মুফতি ইজাহার পালিয়েছে ॥ গ্রেনেড বিস্ফোরণে আহত একজনের মৃত্যু : চলছে পুলিশের অভিযান ॥ দুই মামলা
স্টাফ রিপোর্টার ॥ হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমির মুফতি ইজাহারুল ইসলাম পরিচালিত লালখানবাজার জামেয়াতুল উলুম আল ইসলামিয়া মাদ্রাসায় গ্রেনেড বিস্ফোরণের ঘটনায় আহতদের মধ্যে একজন মারা গেছে। তার নাম হাবিবুর রহমান। গত মঙ্গলবার ভোররাতে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায় বিস্ফোরক আইন ও এ্যাসিড নিয়ন্ত্রণ আইনে দুটি পৃথক মামলা দায়ের হয়েছে সিএমপির খুলশী থানায়। দুই মামলাতেই আসামি করা হয়েছে মুফতি ইজাহার ও তার পুত্র হেফাজতের কেন্দ্রীয় নেতা হারুন ইজাহারকে। এ ছাড়া আরও ১২ জনকে আসামি করা হয় মামলা দুটিতে। পুলিশ মুফতি ইজাহার ও তার পুত্র হারুন ইজাহারকে গ্রেফতার করতে সম্ভাব্য বিভিন্ন স্থানে তল্লাশি চালাচ্ছে। প্রশাসনের নির্দেশে মাদ্রাসাটি মঙ্গলবার থেকে বন্ধ ঘোষিত হয়েছে। ছাত্ররা সকাল ১০টার মধ্যে হল ত্যাগ করেছে। ছাত্রীদের আগামীকাল বৃহস্পতিবার নির্ধারিত একটি পরীক্ষা শেষ হওয়া পর্যন্ত হলে অবস্থানের সুযোগ দেয়া হয়েছে।
ভয়াবহ বিস্ফোরণের পর বিপুল পরিমাণ গ্রেনেড ও বিস্ফোরক তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধারের পর চট্টগ্রাম নগরীর লালখান বাজারে অবস্থিত জামেয়াতুল উলুম আল ইসলামিয়া মাদ্রাসা নামের প্রতিষ্ঠানটি এখন টক অব দ্য কান্ট্রি। পুলিশ মঙ্গলবারও মাদ্রাসার বিভিন্ন স্থানে তল্লাশি চালিয়েছে। সকালে ওই মাদ্রাসা থেকে আরও একটি তাজা গ্রেনেড উদ্ধার করা হয়। শুধু তাই নয়, মুফতি ইজাহার ও এজাহারনামীয়দের গ্রেফতারের জন্য মঙ্গলবার জামায়াত নিয়ন্ত্রিত চন্দনপুরা দারুল উলুম মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন পয়েন্টে অভিযান চালিয়েছে। কিন্তু মুফতি ইজাহার, তার পুত্র হারুন ইজাহারসহ নতুন করে কাউকে পাওয়া যায়নি।
আগামী ১২ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রাম আগমনের নির্ধারিত সময়ের আগ মুহূর্তে লালখান বাজারের হেফাজত নিয়ন্ত্রিত এই মাদ্রাসায় বিস্ফোরণের ঘটনা, বিভিন্ন বিস্ফোরক তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার এবং নগরীতে হেফাজতের সেন্টার পয়েন্ট হিসেবে গড়ে উঠায় বিভিন্ন জিজ্ঞাসার সৃষ্টি হয়েছে। পুলিশসহ প্রশাসনের কোন মহলই ধারণাই করতে পারেনি এই মাদ্রাসায় নীরবে বিস্ফোরক তৈরি হচ্ছিল নির্বিচারে। শুধু তাই নয়, এসব বিস্ফোরক ওই মাদ্রাসা থেকে তাদের বিভিন্ন পয়েন্টে পাঠানোর তথ্যও বেরিয়ে আসছে।
ইজাহার-হারুন পালালো যেভাবে ॥ মঙ্গলবার লালখানবাজার মাদ্রাসায় বিস্ফোরণ ও অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে বেলা ১১টার দিকে। বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হলেও বিষয়টিকে ল্যাপটপ চার্জার দুর্ঘটনা হিসেবে দাবি করে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ। বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত মাদ্রাসাতেই ছিলেন মুফতি ইজাহার। তিনি সংবাদ মাধ্যমের কাছে এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়াও তুলে ধরেন। বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ দল যখন নিশ্চিত হয় যে, এটি গ্রেনেড বিস্ফোরণের ঘটনা তখনই টনক নড়ে পুলিশের। কিন্তু ততক্ষণে মুফতি ইজাহার মাদ্রাসা ত্যাগ করেন। পুলিশ যখন ইজাহারকে গ্রেফতারের সিদ্ধান্ত নেয় তার আগেই ইজাহার চলে যান আত্মগোপনে। ফলে পুলিশের ভূমিকা নিয়েও জিজ্ঞাসার সৃষ্টি হয়েছে।
সিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার বনজ কুমার মজুমদার এ প্রসঙ্গে বলেন, মাদ্রাসা অভ্যন্তরে আসলে কিসের বিস্ফোরণ ঘটেছিল তা নিশ্চিত হতে পুলিশের কিছুটা সময় লেগেছিল। মূলত বিশেষজ্ঞরা আসার পরই নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, সেখানে বিস্ফোরক ছিল। তাছাড়া মাদ্রাসাকে ঘিরে নিরাপত্তা বাহিনীর পর্যাপ্ত প্রস্তুতি গ্রহণেও কিছুটা সময় লেগেছে। আর এ ফাঁকে সটকে পড়েছেন মুফতি ইজাহার।
পুলিশের দুই মামলা ॥ লালখানবাজার মাদ্রাসায় বিস্ফোরণের ঘটনায় সিএমপির খুলশী থানায় মঙ্গলবার সকাল ১০টার দিকে দুটি মামলা দায়ের হয়েছে। এ্যাসিড সন্ত্রাস দমন আইন ও বিস্ফোরক আইনে দায়েরকৃত এই দুই মামলায় আসামি করা হয়েছে মাদ্রাসার পরিচালক মুফতি ইজাহারুল ইসলাম ও তার পুত্র হেফাজত নেতা হারুন ইজাহারকে। মামলায় আরও ১২ জনকে আসামি করা হয়। এতে দেশে নাশকতা সৃষ্টির জন্য ওই মাদ্রাসায় গ্রেনেড ও বিস্ফোরক তৈরির কাজ চলছিল বলে অভিযোগ আনা হয়। বর্তমানে যারা গ্রেফতার রয়েছেন তারা হলেন- মাদ্রাসার প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের শিক্ষক তফসির আহমেদ (৫০), হেফজখানা শিক্ষা (আরবী) বিভাগের শিক্ষক মোঃ ইসহাক (৩৩), হাদিস মাধ্যমিক বিভাগের শিক্ষক আবদুল মান্নান (২৬), কিতাব বিভাগের শেষবর্ষের শিক্ষার্থী হাবিবুর রহমান (২৪) ও বোডিং সুপার মনির হোসেন (৫৫)।
হাসপাতালে একজনের মৃত্যু ॥ গ্রেনেড বিস্ফোরণ ও অগ্নিকা-ে গুরুতর আহত একজনের মৃত্যু হয়েছে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। তার নাম মোঃ হাবিব। হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মঙ্গলবার ভোর রাতে সে মারা যায়। তার শরীরের ৭০ ভাগই দগ্ধ হয়েছিল। এ ছাড়া শারীরিক অবস্থার গুরুতর অবনতি ঘটায় নুরউন নবী নামের একজনকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়েছে। তার শরীরের ৯০ ভাগ দগ্ধ হয়েছে বলে জানা গেছে চমেক হাসপাতাল সূত্রে। এই নুরউন নবী একজন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার বলে জানা যায়।
মুফতি ইজাহারের সন্ধানে অভিযান অব্যাহত ॥ হাটহাজারী মাদ্রাসার পরিচালক ও হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমির মুফতি ইজাহারুল ইসলাম ও তার পুত্র হারুন ইজাহারকে গ্রেফতার করতে গত সোমবার রাত থেকেই অভিযান শুরু করেছে পুলিশ। নগরীর বিভিন্ন সম্ভাব্য স্থানে পরিচালিত হচ্ছে অভিযান। মঙ্গলবার দুপুরে অভিযান চালানো হয় চট্টগ্রাম নগরীর চন্দনপুরা এলাকায় অবস্থিত দারুল উলুম মাদ্রাসায়। এ মাদ্রাসাটি জামায়াত নিয়ন্ত্রিত হিসেবে পরিচিত। পুলিশ সেখানে অভিযান চালালেও কাউকে খুঁজে পায়নি। গ্রেফতারের লক্ষ্যে পুলিশের অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন সিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার বনজ কুমার মজুমদার।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম নগরীতে অবস্থান হওয়ায় লালখানবাজার জামেয়াতুল উলুম ইসলামিয়া মাদ্রাসা নামের প্রতিষ্ঠানটি এখন হেফাজতে ইসলামের অন্যতম ঘাঁটি হিসেবে কাজ করছে। এই মাদ্রাসায় অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে দলের গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারণী বৈঠক। শুধু হেফাজতে ইসলামই নয়, আলোচিত এই মাদ্রাসার পরিচালক মুফতি ইজাহারুল ইসলাম নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন হরকত-উল-জিহাদ ও লস্কর-ই তৈয়বার সঙ্গেও ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত বলে ইতোপূর্বেও নানাভাবে তথ্যপ্রমাণ মিলেছে। লালখান বাজারের পাহাড়ে অবস্থিত মাদ্রাসাটি যেন অনেকটা সংরক্ষিত এলাকা। সেখানে সাধারণের প্রবেশাধিকার নেই। সরকারের কোন সংস্থার নজরদারিও নেই। ফলে শিক্ষার নামে সেখানে কি তৎপরতা চলছে তা প্রকৃতপক্ষে গোপনই রয়ে গেছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, লালখানবাজার জামেয়াতুল উলুম লালখানবাজার মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় এক হাজার। তার মধ্যে ছাত্র সংখ্যা প্রায় ৭শ’ আর ছাত্রী রয়েছে ২৫০ এর কিছু বেশি। অধিকাংশ শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছে আবাসন ব্যবস্থা। চট্টগ্রাম নগরীতে এ মাদ্রাসাটি ব্যবহৃত হচ্ছে হেফাজতে ইসলামের শেল্টার হিসেবে। হাটহাজারীকেন্দ্রিক এ সংগঠনটির নেতাকর্মীদের নিরাপদ ও নির্বিঘœ আশ্রয়স্থল লালখানবাজার মাদ্রাসা। গত মে মাসে চট্টগ্রাম নগরীর ওয়াসা মোড়কে ইসলামী চত্বর ঘোষণা করে যে অবস্থান কর্মসূচী হেফাজত শুরু করেছিল তাও মূলত নিয়ন্ত্রিত হয়েছে লালখানবাজার মাদ্রাসা থেকে। এই মাদ্রাসা থেকে হেফাজতের সমান জমায়েতে সরবরাহ করা হতো খাদ্য ও লাঠিসোটাসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম। রাতে নেতাদের থাকার ব্যবস্থাও হয়েছিল লালখানবাজার মাদ্রাসায়।