শুক্রবার শুরু হচ্ছে বিশ্ব ইজতেমা

21/01/2014 9:01 pmViews: 6
শুক্রবার শুরু হচ্ছে বিশ্ব ইজতেমা
টঙ্গী : রাজধানীর উপকণ্ঠ শিল্প শহর টঙ্গীর তুরাগ তীরে আগামী শুক্রবার থেকে শুরু হচ্ছে ৪৯তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব। ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের স্বাগত জানাতে প্রস্তুত তুরাগ তীর। শুক্রবার বাদ ফজর আম বয়ানের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম দফার কার্যক্রম শুরু হবে বলে জানিয়েছেন ইজতেমা আয়োজক কমিটি।

এরই মধ্যে বিভিন্ন রাষ্ট্র থেকে কয়েক হাজার মুসল্লি ইজতেমা ময়দানে অবস্থান নিয়েছেন। রোববার দুপুরে আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে প্রথম দফা শেষ হবে। হজের পর এটিকে মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমাবেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

চার দিন বিরতি দিয়ে ৩১ জানুয়ারি শুরু হবে ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব। আগামী ২ ফেব্রুয়ারি রোববার জোহরের আযানের আগে আখেরী মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে এবারে দু’দফার বিশ্ব ইজতেমা।

গাজীপুরের তৎকালীন পুলিশ সুপার (বর্তমানে ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি) মাহফুজ নুরুজ্জামানের অনুরোধে তাবলীগ জামাত কর্তৃপক্ষ গত ২০১১ সাল থেকে দু’দফায় বিশ্ব ইজতেমার আয়োজন করে আসছে।

এরই মধ্যে এবারের দু’দফার ইজতেমার সব প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন্ করেছে তাবলীগ জামাত কর্তৃপক্ষ। সেই সঙ্গে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিভাগ, দফতর, অধিদফতর ও সংস্থা ইজতেমা আয়োজন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে।

প্রস্তুত ময়দান : টঙ্গীর তুরাগ তীরে ১৬৭ একর আয়তনের ময়দানে ১৯৬৭ সাল থেকে শুরু হওয়া এ ইজতেমায় প্রতি বছর লাখো মানুষের ঢল নামে। ইজতেমায় লাখো মানুষকে জায়গা দিতে এবারো মাঠজুড়ে তাঁবু টানানো, মিম্বর, হাউজ, টয়লেট, খিত্তা, খিত্তার খুঁটি, মোকাব্বের পয়েন্ট, জুড়নেওয়ালী পয়েন্ট, ওজুখানা, বিদ্যুতের সংযোগ, ঘুমানোর জায়গা তৈরি ও মুরব্বীদের বয়ানের মঞ্চ তৈরির কাজ প্রায় সম্পন্ন হয়েছে। বিদেশি মেহমানদের জন্য ভাষাওয়ারি টেন্ট নির্মাণের কাজও শেষ করেছে কর্তৃপক্ষ।

প্রতিবারের ন্যায় এবারো মধ্যপ্রাচ্য তথা আরবি ভাষাভাষীদের জন্য সবচেয়ে বড় টেন্ট নির্মাণ করা হয়েছে। ইজতেমা ময়দানের উত্তর-পশ্চিম কোণে মাঠের উঁচু স্থানে টিন দিয়ে বিশেষভাবে নির্মিত এসব বিদেশি তাঁবুতে থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থাসহ সব ধরনের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে বলে জানান ইজতেমা বাস্তবায়ন কমিটি।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক প্রস্তুতি : বিশ্ব ইজতেমা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। ইজতেমায় এবার পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা বলয় গড়ে তুলবে পুলিশ। প্রতি স্তরের দায়িত্বে থাকবেন একজন করে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার।

ইজতেমার প্রথম দফায় প্রায় ১২ হাজার ও দ্বিতীয় দফায় প্রায় ১০ হাজার পুলিশ সদস্য মোতায়েন থাকবে বলে জেলা পুলিশ সুপার অফিস সূত্রে জানা গেছে। সেই সঙ্গে থাকছে র‌্যাবের পৃথক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। নাশকতা প্রতিরোধে ইজতেমা ময়দান এলাকায় আকাশে র‌্যাবের হেলিকপ্টার টহল ও ময়দানে বোমাস্কোয়াড, গোয়েন্দা টিমসহ বিভিন্ন টিম প্রস্তুত রাখা হচ্ছে।

ইজতেমা ময়দান ঘুরে দেখা গেছে, ময়দানের বিভিন্ন প্রবেশপথসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে র‌্যাবের  সিসি ক্যামেরা ও ওয়াচ টাওয়ারসহ চেকপোস্ট তৈরির কাজ প্রায় শেষের পথে। টঙ্গী-আশুলিয়া সড়কের সঙ্গে ইজতেমা ময়দানের সংযোগ স্থাপন করতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের সদস্যরা তুরাগ নদীতে আটটি ভাসমান সেতু স্থাপন করেছেন।

র‌্যাব-১ এর ডিআইডি কবির জানান, তারা এবার অর্ধশতাধিক সিসি ক্যামেরা বসাবেন। প্রথম দিন থেকেই তাদের ৩০ জন কন্ট্রোলার এগুলো পর্যবেক্ষণ করবেন। এছাড়া থাকছে দু’টি কন্ট্রোল রুম ও ৫০টির বেশি চেকপোস্ট।

এদিকে, প্রতিবারের ন্যায় এবারো ইজতেমা ময়দানের উত্তর পাশে নিউ মন্নু ফাইন কটন মিলের আঙ্গিনায় র‌্যাব, পুলিশ, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই), গাজীপুর সিটি ও জেলা প্রশাসন এবং বিদ্যুৎ বিভাগসহ বিভিন্ন দফতরের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ চালু করা হচ্ছে।

নির্ধারিত খেত্তায় জেলাওয়ারী মুসল্লীদের অবস্থান : তৃতীয় বারের মতো দুই দফায় অনুষ্ঠিতব্য এবারের ইজতেমায় প্রথম দফায় ৩২টি জেলা এবং দ্বিতীয় দফায় ৩২টি জেলার মুসল্লীরা অংশ নিচ্ছেন। প্রথম দফায় ইজতেমা ময়দানে জেলাওয়ারী মুসল্লীদের অবস্থান হলো- গাজীপুর- খিত্তা নং-১ ও ২, ঢাকা-৩, ৪, ৫, ৬, ৭(ক), ৭(খ), ৮, ৯, ১০, ১১, ১২, সিরাজগঞ্জ-১৩, ফরিদপুর-১৪, নরসিংদী-১৫, কিশোরগঞ্জ-১৬(ক), কিশোরগঞ্জ-১৬(খ), রাজবাড়ী-১৭, শরীয়তপুর-১৮, নাটোর-১৯, শেরপুর-২০, দিনাজপুর-২১, হবিগঞ্জ-২২, রংপুর-২৩, লালমনিরহাট-২৪, গাইবান্ধা-২৫, জয়পুরহাট-২৬, রাজশাহী-২৭, সিলেট-২৮, চাঁদপুর-২৯, ফেনী-৩০, চট্টগ্রাম-৩১, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি-৩২, বাগেরহাট-৩৩, কুষ্টিয়া-৩৪, নড়াইল-৩৫, চুয়াডাঙ্গা-৩৬, যশোহর-৩৭, ভোলা-৩৮, বরগুনা-৩৯ এবং ঝালকাঠি-৪০নং খিত্তায়।

দ্বিতীয় দফার ইজতেমায় (৩১ জানুয়ারি থেকে ২ ফেব্রুয়ারি) খিত্তাওয়ারী জেলার অবস্থান হচ্ছে, নারায়ণগঞ্জ-১ ও ২, ঢাকা-১, ২, ৩ ও ৪, কক্সবাজার-৫, মানিকগঞ্জ-৬, পিরোজপুর-৭, পটুয়াখালী-৮, টাঙ্গাইল-৯(ক) ও টাঙ্গাইল-৯(খ), জামালপুর-১০, বরিশাল-১১, নেত্রকোণা-১২, কুমিল্লা-১৩, মেহেরপুর-১৪, জিনাইদহ-১৫, ময়মনসিংহ-১৬, ১৭ ও ১৮, লক্ষ্মীপুর-১৯, বি-বাড়িয়া-২০, কুড়িগ্রাম-২১, নোয়াখালী-২২, নিলফামারী-২৩, ঠাকুরগাঁও-২৪, পঞ্চগড়-২৫, চাপাইনবাবগঞ্জ-২৬, বগুড়া-২৭, পাবনা-২৮, নওগাঁ-২৯, মুন্সিগঞ্জ-৩০ ও ৩১, মাদারীপুর-৩২, গোপালগঞ্জ-৩৩, সাতক্ষীরা-৩৪, মাগুড়া-৩৫, খুলনা-৩৬, সুনামগঞ্জ-৩৭ এবং মৌলভীবাজার-৩৮নং খিত্তায়।

বিশুদ্ধ খাবার ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ভ্রাম্যমাণ আদালত : গাজীপুরের জেলা প্রশাসক মো. নূরুল ইসলাম জানিয়েছেন, ভেজাল প্রতিরোধ ও হোটেল রেস্তোরাঁগুলোতে বিশুদ্ধ খাবার সরবরাহ নিশ্চিত করতে ১২টি মোবাইল কোর্ট পর্যায়ক্রমে দায়িত্ব পালন করবে। এছাড়া ইজতেমার বিঘ্ন ঘটে এ ধরনের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের জন্য চারজন ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োজিত থাকবেন।

এ বছর বেসরকারি উদ্যোক্তাদের ইজতেমায় স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের জন্য কিছু শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। বেসরকারি উদ্যোক্তাদের ফ্রি চিকিৎসা কেন্দ্রে ন্যূনতম এমবিবিএস ডাক্তার রাখা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। উদ্যোক্তারা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে চিকিৎসা ক্যাম্প পরিচালনা করতে পারবেন না। সম্পূর্ণ সেবা প্রদানের উদ্দেশ্যে পরিচালিত এসব চিকিৎসা কেন্দ্রে উদ্যোক্তাদের নিজস্ব কোম্পানির কোনো প্রচারপত্র যেমন সাইনবোর্ড, ব্যানার ইত্যাদি ব্যবহার করতে পারবে না।

টয়লেট ব্যবহার : বিদেশি মুসল্লীদের জন্য গত বছর ৩২শ’ পাকা টয়লেট ছিল। এ বছর একটি পাকা দ্বিতল গোসলখানা ছাড়াও চার হাজার পাকা টয়লেট প্রস্তুত রাখা হয়েছে। অর্থাৎ এ বছর একইসঙ্গে চার হাজার বিদেশি মেহমান স্বাস্থ্য সম্মত পাকা টয়লেট ব্যবহার করতে পারবেন। ফলে টয়লেট ব্যবহারের জন্য আগের মতো লাইন ধরে অপেক্ষা করতে হবে না বলে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের কর্মকর্তারা আশা করছেন।

তবে লাখ লাখ দেশি মুসল্লীর জন্য পাকা টয়লেটের সংখ্যা নিতান্তই কম। ময়দানের বিভিন্ন প্রান্তে আটটি দ্বিতল টয়লেট ভবনে মাত্র ২৯৩৮ জনের একসঙ্গে টয়লেট ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। তবে তাবলীগ জামাতের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ময়দানের চারপাশে নির্ধারিত স্থানে বহুসংখ্যক অস্থায়ী টয়লেট নির্মাণ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে অজু ও গোসলখানা।

ইজতেমায় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ সূত্রে জানা গেছে, ১৩টি উৎপাদক নলকূপের মাধ্যমে সাড়ে ১২ কিলোমিটার পাইপ লাইন দিয়ে পুরো ময়দান এলাকায় দৈনিক ৭০ লাখ গ্যালন পানি সরবরাহ করা হবে।

বিশেষ বাস ও ট্রেন সার্ভিস : ইজতেমা উপলক্ষে রেল বিভাগ এবার ২২টি বিশেষ ট্রেন সার্ভিস চালু করছে। প্রত্যেক ট্রেন ইজতেমা শুরুর তিন দিন আগ থেকেই টঙ্গী স্টেশনে দুই মিনিট করে বিরতি নেবে। টঙ্গী রেলওয়ে জংশন সূত্রে জানা গেছে, আখেরি মুনাজাতের আগের দু’দিন প্রথম দফায় ২৪ ও ২৫ জানুয়ারি জামালপুর-টঙ্গী একটি, আখাউড়া-টঙ্গী একটি, লাকসাম-টঙ্গী একটি ট্রেন চলবে।

এছাড়াও আখেরি মুনাজাতের দিন ঢাকা-টঙ্গী, টঙ্গী-ঢাকা সাতটি, টঙ্গী-লাকসাম একটি, টঙ্গী-আখাউড়া দু’টি, টঙ্গী-ময়মনসিংহ চারটি এবং ঈশ্বরদী-টঙ্গী-ঈশ্বরদী একটি ট্রেন যাতায়াত করবে।

ইজতেমার দ্বিতীয় দফায় ৩১ জানুয়ারি থেকে ১ ফেব্রুয়ারি জামালপুর-টঙ্গী একটি, আখাউড়া-টঙ্গী একটি এবং ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা-টঙ্গী, টঙ্গী-ঢাকা একটি করে ট্রেন চলবে। এছাড়া ইজতেমা ময়দান থেকে বিভিন্ন রুটে প্রায় ৩০০টি বিশেষ বাস চলাচল করবে বলে বিআরটিসি সূত্রে জানা গেছে।

দাওয়াত নিয়ে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে প্রায় ছয় হাজার জামাত : তাবলীগ জামাতের অন্যতম মুরব্বী সাবেক সচিব ইরশাদুল হক বলেন, একমাত্র আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের একক আনুকূল্যে এই ইজতেমা হয়ে থাকে। এর একমাত্র লক্ষ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন।

তিনি পবিত্র কুরআনের একটি আয়াত উদ্ধৃত করে বলেন, আল্লাহ’র দিকে ডাকাই সর্বোত্তম কাজ। তাবলীগের একমাত্র কাজই আল্লাহ’র পথে মানুষকে ডাকা। রাসূল (সা:) এর বিদায় হজ্জের ভাষণের মূলবাণী হিসেবে আমরা আল্লাহর পথে ডেকে থাকি।

তিনি বলেন, বিশ্বের ১৫০টি দেশে এই কাজ করা হয় টঙ্গীর এই ইজতেমা থেকেই। প্রতি বছর টঙ্গী ইজতেমা থেকেই পাঁচ থেকে ছয় হাজার জামাত বিশ্বব্যাপী পাঠানো হয়। আগত বছরের বিশাল কর্মযজ্ঞের পরিকল্পনা টঙ্গী থেকেই হয়। এবারো প্রায় ছয় হাজার জামাত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাবলীগের কাজে বেরিয়ে যাবে বলে জানান তিনি।

Leave a Reply