রক্ত নিয়ে অমানবিক ব্যবসা

রক্ত মানবদেহের একটি অন্যতম প্রধান উপাদান। বিশুদ্ধ রক্ত প্রবাহই মানব শরীরকে সুস্থ রাখে। শুধু মানুষই নয়, প্রতিটি প্রাণীরই বেঁচে থাকার অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ রক্ত। রক্তের অবাধ প্রবাহ দেহকে সচল ও হৃদযন্ত্রকে কার্যকর রাখে। বিভিন্ন কারণে মানবদেহে বাইরে থেকে রক্ত প্রবেশ করাতে হয়। শরীরে রক্ত স্বল্পতা দেখা দিলে কিংবা কোনো বড়ো ধরনের অপারেশনের সময় রক্তের প্রয়োজন হয়। এসব রক্ত ভিন্ন ব্যক্তির দেহ থেকে সংগ্রহ করা হয়। আর রক্তের এ প্রয়োজনীয়তা মেটানোর জন্যই সৃষ্টি হয়েছে ব্লাডব্যাংক। এসব ব্লাডব্যাংকে সুস্থ মানুষের কাছ থেকে রক্ত সংগ্রহ করে রাখা হয়। পরে তা বিক্রি করা হয় রোগীদের কাছে।
বাংলাদেশে ব্লাডব্যাংকের পথিকৃৎ বলা যায় সন্ধানীকে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ভিত্তিক এ সেবা সংস্থাটি সত্তর দশকের প্রথমভাগ থেকে রক্ত সংগ্রহ ও মূমুর্ষ রোগীদের কাছে তা সরবরাহ করার কাজ করে আসছে। এছাড়া রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, লায়ন্স ক্লাব ইত্যাদি সেবা মূলক প্রতিষ্ঠানও ব্লাডব্যাংক সেবা দিয়ে আসছে। রক্তের চাহিদা বৃদ্ধির কারণে পরবর্তীতে বানিজ্যিক ভিত্তিতে ব্লাডব্যাংক প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার অনুমতি দেয় সরকার। দেশে বর্তমানে ৭৭টি বেসরকারি ব্লাড ব্যাংক রয়েছে। এসব ব্লাডব্যাংক বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে রক্ত সংগ্রহ করে জমা রাখে এবং প্রয়োজনমত বিক্রি করে।
ব্লাডব্যাংক শুরুতে সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান থাকলেও এখন তা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। আর এ সুযোগে কতিপয় অসাধু ব্যক্তি প্রাণ রক্ষাকারী এ খাতে দুর্নীতি-অনিয়ম এবং মানবতা বিরোধী অপরাধকর্মে প্রবৃত্ত হয়েছে। গত ২৩ মার্চ পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এর ভ্রাম্যমান আদালত রাজধানীর একটি ব্লাডব্যাংকে অভিযান চালিয়ে ভেজাল রক্ত বিক্রির অভিযোগে ৩ জনকে কারাদন্ড ও ব্লাডব্যাংকটি সিলগালা করে দিয়েছে। খবরে বলা হয়েছে, রাজধানীর বকশীবাজারে র্যাবের ভ্রাম্যমান আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আনোয়ার পাশার নেতৃত্বে একটি টীম অভিযান চালিয়ে ভেজাল রক্ত বিক্রি করার সময় হাতে নাতে তিনজনকে গ্রেফতার করে। ঢাকা ব্লাডব্যাংক সেন্টার নামের ওই প্রতিষ্ঠানটি প্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়াই মাদকাসক্ত ও পেশাদার রক্ত বিক্রেতাদের কাছ থেকে রক্ত সংগ্রহ করে বিভিন্ন ক্লিনিক ও হাসপাতালে সরবরাহ করে আসছিল। এমন কি তারা স্যালাইন মিশিয়ে এক ব্যাগ রক্তকে দুই ব্যাগ বানিয়ে বিক্রি করত। এসব রক্ত বিক্রির জন্য তারা ডাক্তারের জাল স্বাক্ষর দিয়ে ভুয়া রিপোর্ট তৈরি করত।
রক্ত মানবদেহের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বিধায় রক্ত সংগ্রহ ও তা সঞ্চালনের ক্ষেত্রে কঠোর সাবধানতা অবলম্বন করার বিধান রয়েছে। রক্ত সংগ্রহের সময় রক্তদাতার শারীরিক সুস্থতার পরীক্ষা, মাদক সেবীদের রক্ত সংগ্রহ না করা, রক্তদাতার পরিচয় ও স্বাস্থ্য রিপোর্টের রেকর্ড সংরক্ষণ, স্বাস্থ্যকর পরিবেশে রক্ত সংরক্ষণ এবং সে জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি স্থাপন বাধ্যতামূলক। এসব ব্যবস্থা ব্যাতীত রক্ত সংগ্রহ ও বিতরণ অবৈধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অথচ আমাদের দেশে অধিকাংশ ব্লাডব্যাংকে এসব নিয়ম-নীতি অনুসরণ করা হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে।
রক্ত সংগ্রহ ও সংরক্ষণের ক্ষেত্রে কঠোরতা অবলম্বনের কারণ হলো, দুষিত রক্তের মাধ্যমে অনেক সময় জীবনঘাতী রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশংকা থাকে। এইডসের মতো প্রাণঘাতী রোগ, হেপাটাইটিস এর মতো মারাত্মক ব্যাধি ছড়াতে রক্ত অন্যতম মাধ্যম। এজন্য একজন রক্ত দাতার কাছ থেকে রক্ত সংগ্রহের আগে তার এইডস, এইচআইভি,হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-সি, সিফিলিস, ও ম্যালেরিয়া রোগ আছে কীনা তা পরীক্ষা করার নির্দেশ রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশের অধিকাংশ ব্লাডব্যাংক এ নির্দেশনা অনুসরণ করে না। ফলে জনস্বাস্থ্য রয়েছে প্রচন্ড হুমকির মুখে।
খবরে বলা হয়েছে, অসাধু রক্ত ব্যবসায়ীরা মাদকসেবী ও পেশাদার রক্ত বিক্রেতাদের কাছ থেকে প্রতি ব্যাগ রক্ত এক শ’ থেকে দেড় শ’ টাকায় সংগ্রহ করে বিভিন্ন ক্লিনিক ও হাসপাতালে এক-দেড় হাজার টাকা করে বিক্রি করে। এদের সঙ্গে ওইসব হাসপাতালের কতিপয় চিকিৎসকের রয়েছে যোগসাজশ। এরা শুধুমাত্র ‘ক্রস ম্যাচ’ করেই রোগীর দেহে সংগ্রহকৃত রক্ত প্রবেশ করিয়ে দেয়। ফলে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী নতুন রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে।
মানুষের জীবন নিয়ে যারা ছিনিমিনি খেলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। উল্লিখিত খবরে বলা হয়েছে, বকশী বাজারের ঢাকা ব্লাডব্যাংক সেন্টারের তিনি কর্মচারীকে দুই বছর ও এক বছর করে কারাদন্ড দিয়েছেন ভ্রাম্যমান আদালত। এ শাস্তি পর্যাপ্ত নয় বলে আমরা মনে করি। যারা মানুষের জীবনসংহারি কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত তারা হত্যাকারীর সমতুল্য। তাই তাদের শাস্তিও হওয়া উচিত অনূরূপ। উন্নত বিশ্বে অনেক অপরাধ ক্ষমা করা হলেও জনস্বাস্থ্য তথা মানুষের জীবন বা স্বাস্থ্য নিয়ে দুর্নীতি অপরাধ ক্ষমা করা হয় না। অপরাধীদের অনেক সময় দেয়া হয় সর্বোচ্চ দন্ড। সে বিচারে ভেজাল রক্ত সরবরাহকারীদের দু’চার বছরের কারাদন্ড ‘গুরু পাপে লঘু দন্ডে’রই নামান্তর।
মানুষের প্রাণঘাতী কাজের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর রূপ নিতে পারে। ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি মুখোমুখি হতে পারি জনস্বাস্থ্য খাত। সুতরাং, যত্রতত্র ব্লাডব্যাংক স্থাপন, প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই রক্ত সংগ্রহ ও বিক্রয় এবং রোগীর দেহে তা সঞ্চালন বন্ধ করার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। অপরাধীদের দিতে হবে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। ব্যবস্থা করতে হবে সব ব্লাড ব্যাংকের কাজ কর্মের কঠোর পর্যবেক্ষণের। পাশাপাশি আইনের যথাযথ ও কঠোর প্রয়োগও নিশ্চিত করতে হবে।