যদি বাংলাদেশ-ভারত ক্রিকেট-যুদ্ধের নতুন পর্ব শুরু
প্রশ্ন: টুর্নামেন্ট শুরুর আগে কেউই যা ভাবেনি, সেই বাংলাদেশ-ভারত সেমিফাইনাল, আপনি কি একটু বিস্মিত?
রবি শাস্ত্রী: আমি একটুও বিস্মিত নই। কারণ, আমি অনেক দিন ধরে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে খুব নিবিড়ভাবে দেখে আসছি। এই তো গত বছর এশিয়া কাপেও বাংলাদেশে গিয়েছিলাম। বাংলাদেশ ফাইনাল খেলল। তাই আমি একটুও বিস্মিত নই। কোনো দলই এখন বাংলাদেশকে হালকাভাবে নেয় না। কেউ নিলে হেরে সেই মূল্য চুকাতে হয়। সেদিন নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে ম্যাচটা তো অসাধারণ খেলল। সাকিব ওয়ার্ল্ড ক্লাস। আবার দেখিয়ে দিল, ও কী দুর্দান্ত এক ক্রিকেটার! ও কত বছর ধরে বাংলাদেশকে টেনে যাচ্ছে, বলুন তো! নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের ম্যাচটা এই চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেরা ম্যাচ। হ্যাটস অব টু বাংলাদেশ…৪ উইকেটে ৩৩ রান থেকে জেতা কি সোজা কথা নাকি!
প্রশ্ন: বাংলাদেশ অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা প্রায়ই দুঃখ করে বলেন, আগে বাংলাদেশ দলকে সবাই কেমন অবহেলার চোখে দেখত। এত দিনে কি তাহলে সম্মান পাওয়ার দিন এল?
রবি শাস্ত্রী: বাংলাদেশ এখন অবশ্যই সম্মান পাচ্ছে এবং এর অনেকটা কৃতিত্ব মাশরাফিরও প্রাপ্য। ভালো অধিনায়ক। নিজের দলের খেলোয়াড়দের শক্তি ও দুর্বলতা খুব ভালো বোঝে। ট্যাকটিক্যাল চেঞ্জগুলোও ভালো করে। বাংলাদেশ এখন সবার কাছ থেকেই সম্মান পাচ্ছে এবং এটি তারা আদায় করে নিয়েছে। বাংলাদেশ যে উঠে আসছে—উপমহাদেশে আমরা এটি ঠিকই জানতাম। তবে এখন পুরো বিশ্বই এ নিয়ে কথা বলছে। বিশেষ করে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটির পর। এটা তো অবিশ্বাস্য এক পারফরম্যান্স।
প্রশ্ন: বাংলাদেশ-ভারত বললে অবধারিতভাবেই ২০০৭ বিশ্বকাপ চলে আসে। ভারতকে বিদায় করে দিয়ে বিশ্বকাপের ফরম্যাট পর্যন্ত বদলাতে বাধ্য করেছিল বাংলাদেশ। ওই বিশ্বকাপের পরপরই ভারত যখন বাংলাদেশ সফরে গেল, আপনি দলের কোচ। কী মনে পড়ে?
রবি শাস্ত্রী: ভারতীয় ক্রিকেট তখন রীতিমতো টালমাটাল। কোচকে (গ্রেগ চ্যাপেল) নিয়ে বিরাট সমস্যা। বিশ্বকাপে অমন একটা বিপর্যয় ঘটে গেল, এর পরপরই বাংলাদেশে গিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে খেলা। আমাকে হঠাৎ দায়িত্ব নিতে বলা হলো। আমরা বাংলাদেশকে মোটেই হালকাভাবে নিইনি। আমাদের খেলোয়াড়েরা জানত, বাংলাদেশের সঙ্গে জিততে হলে সেরা খেলাটাই খেলতে হবে। নইলে বাংলাদেশকে হারানো যাবে না। ভালো খেলা হয়েছিল তো!
প্রশ্ন: সেই সফরে সংবাদ সম্মেলনে আপনার আক্রমণাত্মক কথাবার্তা নিয়ে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে খুব সমালোচনা হয়েছিল। আপনার কানে তা পৌঁছেছিল?
রবি শাস্ত্রী: না, আমি কিছু শুনিনি। শুনলেও পাত্তা দিতাম না। আমার খেলোয়াড়দের উজ্জীবিত করতে যা প্রয়োজন ছিল, আমি সেটাই করেছিলাম।
প্রশ্ন: গত কিছুদিন বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচ মানেই আগুনে লড়াই। ২০১৫ বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালে নো-বল নিয়ে ওই বিতর্ক, এর পরপরই বাংলাদেশে ধোনির মোস্তাফিজকে ধাক্কা দেওয়া, ভারতের সিরিজ হেরে আসা…আপনার কী মনে হয়, ক্রিকেটে নতুন একটা যুদ্ধের জন্ম হচ্ছে?
রবি শাস্ত্রী: আমার মনে হয় না আপনি যত কিছু বললেন, খেলোয়াড়েরা তার সব মনে রেখেছে। এখন প্রতিদিনই নতুন ইভেন্ট, নতুন ম্যাচ…অতীতের কথা এত মনে রাখার সময় কই? বাংলাদেশের সঙ্গে ওসবের পর ভারত আবার বাংলাদেশে গেছে। এশিয়া কাপ খেলেছে, ফাইনালে বাংলাদেশকেই হারিয়েছে। আমি মনে করি না, খেলোয়াড়েরা আগের কিছু মনে রেখেছে। খেলোয়াড়েরা তিন বছর আগের কথা, চার বছর আগের কথা এত মনে রাখে না।
প্রশ্ন: কিন্তু সাধারণ মানুষ? দুই-তিন বছর ধরে বাংলাদেশ-ভারত খেলা হলেই সোশ্যাল মিডিয়ায় দুই দেশের মানুষের মধ্যে রীতিমতো যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়…
রবি শাস্ত্রী: আমি বলতে পারব না। আমি সোশ্যাল মিডিয়াতে নেই, তাই ওখানে কী হচ্ছে, আমার কোনো ধারণা নেই। আমি নিজেই তো ভুলে গেছি। এত ম্যাচে ছিলাম! বলতে গেলে প্রতিদিনই নতুন ম্যাচ। আগের সব ম্যাচ নিয়ে পড়ে থাকার সময় কই!
প্রশ্ন: বলেন কী, ২০১৫ বিশ্বকাপের পর বাংলাদেশে গিয়ে ভারত ২-১ সিরিজ হারল, মোস্তাফিজকে ধোনির ধাক্কা দেওয়া নিয়ে অনেক বিতর্ক হলো, এসব মনে নেই?
রবি শাস্ত্রী: আরে ভাই, এত সব মনে থাকে নাকি! হ্যাঁ, কোনো বিগ ম্যাচ হারলে সেটি মনে থাকে। যেমন ২০০৭। আমরা বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিলাম। ওটা মনে আছে। বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনাল হারলে মনে থাকত। এশিয়া কাপ ফাইনাল হারলে মনে থাকত। দ্বিপক্ষীয় সিরিজে অনেক কিছুই হয়, সবাই যা ভুলেও যায়।
প্রশ্ন: বেঙ্গালুরুতে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচের কথা তো মনে আছে, নাকি?
রবি শাস্ত্রী: হ্যাঁ, মনে আছে। আমি তো তখন ভারতের ড্রেসিংরুমেই। ওটা ছিল বাংলাদেশের ম্যাচ আর আপনারা আমাদের হাতে সেটি উপহার হিসেবে তুলে দিয়েছিলেন। আমরা ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছিলাম। আপনারা আমাদের ডেকে এনে বলেছেন, ‘না না, ইন্ডিয়ায় খেলা হচ্ছে, এটা ভালো দেখায় না। তোমরা ফিরে এসো, তোমরাই খেলো।’ (হাসি)।
প্রশ্ন: এত বছর ধরে ক্রিকেটের সঙ্গে আছেন। এটাই কি কোনো ম্যাচে আপনার দেখা সবচেয়ে অপ্রত্যাশিত রেজাল্ট?
রবি শাস্ত্রী: অবশ্যই। কল্পনাই করিনি, ওই অবস্থা থেকে ম্যাচটা আমরা জিতব। আমার মনে হয়, আপনারা আগেই উদ্যাপন করতে শুরু করেছিলেন। আর কোনো কারণ নেই। ওই ম্যাচ তো বাংলাদেশের হেসেখেলে জেতার কথা!
প্রশ্ন: বাংলাদেশ-ভারত সেমিফাইনাল নিয়ে আপনার প্রেডিকশন কী?
রবি শাস্ত্রী: ভালো খেলা হবে। বাংলাদেশের প্রতি ভারতের অনেক রেসপেক্ট আছে। ওরা বাংলাদেশকে হালকাভাবে নেওয়ার ভুল একদমই করবে না। ভারত অবশ্যই ফেবারিট হিসেবে শুরু করবে। ওরা অভিজ্ঞতায় এগিয়ে। তবে নির্দিষ্ট দিনে কী হয়, সেটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
প্রশ্ন: এই ম্যাচে কী নির্ধারক হতে পারে? যেমন ধরুন, প্রথম পাওয়ার প্লের ব্যাটিং-বোলিং বা ডেথ ওভারের খেলা…
রবি শাস্ত্রী: এটা নির্ভর করছে সেদিন আবহাওয়া-উইকেট কেমন থাকে, এর ওপর। এজবাস্টনে এখন পর্যন্ত দেখেছি, খুব ভালো ব্যাটিং কন্ডিশন।
প্রশ্ন: ভালো ব্যাটিং কন্ডিশন হলে কি ভারত একটু সুবিধা পেয়ে গেল? কারণ, বাংলাদেশের বোলারদের ভালো করতে উইকেট থেকে একটু সাহায্য লাগে…
রবি শাস্ত্রী: আমি তা বলব না। আমি বরং বলব, বাংলাদেশকে ভালো ব্যাট করতে হবে। টপ অর্ডারকে ভালো ব্যাট করতে হবে। মূল প্লেয়ারদের জ্বলে উঠতে হবে। যেমন তামিম ইকবাল। যেমন সাকিব। এই দুজনকে ভালো খেলতেই হবে। আমি জানি, বাংলাদেশ দলে আরও ভালো ভালো ব্যাটসম্যান আছে…সৌম্য আছে, মাহমুদউল্লাহ আছে, মুশফিকুর আছে; তবে খেলাটা নির্ভর করবে তামিম আর সাকিবের ওপর। এই দুজনকেই আক্রমণটা প্রতিপক্ষের শিবিরে নিয়ে যেতে হবে।