রাজনীতিতে হঠাৎ নাটকীয়তা ॥ চিঠি ও ফোন ০ সৈয়দ আশরাফকে চিঠি দিলেন মির্জা ফখরুল ০ টেলিফোনে ধন্যবাদ জানালেন সৈয়দ আশরাফ

22/10/2013 6:50 pmViews: 8

asraf-fokrul2.thumbnailবিশেষ প্রতিনিধি ॥ নিজ নিজ অবস্থানে অনড় থাকলেও দুই দলের মধ্যে চিঠি আর ফোনালাপে নাটকীয় মোড় নিয়েছে দেশের রাজনীতি। বইতে শুরু করেছে সংলাপের সুবাতাস। গতি পেয়েছে রাজনীতির চাকা। রাজনৈতিক কৌশলের মারপ্যাঁচে সংলাপ এখনও বন্দী থাকলেও ‘অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান’ নিয়ে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের পাল্টাপাল্টি প্রস্তাব নিয়ে যখন সারাদেশেই আলোচনার ঝড় বইছে, ঠিক তখনই সরকারের কাছে বিরোধী দলের আনুষ্ঠানিক চিঠি আর দুই মহাসচিবের মধ্যে ফোনালাপ দুইপক্ষের মধ্যেই শীতল সম্পর্কে বরফ গলার আলামত বলে মনে হচ্ছে।
২৫ অক্টোবরকে ঘিরে দুইপক্ষের ‘যুদ্ধংদেহী’ অবস্থানে দেশব্যাপী যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়েছিল, সর্বশেষ দুই দলের নমনীয় অবস্থানে তাও আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছে। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা আশাবাদী হয়ে উঠেছেন, সামনের দিনগুলোতে আরও নাটকীয় ঘটনা ঘটবে। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই জানিয়েছেন বৈঠকে বসতে তিনি নিজেই ফোন করবেন বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াকে। প্রধানমন্ত্রীর এমন ঘোষণার ১২ ঘণ্টা না যেতেই শাসক দলের কাছে বিরোধী দলের আনুষ্ঠানিক সংলাপের প্রস্তাব রাজনীতির হিসাবনিকাশই পাল্টে দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত দুইপক্ষই একটি সমঝোতায় গিয়ে দেশবাসীকে সবার অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেবে- এমন প্রত্যাশায় এখন বুক বাঁধছে দেশের মানুষ।
শাসক দল ‘নির্বাচিত’ আর বিরোধী দল ‘নির্দলীয়’ অন্তর্বর্তী সরকারের দাবিতে এখনও অনড় থাকলেও এখন দুইপক্ষই সংবিধানের মধ্যে থেকেই কোন তৃতীয় ফর্মুলায় সমঝোতার পথ খুঁজছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সর্বদলীয় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে বিরোধী দল। আর বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার সাবেক উপদেষ্টাদের নিয়ে নির্দলীয় সরকার গঠনের প্রস্তাবকে ‘অসাংবিধানিক’ উল্লেখ করে শাসক দলও প্রত্যাখ্যান করেছে। দুইপক্ষ নিজ নিজ দাবির প্রতি অনড় থাকলেও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামী এক সপ্তাহে আরও নাটকীয় ঘটনা ঘটতে পারে। সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে চলমান চিঠি চালাচালি আর ফোনালাপে সহসাই খুলে যেতে পারে সংলাপের বন্ধ দুয়ার।
বিএনপির চিঠি ॥ ফখরুল-আশরাফের ফোনালাপ
নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে প্রধান দুই দলের পাল্টাপাল্টি প্রস্তাব আর উত্তপ্ত বাহাসের মধ্যেই মঙ্গলবার বিএনপির চিঠি আর দুই দলের মহাসচিবের মধ্যে ফোনালাপে রাজনৈতিক অঙ্গনে শুরু হয়েছে বরফ গলা। চলছে দুইপক্ষের মধ্যে লাভ-লোকসানের হিসাবনিকাশ। পরবর্তী রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণে মঙ্গলবার রাতে দুই দলেই দুই শীর্ষনেত্রী শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়া নিজ দলের শীর্ষনেতাদের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করেছেন।
নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়ার উত্থাপিত প্রস্তাবটি মঙ্গলবার সরকারের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করেছে বিএনপি। বিএনপির পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগকে চিঠি দিয়ে বলা হয়েছে, সঙ্কট নিরসনে দ্রুতই প্রয়োজন আলোচনা। এ জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতেও ক্ষমতাসীনদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বিএনপি।
বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের লেখা একটি চিঠি নিয়ে মিন্টু রোডে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও এলজিআরডিমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বাসায় গিয়ে তাঁর কাছে হস্তান্তর করেন বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল। চিঠি প্রাপ্তির কথা স্বীকার করে নাটকীয়ভাবে দুপুর ১২টায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুলের কাছে টেলিফোন করেন সৈয়দ আশরাফ। চিঠি প্রদানের জন্য বিএনপির মহাসচিবকে ধন্যবাদ জানিয়ে সৈয়দ আশরাফ বলেন, বিষয়টি নিয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলবেন।
সৈয়দ আশরাফ যখন ফোন করেন তখন মির্জা ফখরুল গুলশানের দলীয় কার্যালয়ে সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তব্য রাখছিলেন। এ সময় তাঁর মোবাইল ফোন বেজে উঠলে তা মির্জা ফখরুল ইসলামের হাতে ধরিয়ে দেন তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী। এ সময় দুই নেতা ফোনালাপের মাধ্যমে একে অপরের কুশলবিনিময় ছাড়াও চলে নাটকীয় কথোপকথন। সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের সঙ্গে ফোনালাপের পর মির্জা ফখরুল সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, আশা করছি শীঘ্রই আলোচনার মাধ্যমে সৃষ্ট রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানের ব্যাপারে সমঝোতা হবে। তিনি বলেন, সৈয়দ আশরাফ আমাদের পাঠানো চিঠি প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন এবং ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
মির্জা ফখরুল জানান, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দিনাজপুর যাচ্ছেন। আমাদের দেয়া চিঠিটিও তিনি সঙ্গে নিয়ে গেছেন। হেলিকপ্টারেই তিনি প্রধানমন্ত্রীকে বিষয়টি অবহিত করবেন। সৈয়দ আশরাফের সঙ্গে এক মিনিটের ফোনালাপে মির্জা ফখরুল প্রথমে কুশলবিনিময়ের পর বলেন, আমরা অনেকটা এগিয়েছি, আপনারাও এগিয়ে আসুন। আশা করি আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে সমঝোতার দ্বার উন্মুক্ত হবে। সাংবাদিক সম্মেলনের শুরুতে নয়াপল্টনের দলীয় কার্যালয়ের সামনে খালেদা জিয়ার গাড়িবহরের একটি মাইক্রোবাসে পুলিশি হামলার প্রতিবাদে সরকারের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক বক্তব্য রাখলেও সৈয়দ আশরাফের সঙ্গে ফোনালাপের পর তাঁর সুরও বদলে যায়।
মঙ্গলবার বেলা ১১টায় বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব বরকতউল্লাহ বুলু এমপির নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল গুলশান কার্যালয় থেকে সৈয়দ আশরাফের মিন্টু রোডের বাসার উদ্দেশে রওনা হন। প্রতিনিধি দলের অন্য দুই সদস্য হচ্ছেন জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের চীফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক ও শহীদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানী এমপি। চিঠি নিয়ে রওনা হওয়ার আগে খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ে বরকতউল্লাহ বুলু সাংবাদিকদের বলেন, দলের মহাসচিবের পক্ষ থেকে বার্তা নিয়ে আমরা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফের বাসায় যাচ্ছি। চিঠিতে কী আছে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা চিঠি পড়ে দেখিনি। এটি মহাসচিবের বার্তা। আমরা এ বার্তা পৌঁছে দিতে যাচ্ছি। তবে সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল বলেন, চিঠিতে খালেদা জিয়ার দেয়া প্রস্তাবের কথা রয়েছে এবং সংলাপের প্রস্তাবও রয়েছে। আমরা আশা করছি সরকার এখন আমাদের আলোচনার প্রস্তাবে সাড়া দেবে।
সৈয়দ আশরাফের কাছে দেয়া মির্জা ফখরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত চিঠিতে লেখা ছিল- ‘আসসালামু আলাইকুম। গত ২১ অক্টোবর সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টির চেয়ারপার্সন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনের লক্ষ্যে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য নির্বাচনকালীন সরকারের একটি প্রস্তাব মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে তাঁর বিবেচনার জন্য সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থাপন করেছেন। প্রস্তাবের অংশটুকু আপনার নিকট পাঠালাম। এ বিষয়ে অবিলম্বে আলোচনা শুরু করার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে আপনাকে সবিনয়ে অনুরোধ জানাচ্ছি।’
উল্লেখ্য, দশম সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে জনমনে রাজনৈতিক সংঘাতের আশঙ্কার মধ্যেই গত শুক্রবার জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই সরকারে সদস্য হওয়ার জন্য বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের কাছ থেকে নাম পাঠানোর আহ্বান জানান তিনি। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের তিন দিন পর সোমবার রাজধানীর একটি হোটেলে সাংবাদিক সম্মেলনে ওই প্রস্তাব নাকচ করে একজন ‘সম্মানিত নাগরিকের’ নেতৃত্বে ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ১০ উপদেষ্টাকে নিয়ে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারের পাল্টা প্রস্তাব দেন বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া। বর্তমানে এই দুই প্রস্তাব নিয়েই প্রধান দুই দলের মধ্যে চলছে চিঠি চালাচালি ও ফোনালাপ।
আশরাফের সংবাদ সম্মেলন স্থগিত ॥ নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে দেশের প্রধান দুই দলের মধ্যে আলোচনার উদ্যোগের মধ্যেই আজ বুধবার সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে ছিল আওয়ামী লীগ। বেলা ১১টায় ধানম-ির আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বিরোধীদলীয় নেত্রীর প্রস্তাব ও বিএনপির চিঠির ব্যাপারে দলীয় অবস্থান পরিষ্কার করতে সংবাদ সম্মেলনে কথা বলবেন বলে দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল। কিন্তু রাতে দলের কেন্দ্রীয় উপ-দফতর সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাস জনকণ্ঠকে জানান অনিবার্য কারণবশত : সংবাদ সম্মেলন স্থগিত করা হয়েছে।
জানা গেছে, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুলের চিঠি নিয়ে মঙ্গলবার রাতে গণভবনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ। এর পরই সংবাদ সম্মেলন স্থগিতের সিদ্ধান্ত হয়। দলটির একাধিক সূত্র আভাস দিয়েছে, দু’-একদিনের মধ্যে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিএনপিকে পাল্টা চিঠি দেয়া হতে পারে।

Leave a Reply