২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে ভয়াবহ ও নৃশংস সেই গ্রেনেড হামলার পর পেরিয়ে গেছে এক যুগ। কিন্তু এখনও শেষ হয়নি বিচারকাজ। তবে মামলাটির বিচার কার্যক্রম এখন শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক আশা প্রকাশ করেছেন অল্প কিছু দিনের মধ্যেই এ মামলার রায় হবে। শনিবার এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, মামলাটি এখন শেষ পর্যায়ে। আশা করা যায়, অল্প কিছু দিনের মধ্যেই মামলাটির রায় হবে। প্রায় একই আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন প্রসিকিউশন সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা।
২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট বিকালে রাজধানীর ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে দলটির সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। রক্তে ভেসে যায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউ। এ ঘটনায় দলের মহিলা লীগের সভানেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নেতাকর্মী প্রাণ হারান। আহত হন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগের বেশ কজন শীর্ষ নেতাসহ আহত হন প্রায় ৪শ’। আওয়ামী লীগ বরাবরই অভিযোগ করে আসছে শেখ হাসিনাসহ দলটিকে নেতৃত্বশূন্য করার জন্য তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট এবং তখনকার ‘হাওয়া ভবন’র প্রত্যক্ষ মদদ ও ইন্ধনে এ হামলা চালানো হয়। এমনকি ঘটনাস্থলের আলামত নষ্টের পাশাপাশি লোক দেখানো তদন্তের জন্য ‘জজ মিয়া’ নাটক সাজিয়ে তদন্তকাজ বিঘ্নিত করার চেষ্টা করে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। একই সঙ্গে দীর্ঘ দিন এ মামলার বিচারকাজ যাতে না হয় সে চেষ্টাও করেছে বিএনপি-জামায়াত জোট। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা গতি ফিরে পায়। দেশ-বিদেশে আলোচিত এ মামলার বিচারকাজ দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এ চলছে।
আদালত সূত্র ও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা জানিয়েছেন, কবে নাগাদ এ মামলার বিচারকাজ শেষ হবে তা নির্দিষ্ট সময় বা মাসের ভিত্তিতে বলা সম্ভব নয়। তবে, দ্রুততা এবং স্বচ্ছতার সঙ্গে বিচারকাজ শেষ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। মামলা সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা জানান, এ মামলায় সাক্ষীর সংখ্যা ৫১১ জন। ১৮ই আগস্ট বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ২২৪ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। তবে, সর্বশেষ সাক্ষী (২২৪ নম্বর) মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ফজলুল কবিরের জেরা এখনও চলছে। ৬ জন তদন্ত কর্মকর্তার মধ্যে তার জেরা শেষে আরও চারজন (একজনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে) তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্যগ্রহণ হতে পারে। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা জানান, সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে বিচারিক কার্যক্রমের আরও দুটি ধাপ পার হতে হবে। এর মধ্যে ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী মামলার আসামিদের পরীক্ষা বা আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য দিন ধার্য করবেন আদালত। এ প্রক্রিয়া শেষে হবে রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন। যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে বিচারক রায়ের জন্য দিন ধার্য করবেন। তাই কবে নাগাদ এ মামলার রায় ঘোষণা করা হবে তা নির্দিষ্ট বা কোনো নির্দিষ্ট সময় হিসেবে বলা যাচ্ছে না বলে জানান আইনজীবীরা। যদিও ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলার বিচারকাজ বিলম্ব হওয়ায় কারণে প্রসিকিউশনের প্রতি একাধিকবার তাগিদ দেয়াসহ উষ্মা প্রকাশ করেছে জাতীয় সংসদের আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সম্প্রতি আশা প্রকাশ করে বলেন, আগামী সেপ্টেম্বরেই এ মামলার বিচারকাজ শেষ হবে। এর আগে এ মামলা নিষ্পত্তির বিষয়ে গত বছরও তিনি নির্দিষ্ট সময়ের কথা বলেছিলেন। যদিও প্রসিকিউশনের আইনজীবীরা বলছেন তাদের সঙ্গে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তর কোনো আলোচনা হয়নি। প্রসিকিউশনের সঙ্গে কথা না বলেই তিনি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ২১শে আগস্ট বিচারকাজ শেষ হওয়ার কথা বলেছেন।
মামলা দ্রুত নিষ্পত্তিতে তাগাদা রয়েছে উল্লেখ করে ২১শে আগস্ট মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি সৈয়দ রেজাউর রহমান মানবজমিনকে বলেন, তিনি (সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত) কোনো বিবেচনায় নির্দিষ্ট সময়েই (সেপ্টেম্বর) বিচারকাজ শেষের কথা বলেছেন তা আমি জানি না। এ নিয়ে তার সঙ্গে আমার কোনো আলোচনাও হয়নি। তিনি নিজেও এ হামলায় আহত হয়েছিলেন। সে হিসেবে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত নিজেও একজন বিচারপ্রার্থী। হয়তো সে আবেগ থেকেই এ কথা বলেছেন। তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা করছি। মামলা এখন শেষ পর্যায়ে। তবে, কবে নাগাদ রায় হবে তা নির্দিষ্ট সময় ধরে বলা সম্ভব নয়। ৫১১ জন সাক্ষীর মধ্যে আরও কতজন সাক্ষীর সাক্ষ্য নেয়া হতে পারে বা সবার সাক্ষ্যগ্রহণ সম্ভব কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে সৈয়দ রেজাউর রহমান বলেন, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য যতজন সাক্ষীর সাক্ষ্য নেয়ার প্রয়োজন হবে তার বেশিও নেব না, কমও নেব না।
মামলার নথিপত্র অনুযায়ী, ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় অভিযোগপত্রভুক্তপত্র আসামি ৫২ জন। এর মধ্যে বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টু, সামরিক গোয়েন্দা অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক রেজ্জাকুল হায়দার, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক মহাপরিচালক আব্দুর রহিম, হরকাতুল জিহাদের (হুজি) শীর্ষ নেতা মুফতি আবদুল হান্নানসহ ২৫ জন কারাগারে রয়েছেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ভাগ্নে সাইফুল ইসলাম ডিউক, সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক আশরাফুল হুদা, শহুদুল হক, খোদা বক্ম চৌধুরীসহ ৮ জন জামিনে রয়েছেন। মামলার অন্যতম আসামি বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিস চৌধুরী, বিএনপি দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই তাজউদ্দিনসহ ১৮ জন পলাতক রয়েছেন। এ ছাড়া আসামি হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদের নাম থাকলেও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। ২১শে আগস্ট মামলায় ২০০৮ সালের জুনে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সহকারী পুলিশ সুপার ফজলুল করিম মুফতি হান্নানসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। পরে ২০০৯ সালে আওয়ামী সরকার গঠনের পর এ মামলায় অধিকতর তদন্ত হয়। তদন্তের পর ২০১১ সালের ২রা জুলাই তারেক রহমান, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ৩০ জনকে আসামির তালিকায় সংযুক্ত করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করেন সিআইডির কর্মকর্তারা।
২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রাষ্ট্রপক্ষের একজন আইনজীবী আলাপকালে মানবজমিনকে বলেন, বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার এই মামলার তদন্ত কাজকে বিঘ্নিত করতে নানা ধরনের বিতর্কিত কাজ করেছে। বিশেষ করে ‘জজ মিয়া’ নাটক সাজিয়ে তদন্ত কাজকে বিঘ্নিত করেছে। সেই সময়ে এই মামলার বিচারকাজ শুরুই করা যয়নি। যা এ মামলার গতিকে অনেক পিছিয়ে দিয়েছে। ২০০৯ সলে আওয়ামী সরকার গঠন করার পর কার্যক্রম গতি ফিরে পায়। তবে গতি ফিরে পেলেও বিভিন্ন কারণে মাঝে মধ্যে স্বাভাবিক বিচারকাজ ব্যাহত হয়েছে। তিনি জানান, ২১শে আগস্টের গ্রেনেড হামলায় হত্যা ও বিস্ফোরক মামলা একই সঙ্গে চলছে। মামলায় ৫২ জন আসামির মধ্যে বিস্ফোরক মামলার আসামি ৪১ জন। ফলে, দুই মামলার বিচারকাজ একই সঙ্গে চলছে। আবার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আবেদন নিয়ে ৫ জন আসামি উচ্চ আদালতে গিয়েছেন। যে কারণে ২৯৪ কর্মদিবস নষ্ট হয়েছে। এ ছাড়া যুদ্ধাপরাধ মামলা, দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা (রায় ঘোষণা হয়েছে), রমনা বটমূলে বোমা হামলা মামলা, সিলেটে ব্রিটিশ হাইকমিশনারের ওপর গ্রেনেড হামলা মামলা, সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যা মামলায় এই মামলার বেশকজন আসামি হিসেবে রয়েছেন। এর মধ্যে বেশকিছু মামলায় নিম্ন আদালতের রায় হলেও ২১শে আগস্ট মামলার আসামিরা বিভিন্ন সময়ে ওই মামলাগুলোতে ঢাকা ও ঢাকার বাইরের বিভিন্ন আদালতে হাজিরা দিয়েছেন। যে কারণে মামলার বিচারকাজ বিঘ্নিত হয়েছে। তিনি বলেন, আসামিপক্ষের আইনজীবীরাও সাক্ষীদের বিভিন্ন অপ্রাসঙ্গিক জেরা করে সময় নষ্ট করেছেন। তবে, সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে দ্রুত রায়ের ব্যাপারে প্রসিকিউশন আশাবাদী।