মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির দুই প্রার্থীর সংবাদ সম্মেলনে

06/02/2020 8:12 pmViews: 4

দুই সিটির বিজয়ীদের আইনগত যোগ্যতা কি আছে, প্রশ্ন ফখরুলের

রাজধানীর গুলশানের একটি মিলনায়তনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির দুই প্রার্থীর সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ছবি: সাজিদ হোসেনরাজধানীর গুলশানের একটি মিলনায়তনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির দুই প্রার্থীর সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ছবি: সাজিদ হোসেনবিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রকৃতপক্ষে ৭ থেকে ৯ শতাংশের বেশি ভোট পড়েনি। তিনি প্রশ্ন তোলেন, এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যাঁরা জয়ী হয়েছেন, তাঁদের জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করার কোনো আইনগত যোগ্যতা থাকছে কি না।

আজ বুধবার দুপুরে রাজধানীর গুলশানের একটি মিলনায়তনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির দুই প্রার্থীর সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ প্রশ্ন তোলেন। এর আগে ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র পদে পরাজিত প্রার্থী তাবিথ আউয়াল ও দক্ষিণের প্রার্থী ইশরাক হোসেন যৌথ সংবাদ সম্মেলন করেন। সেখানে তাঁরা ১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত সিটি নির্বাচনে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম, বহিরাগত সন্ত্রাসীদের দিয়ে ভোটকেন্দ্র দখল, কেন্দ্রে বাইরে পাহারা, বিএনপির পোলিং এজেন্টদের পিটিয়ে বের করে দেওয়া, ইভিএমে জালিয়াতির বিভিন্ন অভিযোগ ভিডিওচিত্রসহ তুলে ধরেন।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, এই সরকার অবৈধভাবে ক্ষমতায় আসার পর থেকে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে নির্বাচন ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে ফেলেছে এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো সচেতনভাবে ধ্বংস করেছে। উদ্দেশ্য একটাই, ১৯৭৫ সালে তারা বাকশাল করতে চেয়েও পারেনি। এখন তারা ভিন্ন কৌশলে বাকশালের অনুরূপ একদলীয় একটা শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের চেষ্টা করছে।

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমরা স্পষ্টভাবে বলছি, এই সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের ওপর জনগণের কোনো আস্থা নেই। আস্থা নেই বলেই ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতি নেই। আজকে অত্যন্ত ন্যায়সংগতভাবে প্রশ্ন উঠেছে, এই ধরনের একটি নির্বাচনে যেখানে প্রকৃতপক্ষে ৭ থেকে ৯ শতাংশের বেশি ভোট পড়েনি, যদিও দেখানো হচ্ছে ২৪ ভাগ। সেখানে এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যাঁরা জয়ী হয়েছেন, তাঁদের আইনগত কোনো যোগ্যতা থাকছে কি না জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করার।’

বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘এই নির্বাচনে জনগণের মতামতের প্রতিফলন ঘটেনি এবং এই নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারেনি। সুতরাং এই নির্বাচনে ফলাফল বাতিল করে আমরা নতুন করে নির্বাচনে আহ্বান জানাচ্ছি। কারণ, গত ১০ থেকে ১২ বছরে এটা প্রমাণিত হয়ে গেছে যে এই আওয়ামী লীগের অধীনে কখনো কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে না। এ কারণেই আমরা বারবার বলছি, একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে এবং নিরপেক্ষ কমিশনের মধ্য দিয়ে নির্বাচন করতে হবে।’

অনেক ভোট বদলানো হয়েছে: তাবিথ
নির্বাচনের ১০ দিন আগে থেকে নির্বাচন কমিশন ইভিএমের বিজ্ঞাপন প্রচার করে। সেখানে উল্লেখ আছে, ইভিএমে ফলাফল অতি শিগগির দেওয়া যায়। মক ভোটের (প্রতীকী ভোট) সময় কর্মকর্তারা বলেছিলেন, ভোট গ্রহণের ৪ থেকে ৫ ঘণ্টার মধ্যে পেশ করা হবে। সে হিসাবে রাত আটটা থেকে নয়টার মধ্যে ফল হওয়ার কথা। কিন্তু ঢাকা উত্তরের ফলাফলের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে ভোররাত চারটা পর্যন্ত। তা-ও মৌখিক ফলাফল পেয়েছি, লিখিত ফলাফল এখনো পাইনি। শেষ রাতে ফলাফল ঘোষণা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি দাবি করেন, এ সময় ভোট চুরি করা হয়েছে, এখানে অনেক ভোট বদলানো হয়েছে। সে কারণে নির্বাচন কমিশন চার থেকে পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে ফল ঘোষণা করতে পারেনি।

তাবিথ বলেন, ‘আপনারা লক্ষ করবেন, ভোটর দিন রাত সাড়ে আটটার সময় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ৩১১টি কেন্দ্রের ফলাফল ঘোষণা হয়। তখন দুই প্রার্থীর ভোটের ব্যবধান ছিল মাত্র ২৩ হাজার। প্রশ্ন জাগে, কী করে রাত নয়টার সময় আমার প্রতিপক্ষ (আতিকুল ইসলাম) প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বের হয়ে এসে নিজের বিজয়কে নিশ্চিত ঘোষণা করেন এবং বিজয় মিছিল শুরু করে দেন। তখন পর্যন্ত মাত্র ২০ পার্সেন্ট ভোটকেন্দ্রের ফলাফল হয়। অথচ সব কেন্দ্রের ভোটের ফলাফল জানতে আমাদের ভোররাত চারটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে।’সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা। ছবি: সেলিম জাহিদ

ইসি নিজেই আইন ভঙ্গ করেছে
নির্বাচন কমিশন (ইসি) নিজেরাই নির্বাচনের সব আইন ভঙ্গ করেছে এবং আইন ভঙ্গ করতে অন্যদের উৎ​সাহ দিয়েছে। এ সময় তিনি ই​ভিএম পদ্ধতির ভোটে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম তুলে ধরে নির্বাচন কমিশনের কাছে এর ব্যাখ্যা দাবি করেন। এ ছাড়া পুলিশের পোশাক পরে কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন, বিভিন্ন কেন্দ্রে প্রতিটি বুথে নৌকা প্রতীকের একাধিক পোলিং এজেন্ট থাকার অভিযোগ করে এ–সংক্রান্ত প্রামাণ্য চি​ত্র প্রদর্শন করেন। তিনি অভিযোগ করেন, এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের অবহিত করা হলেও তাঁরা কোনো ভূমিকা রাখেননি।

তাবিথ আউয়াল বলেন, ভোট গ্রহণ শেষে সিটি করপোরেশন নির্বাচন (ইভিএম) বিধিমালা, ২০১৯–এর ১৬ ও ১৭ বিধি অনুসারে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ইভিএমের কন্ট্রোল ইউনিট থেকে ফলাফল মুদ্রণ এবং ১৭ বিধি অনুসারে স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) নির্বাচন বিধিমালা, ২০১০–এর তফসিল-১–এর ‘ঞ’ ফরমে মেয়র পদের ভোট গণনার বিবরণী প্রস্তুত করাই বিধি। কিন্তু এই নির্বাচনে ইভিএমের কন্ট্রোল ইউনিটের মুদ্রিত ফলাফল এবং ‘ঞ’ ফরমের ফলাফলে গরমিল ধরা পড়েছে​ ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে। যে কারণে ওই ওয়ার্ডের ফল স্থগিত রাখা হয়েছে। তাতে মনে হচ্ছে, ই​ভিএমের ফলাফল ও ‘ঞ’ ফরমের বিবরণী যথেষ্ট গরমিল হওয়ার সম্ভাবনা বিদ্যমান।

তাবিথ বলেন, তা​ই এ ক্ষেত্রে ইভিএমের কন্ট্রোল ইউনিটের মুদ্রিত ফলাফল ও ‘ঞ’ ফরমের ভোট গণনার বিবরণীর কপি প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সিটি করপোরেশন (ইভিএম) ২০১৯–এর ৯ বিধি অনুসারে প্রত্যেক প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ভোট গ্রহণ শুরুর আগে শূন্য ভোট দেখিয়ে প্রিন্ট বের করে প্রিন্ট কপিতে পোলিং এজেন্টদের স্বাক্ষর নিয়ে ফরম-৩ পূরণপূর্বক প্রত্যয়নপত্র জমা দেওয়ার বিধান রয়েছে। এ বিধান অনুসারে মেয়র প্রার্থী ভোটকক্ষভিত্তিক এসব প্রত্যয়নপত্রের ক​পি প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

তাবিথ আরও বলেন, সিটি করপোরেশন (নির্বাচন আচরণ) বিধিমালা, ২০১৬–এর ২৯ বিধি এবং স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) নির্বাচন বিধিমালা ২০১০–এর ৩০ বিধি অনুসারে ভোটকেন্দ্র প্রবেশাধিকারপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গের উল্লেখ থাকলেও বেআইনিভাবে আওয়ামী লীগের অবাঞ্ছিত ব্যক্তিবর্গ শুধু ভোটকেন্দ্র নয়, ভোটকক্ষে ও ভোট প্রদানের গোপন কক্ষে অবস্থান করে ভোট গ্রহণের প্রক্রিয়াকে কলুষিত করেছে। আইনের এ বিধান লঙ্ঘন শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

তাদের বড় ভয় ছিল ভোটারদের
তাবিথ আউয়াল বলেন, ‘নির্বাচনের দিনটিই শুরু হয়েছে পরিকল্পিত হামলার মধ্য দিয়ে। গণমাধ্যমের কর্মীদের ওপর হামলা হয়েছে। আমাদের ​পোলিং এজেন্ট যাঁরা ছিলেন, তাঁরা যথাযথ সময়ে কেন্দ্রে গিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁদের বের করে দেওয়া হয়েছে, বাইরে নিয়ে পেটানো হয়েছে। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।’

এ প্রসঙ্গে তাবিথ একজন নবনির্বাচিত কাউন্সিলরের হাতে পুলিশের লাঞ্ছিত হওয়ার কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, পুলিশকে মারার অভিযোগে একজন (নবনির্বাচিত কাউন্সিলর) কারাগারে যাবেন, কিন্তু সাংবাদিক মারার জন্য কারও কোনো শাস্তি হবে না, তদন্ত হবে না, এটা কোনো সভ্য ও গণতান্ত্রিক দেশে মেনে নেওয়া যায় না।

নির্বাচনের আগে থেকেই আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের নেতাদের বক্তব্যে​র বিষয় উল্লেখ করে তাবিথ আউয়াল বলেন, ‘নির্বাচনের আগেই আমরা শুনেছি, আওয়ামী লীগ গুন্ডা বাহিনী দিয়ে ভোটকেন্দ্র দখলে রাখবে, পেশিশক্তির ব্যবহার করবে। ভোটের আপনারা দেখেছেন, সকালেই সমস্ত ভোটকেন্দ্র বাইরে হাজার হাজার গুন্ডা ও কর্মী অবস্থান নিয়েছিল। তাদের পরিকল্পনাই ছিল ভোটাররা যেন কেন্দ্রে যেতে না পারেন। কারণ, তাদের সবচেয়ে বড় ভয় ছিল ভোটারদের। এত কিছুর পরেও যাঁরা কেন্দ্রে যেতে পেরেছিলেন, তাঁদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে রাখা হয়েছিল সাজানো লাইন দিয়ে। সকাল আটটায় সব কেন্দ্রে এই চিত্র ফুটে ওঠে।’

সেই দিনের অপেক্ষায় থাকলাম: ইশরাক
সংবাদ সম্মেলনে ইশরাক হোসেন বলেন, প্রায় ২১ দিনের প্রচারণায় তাঁরা ধানের শীষের পক্ষে ব্যাপক গণজোয়ার সৃষ্টি করতে পেরেছেন। এসব দেখেই ক্ষমতাসীন দল নানা কূটকৌশলের আশ্রয় নেয়। সকাল সকাল ভোটকেন্দ্র দখ​ল করে।

ইশরাক আরও বলেন, ‘ভোটের আগের দিন বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের বহিগরাগত সন্ত্রাসীদের ভাড়া করে এনে ঢাকায় জড়ো করা হয় এবং সকালবেলায় নৌকার ব্যাজ পরিয়ে তারা সড়কে অবস্থান নেয়। এসব দেখে আমাদের ভোটাররা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন।’

ইশরাক নির্বাচনের দিন বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রের পরিস্থিতির কথা তুলে ধরে বলেন, ধানের শীষের এজেন্টরা সকালেই ভোটকেন্দ্রে যান। কিন্তু তাঁদের বের করে দেওয়া হয়। এরপর খবর পেয়ে তিনি নিজে এজেন্টদের কেন্দ্রে ঢুকিয়ে দিয়ে আসেন। এরপর তাঁদের আবার বের করে দেওয়া হয়। আবার তিনি ওই কেন্দ্রে গিয়ে এজেন্টদের ঢুকিয়ে দিয়ে আসেন। এরপর এজেন্টদের শা​রীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে বের করে দেওয়া হয়েছে। এ সময় অনেক পুলিশ সদস্য এবং নির্বাচনী কর্মকর্তারা নিজেদের অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন বলে তিনি উল্লেখ করেন।

ইশরাক বলেন, ‘আশা করেছিলাম হয়তো ক্ষমতাসীন দল জনগণের পালস বুঝতে পারবে এবং ভবিষ্যতের দলের কথা চিন্তা করে অন্তত এবার অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করবে। কিন্তু হতাশা হয়েছি, তারা দেশকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এ নির্বাচনে আমাদের অর্জন কম নয়। আমরা নগরবাসী এবং দেশবাসীকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছি যে তাদের মৌলিক অধিকার আজ আর নেই। আমি আশা করি, মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন দেশে নিজেদের অধিকার রক্ষায় দেশবাসী আবারও সোচ্চার হবে। আমি সেই দিনটির অপেক্ষায় থাকলাম।’

সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, সেলিমা রহমান ও ইকবাল হাসান মাহমুদ, ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লাহ, মো. শাহজাহান ও আবদুল আউয়াল মিন্টু, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপির (একাংশ) সাধারণ সম্পাদক শাহাদাত হোসেন সেলিমসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

Leave a Reply