শাসন নয় জনগণের সেবা করছি : প্রধানমন্ত্রী
ক্ষমতা কুক্ষিগত করার অভিযোগ নাকচ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বলেছেন, জনগণের কল্যাণের জন্যই কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। ব্রিটিশ সংবাদপত্র গার্ডিয়ানকে ঢাকায় দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন তিনি। শেখ হাসিনা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গণগ্রেফতার, সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের অভিযোগগুলো (যেগুলো দেশকে কার্যত একদলীয় শাসনের দিকে নিয়ে যায়) নাকচ করেন।
মানবাধিকার লংঘন ও আইনের শাসন হরণের মধ্য দিয়ে বর্তমান সরকার দেশে কর্তৃত্ববাদী শাসন কায়েমের চেষ্টা করছে বিরোধীদের এমন অভিযোগ অস্বীকার করেন শেখ হাসিনা। তার কাজ হচ্ছে সাধারণ মানুষকে সহায়তা করা এমন দাবি করে বাংলাদেশের সরকারপ্রধান বলেন, ‘আমি জনগণের জন্য রাজনীতি করি। নিজের জন্য নয়। দেশের জনগণ এখন প্রকৃত গণতান্ত্রিক শাসনের মধ্যে আছে। জনগণ চায় তার মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ হোক। সে চাহিদাগুলো যাতে নিশ্চিত হয় সেজন্য আমি জনগণকে সহায়তা করে যাচ্ছি। তথা খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, চাকরি সুবিধা, জীবনমানের উন্নয়নে আমি কাজ করছি।’ ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশে মধ্য আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালে উন্নত দেশে পরিণত হবে এমন আশা ব্যক্ত করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, আজ দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান কার্যকর। জনগণ তৃপ্ত। সুতরাং আপনি কিভাবে বলেন যে, আমি কর্তৃত্বপরায়ণ, প্রশ্ন রাখেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘আমি ক্ষমতা কুক্ষিগত করছি না। বরং আমি জনগণের সেবা করছি।’
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার লন্ডনে অবস্থানের মধ্যেই সোমবার এ সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করে গার্ডিয়ান। খালেদা দাবি করে আসছেন, শেখ হাসিনার শাসনে বাংলাদেশ এখন ‘গণতন্ত্রহীন’। গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বাংলাদেশ রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমিতির চেয়ারম্যান আতাউর রহমান, ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামানের বক্তব্যও আসে। তারা প্রত্যেকেই বর্তমান সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমের কড়া সমালোচনা করেন।
আতাউর রহমান বলেন, সরকারের কর্তৃত্বমূলক শাসনের ফলে গণতন্ত্রের প্রতি জনগণের আস্থা কমে আসছে। বাংলাদেশে কর্তৃত্বমূলক শাসন এখন এক ব্যক্তির শাসনের দিকে যাচ্ছে। এর ফল হিসেবে গণতন্ত্র এখন খাদের কিনারায়। তিনি আরও বলেন, দেশের বেশিরভাগ সরকারি প্রতিষ্ঠান যেমন- পুলিশ, বিচার বিভাগ দিন দিন কর্তৃত্ব-স্বকীয়তা হারাচ্ছে। আমলারা স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতা হারিয়েছে। সুশীল সমাজ চাপের মুখে রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়, গণমাধ্যম ও সামাজিক গণমাধ্যমগুলোকে চাপে রাখা হয়েছে। সেল্ফ সেন্সরশিপ কায়েম করা হচ্ছে।
দেশের অরাজকময় পরিস্থিতির বর্ণনা দিতে নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রাক্তন একজন জেনারেল বলেন, ‘রাতের আঁধারে যে কেউ গুম হচ্ছেন। আমি সেই দলে অন্তর্ভুক্ত হতে চাই না।’ তিনি বলেন, ২০১৪ সালের প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতার থাকার নৈতিক ভিত্তি হারিয়েছে। তাই র্যাব, পুলিশ, বিজিবি, আমলা, সেনাবাহিনীকে কব্জায় রেখে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় টিকে থাকতে চাইছেন। তার পছন্দের লোকজন সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানরা। সেনাবাহিনীর বেতন বাড়িয়ে, তাদের জাতিসংঘ শান্তি মিশনে পাঠিয়ে খুশি করতে চাইছে সরকারপ্রধান।
বাংলাদেশ এক ‘অভূতপূর্ব’ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দাবি করে সাংবাদিক মাহফুজ আনাম বলেন, সরকার বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে নিঃশেষ করে ফেলেছে। এখন গণমাধ্যমের সমালোচনায় নেমেছে। বিরুদ্ধ মত সহ্য করতে পারছে না তারা। সমালোচনা সত্ত্বেও মাহফুজ আনাম শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, শেখ হাসিনা তার দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আজ ক্ষমতায় শীর্ষবিন্দুতে অবস্থান করছেন।
বাংলাদেশের পরিস্থিতি অবনতিশীল দাবি করে তার প্রভাব আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্যও সুখকর হবে না বলে মন্তব্য করেন টিআইবি নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, বাংলাদেশ একটি বিশেষ পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে। যেটি হবে খুবই বিশৃংখালময়। সেটি বাংলাদেশের জন্য শুভ হবে না, বলেন ইফতেখারুজ্জামান।
এসব অভিযোগের উত্তরে সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার কাজ সাধারণ মানুষের উন্নয়ন। আমার রাজনীতি সাধারণ মানুষের জন্য, নিজের জন্য নয়… জনগণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আছে। খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও চাকরির ব্যবস্থা করছি।’
গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে তার সরকারের সময় বেসরকারি টেলিভিশন চালুর কথা বলেন। শেখ হাসিনা প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘এ পরিবর্তনটা কে এনেছে? এই আমি, আমিই সেই বন্ধ দুয়ার খুলে দিয়েছিলাম। এখন ৪১টি প্রাইভেট টেলিভিশন চ্যানেল, প্রায় ৭০০ সংবাদপত্র। তারা লিখছে, স্বাধীনভাবেই লিখছে। এনজিওগুলো তাদের নিয়ম-নীতির মধ্যেই কাজ করছে।’
২০০৮ সালের নির্বাচনে সরকার গঠনের পর ২০১৪ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। বিএনপির বর্জনের মধ্যে অনুষ্ঠিত ৫ জানুয়ারির ওই নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক মহল প্রশ্ন তুলেছিল। ওই নির্বাচনে খালেদা জিয়াকে আনতে নিজে উদ্যোগী হয়ে টেলিফোন করার কথা গার্ডিয়ানকে বলেন শেখ হাসিনা। সেই সঙ্গে ভোট ঠেকাতে বিরোধী জোটের নাশকতার ঘটনাগুলোও তুলে ধরেন তিনি। ‘নির্বাচনে অংশ না নিয়ে রাজনৈতিক ভুল করেছেন (খালেদা),’ বলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী। বিএনপি ভোট কারচুপির অপপ্রচার প্রমাণ করতেই নির্বাচনে অংশ নেয়নি বলে মন্তব্য করেন শেখ হাসিনা।
যুক্তরাজ্যের উদাহরণ টেনে সাক্ষাৎকারের শেষদিকে শেখ হাসিনা গার্ডিয়ানকে বলেন, ‘আমরা ওয়েস্টমিনস্টার টাইপ গণতন্ত্র অনুশীলন করছি। জনগণ যতক্ষণ চায়, আমি (ক্ষমতায়) আছি। তারা যদি না চায়, তাহলে নেই। তবে ক্ষমতায় থাকি বা না থাকি, জনগণের জন্যই কাজ করব এবং তাই করছি,’ বলেন শেখ হাসিনা।