মীরসরাই ট্রাজেডি দিবস আজ
আজ ১১ জুলাই। মীরসরাই ট্রাজেডির ৩ বছর পূর্তি। ২০১১ সালের এ দিনে শোকের বন্যায় বিবর্ণ হয় মীরসরাইবাসী। সে দিনের কথা স্মরণ করে আজো চোখের জলে বুক ভাসান নিহতের বাবা-মা, স্বজন ও সহপাঠীরা। ঘটনার ৩ বছর পার হলেও নিহতদের পরিবারের কান্না থামেনি এখানো।
২০১১ সালের এই দিনে মীরসরাইয়ের বড়তাকিয়া-আবুতোরাব সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় ৪৩ জন কোমলমতি শিক্ষার্থীসহ ৪৫ জন। সে স্মৃতি মনে করে এখনো চোখের জ্বলে বুক ভাসান স্বজন ও তাদের সহপাঠীরা। চোখের জল শুকিয়ে অকালে পাথর হয়ে গেছে সন্তান হারানো অনেক বাবা-মা।
কালের স্রোতে হারিয়ে গেছে তিনটি বছর। কিন্তু সন্তান হারা বাবা-মা এখনো সেই বেদনা ভুলতে পারেনি। হারানো সন্তানের স্মৃতি আকড়ে ধরে এখনো বিলাপ করছেন তারা। প্রেমে বাধা ছবিই এখন অনেক বাবা-মায়ের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। অনেক বাবা-বাবা আবার ছেলের রেখে যাওয়া শখের জিনিসপত্রকে আকড়ে ধরে বেঁচে আছে।
মীরসরাই ট্র্যাজেডিতে একমাত্র বুকের ধন হারানো নিহত সাকিবের মা পারভীন আক্তার ছেলের ছবি নিয়ে কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, এখনো মাঝে মাঝে ছেলে আমার সঙ্গে কথা বলে। খাওয়ার সময় পেছন থেকে ‘মা’ ‘ওমা’ বলে ডাকে।
নিহত ইমনের বাবা আবুল কাশেম ও তার মা বলেন, আমাদের ছেলে মরে নাই। সে বেঁচে আছে তার রেখে যাওয়া স্মৃতির মাঝে। ছেলের লাগানো কদম গাছকে সন্তানের মতো আগলে রেখেছি। সে বেঁচে থাকবে কদম গাছ হয়ে।
এভাবে মীরসরায়ের সন্তান হারা পিতা-মাতা আজো পাগলের মতো হয়ে স্মৃতির মাঝে খুঁজে বেড়ায় তাদের প্রিয় সন্তানকে।
সরকারি অনুদান, ব্যক্তিগত সহায়তায় মীরসরাই ট্র্যাজেডির শিকার ৪৫ জনের সংসারে স্বচ্ছলতা ফিরে আসলেও মুছে যায়নি এসব পরিবারের হৃদয়ের ক্ষত।
২০১১ সালের ১১ জুলাই মীরসরাই সদরের স্টেডিয়াম থেকে বঙ্গবন্ধু-বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্টের খেলা দেখে মিনিট্রাকযোগে বাড়ি ফিরছিলেন স্কুল ছাত্ররা। পথে বড়তাকিয়া-আবুতোরাব সড়কের পশ্চিম সেদালী এলাকায় তেঁতুলতলা এলাকায় সড়কের পাশের ডোবায় পড়ে য়ায় শিক্ষার্থীদের বহনকারী মিনিট্রাকটি। এতে শিক্ষার্থীসহ ৪৫ জনের নির্মম মৃত্যু হয়।
নিহতরা মীরসরায়ের খৈয়াছরা, মায়ানী, মঘাদিয়া, সাহেরখালী এ চার ইউনিয়নের মধ্যম মায়ানী, পূর্ব মায়ানী, পশ্চিম মায়ানী, সরকারটোলা, মাস্টারপাড়া, শেখের তালুক, কচুয়া, দরগাহ পাড়া, মঘাদিয়া ঘোনা, মঘাদিয়া এবং পশ্চিম খৈয়াছরা গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। মীরসরাই ট্র্যাজেডিতে মধ্যম মায়ানী গ্রামের সবচেয়ে বেশি ছাত্র নিহত হয়। এ গ্রামের ১৬ জন স্কুল ছাত্র সেদিন প্রাণ হারায়।
মীরসরাই ট্র্যাজেডির ৩ বছর পূর্তিতে আবু তোরাব স্কুলে নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন কর্মসূচি। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে নিহতদের স্মৃতিস্তম্ভে ‘আবেগ’এ পুষ্পস্তবক অর্পণ, মিলাদ মাহফিল, আলোচনা সভা এবং জেয়ারত।
আবু তোরাব উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জাফর সাদেক জানান, সারা বছর স্কুলের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকি। কিন্তু এই দিন আসলে সেই দিনের কথা মনে পড়ে যায়। আমি তো ওদের আরেক বাবা। এতোগুলো সন্তান হারানো শোক ভুলা কখনো সম্ভব নয়। নিহতদের বাবা-মায়েরা সব সময় আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। কি করব? এ কষ্ট কোনদিনও ভুলার নয়।
এদিকে, নিহতদের পরিবারের সদস্যরা ৩ বছর পূর্তিতে এই দিনটাকে আতঙ্ক হিসেবেই দেখছেন। আপনজনের খোঁজে আবার ভয়ার্ত হয়ে পড়েছে স্বজনের চোখ। আকুল আর্তনাদ করছে মা, বাবা পরিবারের আর অন্য সবাই।
নিহত সূর্য নাথের বাবা খোকন নাথ ও মা ডলি রানী নাথ তার ছেলের নতুন জামা ও মানিব্যাগকে আজো স্মৃতি হিসাবে টেবিলেই রেখে দিয়েছে। মধ্যম মায়ানি গ্রামের নিহত সাজু চন্দ্র দাশের মা কল্পনা রানী দাশ ছেলে মৃত্যুর পর থেকেই চুপচাপ হয়ে গেছেন। ছবি বুকে নিয়ে মা কল্পনা রানী দাশ এখনো সারাদিন বসে থাকেন। কাঁদতে কাঁদতে বলেন, কত দিন না খেয়ে আমি আমার ছেলেকে বড় করেছি। ছেলে মরে গিয়ে আমার সংসারে টাকার সুখ দিলো, এ সুখ আমি চাই না। আমি আমার ছেলেকে ফেরত চাই।
সেদিনের দুর্ঘটনায় নিহত অধিকাংশ শিক্ষার্থী ছিল আবুতোরাব বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র। অন্যরা ছিল আবু তোরাব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কামাল উদ্দিন চৌধুরী কলেজের শিক্ষার্থী।
মীরসরায়ে নিহতরা হলেন- তাকিউল্লাহ মাহমুদ সাকিব, আনন্দ চন্দ্র দাশ, নুর মোহাম্মদ রাহাত, জাহেদুল ইসলাম, তোফাজ্জল ইসলাম, লিটন চন্দ্র দাশ, আরিফুল ইসলাম, উজ্জল চন্দ্র নাথ, তারেক হোসেন, মো. সামছুদ্দিন, মেজবাহ উদ্দিন, ইমরান হোসেন ইমন, কাজল চন্দ্র নাথ, সূর্য চন্দ্র নাথ, ধ্রুব নাথ, সাজু কুমার দাশ, আবু সুফিয়ান সুজন, রূপন চন্দ্র নাথ, সামছুদ্দিন, আল মোবারক জুয়েল, ইফতেখার উদ্দিন মাহমুদ, আমিন শরীফ, শরীফ উদ্দিন, সাখাওয়াত হোসেন, রাকিবুল ইসলাম চৌধুরী, কামরুল ইসলাম, সাখাওয়াত হোসেন, তারেক হোসেন, নয়ন শীল, জুয়েল বড়ুয়া, রায়হান উদ্দিন, এস এম রিয়াজ উদ্দিন, টিটু দাশ, রাজিব হোসেন, আশরাফ উদ্দিন, জিল্লুর রহমান, জাহেদুল ইসলাম, সাইফুল ইসলাম, সাইদুল ইসলাম, আশরাফ উদ্দিন পনির, রায়হান উদ্দিন শুভ, মঞ্জুর মোর্শেদ, সাখাওয়াত হোসেন নয়ন, আনোয়ার হোসেন এবং হরনাথ দাশ।
১১ জুলাই দুপুরে দুর্ঘটনার পর সারাদেশে শোকের ছায়া নেমে আসে। তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়। দুর্ঘটনার পর ১১ জুলাই রাতে উপজেলার ১৩ নম্বর মায়ানী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাস্টার কবির আহম্মদ নিজামী বাদী হয়ে মীরসরাই থানায় চালক মফিজের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন।
ঘটনার পর চালকের আসনে বসা ট্রাকের হেলপার পালিয়ে যায়। ১০ দিন পর ২১ জুলাই বরিশালের কাউনিয়া উপজেলার বেতবুনিয়ায় আত্মীয়-এর বাড়ি থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তাকে চট্টগ্রামে এনে কয়েক দফা রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ট্রাক চালক মফিজুর রহমানকে দু’টি পৃথক ধারায় ৫ বছররে সশ্রম কারাদণ্ড ও ২০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরো ৯ মাসের কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছেন চট্টগ্রামের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ফরিদা ইয়াসমিন।
ঘটনার প্রথম বর্ষপূর্তিতে নিহতদের স্মরণে নির্মাণ করা হয়েছিল স্মৃতিস্মারক ‘আবেগ’। ঘটনাস্থলে নির্মাণ করা হয়েছে মূল স্মৃতিস্তম্ভ অন্তিম। নিহতের স্মরণে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ সাইফুল কবীর দীর্ঘদিনের নিরলস প্রচেষ্টায় ‘আবেগ’ ও ’অন্তিম’ নামে দু’টি স্মৃতি স্তম্ভের নক্শা এঁকেছিলেন। তবে ‘আবেগ’ নির্মাণ হলেও এখনো আলোর মুখ দেখেনি ‘অন্তিম’।