রাজনীতি নিয়ে উদ্বেগ ও আশঙ্কা

23/09/2013 5:42 pmViews: 9

EDITOREAL-12323456654বিভুরঞ্জন সরকার : রাজনীতির আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা। দেশের ভবিষ্যত্ রাজনীতি নিয়ে আশার কথা শোনাতে পারছেন না কেউ। ২৫ অক্টোবরের পর পরিস্থিতি কি দাঁড়াবে সে প্রশ্ন এখন মুখে মুখে। বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া নির্দলীয় সরকারের দাবি মেনে নেয়ার জন্য সরকারকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন। ২৫ অক্টোবরের পর দেশ অচল করে দেয়ার হুমকি দেয়া হচ্ছে বিএনপির পক্ষ থেকে। বিএনপির এই হুমকি সরকার খুব গায়ে মাখছে বলে মনে হয় না। বেগম জিয়ার আন্দোলনের হুমকিতে সরকার বিচলিতবোধ না করার কারণ এ ধরনের হুমকি গত সাড়ে চার বছরে তিনি অসংখ্যবার দিয়েছেন। ফলে বিষয়টি সরকারের গা-সওয়া হয়ে গেছে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হওয়ার পর থেকে বেগম জিয়া ওই সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য আন্দোলন করে আসছেন। ২০১২ সালের ১২ মার্চ ঢাকার এক জনসভা থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মানতে সরকারকে ৯০ দিনের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন বেগম জিয়া। সরকার ৯০ দিনের মধ্যে দাবি মানেনি। এরপর ১১ জুন আরেক সমাবেশ থেকে বেগম জিয়া কোনো তারিখ উল্লেখ না করে ঈদুল ফিতর পর্যন্ত সময় দিয়েছিলেন সরকারকে। ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা চলে গেলেও সরকার দাবি মানেনি, বেগম জিয়াও আন্দোলন করে সরকারকে দাবি মানতে বাধ্য করতে পারেননি। সর্বশেষ চলতি বছর ৪ মে মতিঝিল শাপলা চত্বরে অনুষ্ঠিত এক সমাবেশ থেকে বেগম জিয়া সরকারকে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়ে বলেছিলেন, ওই সময়ের মধ্যে দাবি না মানলে সরকার পালানোর পথ পাবে না। বেগম জিয়ার বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে সরকার দাবিও মানেনি, পালানোর পথও খুঁজেনি। তাই এখন বেগম জিয়া ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত যে সময় বেঁধে দিয়েছেন তার মধ্যে সরকার দাবি না মানলে আন্দোলন করে সরকারকে পরাস্ত করা সম্ভব হবে কি না সে ব্যাপারে মানুষের মধ্যে সংশয় রয়েছে। আন্দোলন করে দাবি আদায়ের কোনো রেকর্ড বিএনপির নেই।

অবশ্য এবার বিএনপির আন্দোলনের সঙ্গে তাল রেখে জামায়াতে ইসলামীও মাঠে নামবে। মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত ও দণ্ডিত দলীয় নেতাদের মুক্ত করতে জামায়াতে ইসলামী ইতিমধ্যেই আন্দোলনের নামে দেশজুড়ে ব্যাপক সন্ত্রাস-সহিংসতা শুরু করে দিয়েছে। জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত। এই রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াত ১৮ ও ১৯ সেপ্টেম্বর দেশব্যাপী ৪৮ ঘণ্টার হরতাল পালন করেছে। জামায়াতের হরতাল শান্তিপূর্ণ হয়নি। ৪৮ ঘণ্টার হরতালও ব্যাপক সহিংসতার মধ্য দিয়েই পালন করেছে জামায়াত। দুইদিনে কমপক্ষে ৮ জনের মৃত্যু ঘটেছে। হরতালের সময় জামায়াত-শিবিরের পিকেটারদের হাতে বগুড়ায় একজন ট্রাক চালক ও গাজীপুরে একজন বাস চালক অগ্নিদগ্ধ হয়ে হাসপাতালে চিকিত্সাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন। ১৮ সেপ্টেম্বর হরতালের সময় জামায়াত-শিবিরের ক্যাডাররা চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার জোটপুকুরিয়া পুলিশ ফাঁড়িতে অতর্কিত হামলা চালিয়ে কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে আহত করেছে। এরমধ্যে পুলিশ সদস্য ইকবাল হোসেনকে গুরুতর অবস্থায় ঢাকার মহাখালী বক্ষব্যাধি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তিনি বুকে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। এছাড়াও নোয়াখালীর চাটখিল, মেহেরপুর, চট্টগ্রামসহ কয়েকটি স্থানে জামায়াত-শিবিরের ক্যাডাররা পুলিশকে লক্ষ্য করে বোমা নিক্ষেপ ও ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। সিলেটে পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর করেছে। এভাবে দেশব্যাপী তাণ্ডব চালিয়ে জামায়াত-শিবির মানুষের মনে ব্যাপক আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে পুলিশকে টার্গেট করে জামায়াত-শিবির আক্রমণ পরিচালনা করায় এটা ধারণা করা হচ্ছে যে দেশে বড় ধরনের অরাজকতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার লক্ষ্য নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে জামায়াত।

২৫ অক্টোবরের পর নির্দলীয় সরকারের দাবিতে বিএনপির আন্দোলনের সঙ্গে জামায়াত-শিবির এমনকি হেফাজতে ইসলাম যুক্ত হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাবে কি-না, সেই প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই উঠছে। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া রংপুরের জনসভায় বলেছেন, ‘ভোট চাইতে নয়, ভোট রুখতে এসেছি’। তার কথার জবাব দিয়ে সিলেটের জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রশ্ন রেখেছেন, ‘তিনি ভোট চান না, নির্বাচন চান না। তাহলে কী চান? অরাজকতা, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, দুর্নীতি?’ প্রধানমন্ত্রী দৃঢ়তার সঙ্গেই বলেছেন, যে কোনো মূল্যে যথাসময়ে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বিএনপি নেত্রীর সাধ্য নেই এই নির্বাচন বানচাল করার।

দুই নেত্রীর অনড় অবস্থানের পরিণতি কি সেটা কেউ বলতে পারে না। তবে এতে যে দেশের রাজনীতি ও মানুষের কোনো মঙ্গল হবে না সেটা বলা যায় জোর দিয়েই। জেদাজেদির রাজনীতিতে সাধারণ মানুষের কল্যাণের কিছু থাকে না। অথচ জনগণের কল্যাণ করাই ছিল একসময় রাজনীতির, রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক দলের একমাত্র লক্ষ্য। মানুষের ভালো করার জন্য, সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা-দুর্ভোগ লাঘব করাই ছিল রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিবিদদের প্রধান উদ্দেশ্য। মানুষের জন্য রাজনীতি করে বছরের পর বছর কারাগারে কাটিয়ে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় উত্সর্গ করে মানুষের কাছে শ্রদ্ধাভাজন হয়েছেন, মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন— এমন রাজনীতিবিদ আমাদের দেশে সংখ্যায় দুচারজন নন, অসংখ্য ছিলেন। রাজনীতি করতে গিয়ে শুধু জীবনের মূল্যবান সময় নয়, সহায়-সম্পদও হারিয়েছেন, নিঃস্ব হয়েছেন এমন রাজনীতিবিদও আমাদের দেশে কম ছিলেন না। নীতিবোধ, আদর্শবোধ, ন্যায়পরায়নতা, ইনসাফ প্রতিষ্ঠা— এসব ছিল রাজনীতির বৈশিষ্ট্য। কিন্তু এখন দিন বদলেছে, সময় বদলেছে। রাজনীতি এখন সাধারণ মানুষের স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তিস্বার্থেই বেশি পরিচালিত হচ্ছে। রাজনীতি এখন লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। কম বিনিয়োগে বেশি মুনাফা অর্জনের অন্যতম পথ হলো এখন রাজনীতি। আগে রাজনীতিবিদরা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা নিয়ে দল চালাতেন, কিন্তু রাজনৈতিক দলের নিয়ন্ত্রণটা রাজনীতিবিদদের হাতেই থাকত। এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। এখন ব্যবসায়ীরা রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিবিদদের যেমন চাঁদা দেন, তেমনি নিজেরা সরাসরি রাজনৈতিক দলের সদস্য হয়ে, নেতা হয়ে, এমপি হয়ে, মন্ত্রী হয়ে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেন। ফলে সাধারণ মানুষের কল্যাণ নয়, ব্যবসায়ী এবং স্বার্থবাদী মহলের স্বার্থেই মূলত চালিত হচ্ছে রাজনীতি।

গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে পালাক্রমে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ দেশ শাসন করে আসছে, কখনও এককভাবে, কখনও জোটবদ্ধভাবে। বিএনপি যখন ক্ষমতায় থাকে তখন তারা শাসক দলে পরিণত হয়। আবার আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় থাকে তখন তারা হয় শাসক দল। আর শাসক দল মানেই জনবিচ্ছিন্নতা, গণস্বার্থ পরিপন্থী কাজে বেশি উত্সাহ। তবে বিরোধী দলে থাকলেও এই দুই দল জনগণকে নিয়ে তেমন ভাবনা-চিন্তা করে বলে মনে হয় না। নেতানেত্রীদের বক্তৃতায় অবশ্য ‘জনগণ’, ‘সাধারণ মানুষ’— এসব শব্দ উচ্চারিত হয় প্রায়ই, কিন্তু তা ওই বক্তৃতাতেই সীমাবদ্ধ। উদাহরণ হিসেবে বিএনপির কথাই ধরা যাক। এই দলটি গত মেয়াদে শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল। অবশ্যই এককভাবে নয়। জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করেছিল। জামায়াত মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দল। তারা গণতন্ত্রেরও পরিপন্থী, যদিও প্রকাশ্যে তারা গণতন্ত্রী সেজেই রাজনীতি করে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা তাদের নিজস্ব মডেলের ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য নিয়ে রাজনীতি করছে। জামায়াতের মতো একটি গণবিরোধী, ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জোটগতভাবে অগ্রসর হয়ে বিএনপি গণস্বার্থে কাজ করবে, এটা আশা করা যেতে পারে, তবে সে আশা পূরণ হওয়ার নয়। বিএনপি-জামায়াত জোট শাসনে দেশের মানুষ যে ভালো ছিল না, তাদের কোনো স্বার্থ রক্ষায় যে সরকার এগিয়ে আসেনি সেটা কারো অজানা নয়। বরং কৃষক ন্যায্যমূল্যে সার চাইতে গিয়ে গুলি খেয়ে জীবন দিয়েছে। ফসলের মাঠে পানি সেচের জন্য বিদ্যুত্ চাইতে গিয়েও বিদ্যুতের বদলে পেয়েছে গুলি। বিএনপি-জামায়াত জোটের শাসনকালে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানের নেতৃত্বে ‘হাওয়া ভবন’ নামে যে ক্ষমতাকেন্দ্র গড়ে উঠেছিল, তার সঙ্গে কোনো সাধারণ মানুষের কি কোনোভাবেই কোনো সম্পৃক্ততা ছিল? নাকি ক্ষমতাবান, ধনবানদের ক্ষমতা ও ধনসম্পদ আরও বাড়ানোর কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল ওই ভবন? ‘হাওয়া ভবন’ দেশের গরিব মানুষের স্বার্থে, শ্রমজীবী-কর্মজীবী-কৃষক-মজুরের স্বার্থে কোনো কাজ করেছে, তার একটি দৃষ্টান্তও কি খুঁজে পাওয়া যাবে?

বর্তমানে বিএনপি বিরোধী দলে, এখন তারা শাসক দল নয়। বিরোধী দলে থেকেও কি এই দল গণস্বার্থ সংরক্ষণে কোনো ভূমিকা রাখছে বা কাজ করছে? বিরোধী দল হরতালসহ যেসব কর্মসূচি পালন করে তার মধ্যে গণস্বার্থ সংরক্ষণের কোনো উপাদান খুঁজে পাওয়া যায় কি? বরং হরতালসহ সন্ত্রাসী কর্মসূচির মাধ্যমে গণস্বার্থ উপেক্ষিত হয়ে থাকে চরমভাবে। হরতাল মানেই ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, মৃত্যু, গণদুর্ভোগ। সাধারণ মানুষের জীবন থেকে শান্তি-সুখ-স্বস্তি-আনন্দ কেড়ে নেয়ার জন্য সংঘাত-সংঘর্ষের রাজনীতিকে দায়ী না করে উপায় নেই। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষত আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি যখন হিংসা-প্রতিহিংসার পথ ছেড়ে আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতার পথে এগোতে থাকবে তখনই কেবল সম্ভব হবে নতুন রাজনীতির দিকে এগিয়ে যাওয়া। কিন্তু রাজনীতিকে নতুন ধারায় এগিয়ে নেয়ার আগ্রহ প্রধান দুইটি দলের আছে বলে মনে হয় না। দুই দলের মধ্যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার জন্য দেশি-বিদেশি নানা মহল সচেষ্ট আছে। কিন্তু আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে দুইদল সমঝোতায় পৌঁছতে পারবে— তার কোনো লক্ষণ, এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না।

সরকার নির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বলেই মনে হচ্ছে এবং নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বর্তমান সরকারের অধীনেই। সেই নির্বাচনে বিএনপি যদি অংশ না নেয় তাহলে পরিস্থিতি কি দাঁড়াবে সেটা নিয়ে নানা রকম জল্পনা-কল্পনা আছে। তবে বিএনপি শেষপর্যন্ত নির্বাচনী যুদ্ধ থেকে নিজেদের দূরে রাখবে না বলে কোনো কোনো রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মনে করছেন। আন্দোলনের নামে দেশে অরাজকতা সৃষ্টির পথ যদি বিএনপি বেছে নেয় তাহলে রাজনৈতিকভাবে তারাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতার পালাবদল দেখতে চায়। আর সেজন্য নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। ক্ষমতার জোরে নির্বাচনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করলে সঙ্কট তৈরি হবে সরকারের জন্য। অবাধ, নিরপেক্ষ এবং বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে ব্যর্থ হলে সরকারকেই খেসারত দিতে হবে।

bibhu54@yahoo.com

লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক

Leave a Reply