মুঈনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামানের ফাঁসি
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে পলাতক জামায়াত নেতা চৌধুরী মুঈনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামানের ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।
রবিবার দুপুরে বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যাল-২ এ রায় ঘোষণা করেন।
বৃহষ্পতিবার রায় ঘোষণার এই তারিখ নির্ধারণ করেছিলেন ট্রাইব্যুনাল। ৩০ সেপ্টেম্বর বিচারিক কার্যক্রম শেষ হলে এই মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখা হয়েছিল।
ওই দু’জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ ১১টি অভিযোগ আনা হয়। সবগুলো অভিযোগই প্রমাণিত হয়েছে।
এর আগে তিন বিচারক এজলাসে বসেন। রায় পড়া শুরুর সময় ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, এটি ট্রাইব্যুনালের ষষ্ঠ রায়। মূল রায় ১৫৪ পৃষ্ঠার। তবে ট্রাইব্যুনাল পড়বে সংক্ষিপ্ত ৪০ পৃষ্ঠার রায়।
তিনি বলেন, যেহেতু আসামিপক্ষ পলাতক; তাই রাষ্ট্রপক্ষ শুধুমাত্র রায়ের সার্টিফাইড কপিটি পাবেন। আসামিপক্ষ আত্মপক্ষ সমর্থন না করা পর্যন্ত তাদেরকে সার্টিফাইড কপি দেওয়া হবে না। সংক্ষিপ্ত আকারে রায়টি পর্যায়ক্রমে তিন বিচারপতি পড়েন।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যালের তদন্ত সংস্থা ২৮ এপ্রিল চৌধুরী মুঈনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করেন। তাদের অনুপস্থিতিতে বিচার কার্যক্রম শুরু করা যায় কি না এ ব্যাপারে দুটি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছিল। হাজির না হওয়ায় তাদের অনুপস্থিতিতে বিচার কাজ শুরু করেন ট্রাইব্যুনাল।
২৫ জুন চৌধুরী মুঈনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে ১১টি অভিযোগ গঠন করে ট্রাইব্যুনাল। রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্য নেয়া শুরু হয় ১৫ জুলাই। ২২ সেপ্টেম্বর তা শেষ হয়। আসামিপক্ষের কোনো সাফাই সাক্ষী না থাকায় ২৬ সেপ্টেম্বর যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে রাষ্ট্রপক্ষ। এরপর রাষ্ট্রনিয়োজিত আইনজীবী তাদের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। ৩০ সেপ্টেম্বর যুক্তিতর্ক শেষ হলে মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখা হয়।
জামায়াত নেতা চৌধুরী মুঈনুদ্দিন ১৯৭১ সালে আলবদর বাহিনীর অপারেশন ইনচার্জ ছিলেন এবং আশরাফুজ্জামান ছিলেন চিফ এক্সেকিউটর। পলাতক চৌধুরী মুঈনুদ্দিন বর্তমানে যুক্তরাজ্যে এবং আশরাফুজ্জামান যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন।
১১ অভিযোগ : মুঈন ও আশরাফের বিরুদ্ধে প্রথম থেকে পঞ্চম অভিযোগে রয়েছে, একাত্তরের ১০ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে দৈনিক ইত্তেফাক-এর কার্যনির্বাহী সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেন, ১১ ডিসেম্বর ভোরে পিপিআইয়ের (পাকিস্তান প্রেস ইন্টারন্যাশনাল) প্রধান প্রতিবেদক সৈয়দ নাজমুল হক, দৈনিক পূর্বদেশ-এর প্রধান প্রতিবেদক এ এন এম গোলাম মোস্তফা, ১২ ডিসেম্বর দুপুরে বিবিসির সাংবাদিক নিজাম উদ্দিন আহমেদ এবং ১৩ ডিসেম্বর শিলালিপির সম্পাদক সেলিনা পারভীনকে অপহরণ করা হয়। মুঈন ও আশরাফের নির্দেশে এবং তাঁদের অংশগ্রহণে আলবদরের সদস্যরা ওই বুদ্ধিজীবীদের অপহরণের পর হত্যা করে। তাঁদের মধ্যে সেলিনা পারভীন ছাড়া আর কারও লাশ পাওয়া যায়নি।
ষষ্ঠ অভিযোগ অনুসারে, একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর সকাল আটটা থেকে পৌনে ১০টার মধ্যে মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানের নেতৃত্বে পাঁচ-ছয়জন আলবদর সদস্য অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক সিরাজুল হক খান, আবুল খায়ের, ফয়জুল মহিউদ্দিন, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য ও চিকিত্সক মো. মর্তুজাকে তাঁদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসভবন থেকে অপহরণ করে। ১৬ ডিসেম্বরের পর মিরপুর বধ্যভূমিতে তাঁদের ছয়জনের লাশ পাওয়া যায়। সিরাজুল হক খান ও ফয়জুল মহিউদ্দিনের লাশ পাওয়া যায়নি।
সপ্তম থেকে একাদশ অভিযোগে রয়েছে, একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ও দৈনিক সংবাদ-এর যুগ্ম সম্পাদক শহীদুল্লা কায়সারকে অপহরণ করা হয়। তাঁদের কারও লাশ পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া ১৫ ডিসেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল মেডিসিন ও কার্ডিওলজির অধ্যাপক মো. ফজলে রাব্বী এবং চক্ষুবিশেষজ্ঞ ডা. আলীম চৌধুরীকে অপহরণ করা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে তাঁদের লাশ পাওয়া যায়।
এই মামলায় সাক্ষী যারা : রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী হিসেবে যারা সাক্ষ্য দেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, রায়েরবাজার বধ্যভূমি থেকে একমাত্র জীবিত ফিরে আসা এবং নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী দেলোয়ার হোসেন, শহীদুল্লা কায়সারের স্ত্রী পান্না কায়সার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর ভাতিজা ইফতেখার হায়দার চৌধুরী, মুনীর চৌধুরীর ছোট ছেলে আসিফ মুনীর, ফজলে রাব্বীর মেয়ে নুসরাত রাব্বী, আলীম চৌধুরীর মেয়ে ফারজানা চৌধুরী, গিয়াস উদ্দিনের বোন ফরিদা বানু, ভাগনি মাসুদা বানু, সিরাজুল হক খানের ছেলে এনামুল হক, আবুল খায়েরের ছোট ছেলে রাশিদুল ইসলাম, মো. মর্তুজার স্ত্রীর বড় ভাই ওমর হায়াত, সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের ছেলে তৌহিদ রেজা নূর, সৈয়দ নাজমুল হকের ছেলে সৈয়দ মর্তুজা নাজমুল ও ভাই গোলাম রহমান, আ ন ম গোলাম মোস্তফার ছেলে অনির্বাণ মোস্তফা এবং সেলিনা পারভীনের ছেলে সুমন জাহিদ।
রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে রায়কে কেন্দ্র ট্রাইব্যুনাল এলাকায় কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়। ট্রাইব্যুনালের দুটি প্রবেশপথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করা হয়। ওই এলাকায় টহল দেয় পুলিশের সাঁজোয়া যান। সংশ্লিষ্টদের তল্লাশি করে ট্রাইব্যুনালের ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়।
–