার মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত করতে হচ্ছে বলে জানান তিনি।
বিজিএমইর প্রথম সহ-সভাপতি নাসির উদ্দিন আহম্মেদ চৌধুরী বলেন, নিঃসন্দেহে এটা বর্তমান সরকারের জন্য একটি নৈতিবাচক দিক। জিএসপি যে সুবিধা আমরা যেভাবে পেতাম তাও এই সরকার থাকাকালে হারালাম। তিনি বলেন, সবকিছুর পরও এখন শ্রমিকদের উন্নয়নে কাজ হচ্ছে।
নাসির আহম্মেদ চৌধুরী বলেন, সরকারের অবহেলা এবং খামখেয়ালিপনার কারণেই আমাদের জিএসপি সুবিধা স্থগিত করা হয়েছে। এজন্য বিশ্বের কাছে আমাদের ইমেজের অনেক সংকট তৈরি হয়েছে।
উল্লেখ্য, এর আগে গত ২৭ জুন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশের সুবিধা বা জিএসপি স্থগিত করে মার্কিন সরকার।
বাংলাদেশে শ্রমিকদের কাজের নিরাপত্তার অভাবের কারণ দেখিয়ে এই সিদ্ধান্ত নেয় যুক্তরাষ্ট্র সরকার।
প্রসঙ্গত গত বছরের নভেম্বরের শেষের দিকে ঢাকার কাছে আশুলিয়ায় তাজরীন ফ্যাশন্স নামের একটি পোশাক কারখানায় অগ্নিকান্ডে ১১০ জনের মৃত্যু এবং তারপর মাত্র ৫ মাসের মাথায় সাভারে রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় এগারোশ’র বেশি শ্রমিক নিহত হওয়ার পর এ বিষয়ে বিশ্বব্যাপী সমালোচনার ঝড় ওঠে। বিষয়টি নিয়ে মার্কিন নির্বাচিত প্রতিনিধি এবং শ্রমিক অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন সংগঠনের চাপ বাড়তে থাকে।
এমন পটভূমিতে গত ২৭ জুন মার্কিন সরকার জিএসপি স্থগিতের ঘোষণা দেয়।