শেরে বাংলায় আবারও বাঘের গর্জন: বাংলাদেশের ভারত জয়
২২ জুন, ২০১৫
শেরে বাংলায় আবারও বাঘের গর্জন। সাতক্ষীরার বাঘ মুস্তাফিজুর রহমানের রণহুংকারে কম্পিত ভারত আবারও পর্যুদস্ত, পরাভূত। লাল-সবুজ আরও গাঢ়। মধ্যরাতের ফ্লাডলাইটের আলোয় উদ্ভাসিত আনন্দের রেণু। বাংলাদেশ আরও দুরন্ত, দুর্বার। অপরাজেয়, অপ্রতিরোধ্য। আরেকটি মুস্তাফিজ-কাব্যে সোনালি অধ্যায় রচিত হল বাংলাদেশের ক্রিকেটে। ধোনিদের দর্প চূর্ণ করে, বিশ্বকাপের শোকগাথা মুছে ফেলে মাশরাফির বাংলাদেশ রবিবাসরীয় মিরপুরে ফের ওড়ালো জয়কেতন। বৃষ্টিভেজা দ্বিতীয় ওডিআইতে ভারতকে ছয় উইকেটে হারিয়ে বাংলাদেশ এক ম্যাচ হাতে রেখে সিরিজই শুধু জিতে নিল না, ২০১৭ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে খেলারও যোগ্যতা অর্জন করল। বুধবার তৃতীয় ও শেষ ওডিআই এখন নিছক নিয়মরক্ষার ম্যাচে পরিণত হল। বাংলাদেশ ৫৪ বল বাকি থাকতে চার উইকেটে ২০০ রান করে জয়ের লক্ষ্যে পৌঁছে। সাকিব ৫১ ও সাব্বির ২২ রানে অপরাজিত থাকেন। সিরিজ জয়ের অপার আনন্দে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশ আনন্দে উন্মাতাল হয়ে ওঠে। রাতের নির্জনতা ভেঙে টাইগারভক্তদের উল্লাসধ্বনিতে উত্তাল হয়ে ওঠে পথপ্রান্তর। ঘরে ঘরে সে কী আনন্দ। ভারতের বিপক্ষে প্রথম সিরিজ জয়ের উন্মাদনায় যোগ হয় মুস্তাফিজুর বন্দনা। যার ৪৩ রানে ছয় উইকেটে লেখা হয় ইতিহাস। বৃষ্টির দরুন বাংলাদেশের টার্গেট নির্ধারিত হয় ৪৭ ওভারে ২০০। তামিম ইকবাল (১৩) সপ্তম ওভারেই বিদায় নিলেও সৌম্য (৩৪) ও লিটন (৩৬) দ্বিতীয় উইকেটে ৫২ রানের জুটি গড়েন। এ দু’জন আউট হওয়ার পর মুশফিকুর রহিম ও সাকিব আল হাসান হাল ধরেন। মুশফিকুর (৩১) রানআউট হলে এই জুটি ভাঙে। বাংলাদেশ তখন ৩০ ওভারে ৪/১৫২। এরপর সাকিব ও সাব্বির মিলে ধীরে ধীরে বাংলাদেশকে নিয়ে যান গন্তব্যের দিকে। মুস্তাফিজুর ম্যাজিকের পর সাকিবের দায়িত্বশীল ব্যাটিংয়ে ঘোরলাগা জয়ের নৌকা নোঙর করে স্বপ্নের বন্দরে। ম্যাচসেরা মুস্তাফিজুর জানিয়ে দেন, শেষ ম্যাচে এর থেকেও ভালো করতে চান। সেই ভালো হল ভারতকে প্রথমবারের মতো হোয়াইটওয়াশ করার হাতছানি। প্রথম ওয়ানডেতে বাংলাদেশ জিতেছিল ৭৯ রানে।
অভিষেকে দারুণ পারফরম্যান্সের পর হারিয়ে যাওয়া ক্রিকেটারের সংখ্যা কম নয়। কিন্তু মুস্তাফিজুর রহমান জানিয়ে দিলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটে ধ্রুবতারা হতে এসেছেন তিনি। অভিষেকে পাঁচ উইকেট নেয়ায় ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা যখন তাকে খেলার অনভিজ্ঞতার কথা বলে এড়িয়ে যাচ্ছিলেন, কাল বৃষ্টিমাখা আরেকটি ম্যাচে আরও বড় চমক হয়ে হাজির হলেন মুস্তাফিজ। ২০১১ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে অভিষেকের পর টানা দু’ম্যাচে পাঁচ উইকেট নেন জিম্বাবুয়ের ব্রায়ান ভিটোরি। কাল ইতিহাসের দ্বিতীয় ক্রিকেটার হিসেবে সেই কীর্তি গড়লেন মুস্তাফিজ। ভারতের ইনিংসের ৪৩.৫ ওভারের সময় বৃষ্টির কারণে দুই ঘণ্টা খেলা বন্ধ থাকে। পরে খেলা ৪৭ ওভারে নেমে এলেও মুস্তাফিজের তাণ্ডবে ৪৫ ওভারে ২০০ রানেই অলআউট হয় ভারত। ডাক ওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতিতে বাংলাদেশের লক্ষ্য দাঁড়ায় ২০০। ৪৩ রানে ছয় উইকেট নিয়ে মুস্তাফিজ একাই শেষ করে দেন ভারতকে। ক্যারিয়ারের প্রথম দুই ওয়ানডেতে ১১ উইকেট নেয়া ইতিহাসের প্রথম বোলার মুস্তাফিজ। প্রথম ম্যাচে হারের ক্ষত ভোলার জন্য তিন পরিবর্তন নিয়ে মাঠে নামে ভারত। তবে পারফরম্যান্সে পরিবর্তন আনতে পারেননি ধোনিরা। প্রথম ওয়ানডেতে ভারতের একমাত্র হাফ সেঞ্চুরিয়ান রোহিত শর্মাকে কাল কিছু বুঝতেই দিলেন না মুস্তাফিজ। টস জিতে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে দ্বিতীয় বলেই মুস্তাফিজের শিকার হলেন তিনি। প্রথম ম্যাচের পর অনেকেই বলেছেন, মুস্তাফিজ নতুন বোলার, তার সম্পর্কে ভারতের ধারণা ছিল কম। দ্বিতীয় ম্যাচে প্রস্তুত হয়েই নেমেছিলেন ধোনিরা। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হল না। ১৯ বছর বয়সী পেসারের কাটারই আবার কাঁটা হয়ে দেখা দিল ভারতের জন্য। নিজের দ্বিতীয় বলে উইকেট নিয়ে শুরু, শেষ বলেও পেয়েছেন উইকেট। আরেকটি মুস্তাফিজময় দিনে ভারতের পঞ্চাশোর্ধ্ব রানের জুটি হয়েছে মাত্র দুটি। ধাওয়ান-কোহলির ৭৪ ও রায়না-ধোনির ৫৩ রান। বাংলাদেশ সফরে এখনও বড় স্কোর করতে পারেননি কোহলি। কাল দেখেশুনে খেলে বড় স্কোর করারই আভাস দিয়েছিলেন তিনি। তবে মুস্তাফিজের দিনে দুই উইকেট নিয়ে বাংলাদেশের কাজটা সহজ করে দিয়েছেন পার্ট টাইমার নাসির হোসেন। শিখরের সঙ্গে কোহলির ৭৪ রানের জুটি ভাঙেন তিনি। কোহলিকে ফেরান ২৩ রানে। এরপর একমাত্র হাফ সেঞ্চুরিয়ান ধাওয়ানকেও ফিরিয়েছেন নাসির। বোলিংয়ের পরের সময়টা মুস্তাফিজেরই। এর মধ্যে রুবেল দুই উইকেট নিয়ে কিছুটা সহযোগিতা করেছেন বটে।
প্রথম স্পেলে মুস্তাফিজ পাঁচ ওভারে ৩২ রানে ওই একটি উইকেটই নেন। কিন্তু দ্বিতীয় স্পেলে ফেরেন ভয়ংকর রূপে। পাঁচ ওভারে ১১ রানে পাঁচ উইকেট! ধোনি (৪৭), সুরেশ রায়না (৩৪), অক্ষর প্যাটেল (০) ও অশ্বিনকে ফেরানোর পর নিজের শেষ ওভারের এক বল বাকি থাকতে বৃষ্টি শুরু হয়। প্রায় দুই ঘণ্টা খেলা বন্ধ থাকার পর শেষ বলে জাদেজাকে ফিরিয়ে ছয় উইকেট তুলে নেন মুস্তাফিজ। ইনিংসের ৪৫তম ওভারের শেষ বলে ভুবনেশ্বর কুমারকে উইকেটের পেছনে ক্যাচ বানিয়ে তুলির শেষ আঁচড় টানেন রুবেল হোসেন। মুস্তাফিজের ছয় উইকেটের পাশাপাশি নাসির ও রুবেলের ঝুলিতে গেছে দুটি করে উইকেট। তবে পাদপ্রদীপের সবটুকু আলো ছিল মুস্তাফিজের ওপর। তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ সবাই। ভারতের ইনিংস শেষে তরুণ সতীর্থকে নিয়ে মুগ্ধতা ঝরল সাকিব আল হাসানের কণ্ঠে, ‘অবিশ্বাস্য বোলিং করেছে মুস্তাফিজ। বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় পাওয়া সে। বয়স মাত্র ১৯ বছর। যেভাবে পারফর্ম করছে ওর ভবিষ্যৎ খুবই উজ্জ্বল।’