মায়ের নামে সন্তানের নাম কেন নয়?
পাবলো পিকাসো বা মেরিলিন মনরোর মতো বিখ্যাতজনদের কেউ কেউ তাঁদের মায়ের নামেই পরিচিত হয়েছেন। নেদারল্যান্ডে কোনো কোনো ক্ষেত্রে মায়ের নামে সন্তানের পরিচিতির রীতি আছে। স্পেন ও স্প্যানিশ ভাষাভাষী দেশগুলোতে সন্তানের নামে বাবার নামের পাশাপাশি মায়ের নাম থাকাটাই রীতি। কিন্তু দুনিয়াজুড়ে এখনো মায়ের নামে সন্তানের নাম রাখা নিয়ে আছে নানা অস্বস্তি।
ব্রিটিশ লেখক ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক রেবেকা হার্ডি চান তাঁর সন্তানদের নামে ওদের বাবার নাম নয়, মায়ের নামটাই থাকুক। এক মায়ের এ মনোবাসনাকে বৈপ্লবিক কিছুও মনে করেন না রেবেকা, কিন্তু তাঁর এ ইচ্ছাকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেননি অনেকেই। দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় শুক্রবার এক ফিচার প্রতিবেদনে এ নিয়ে তাঁর ভাবনা ও অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন রেবেকা হার্ডি। এখানে প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য তারই সংক্ষিপ্তসার তুলে ধরা হল।
রেবেকা লিখেছেন, আমার বয়স যখন ১২, তখন ‘এভরিথিং বাট দ্য গার্লে’র একটা গান আমার মনে গভীর দাগ কেটেছিল। বুঝে বা না বুঝেই গানের যে লাইনগুলো আমি গুন গুন করতাম তা হলো— ‘সন্তানকে একটা নাম দিতেই হয়/ হ্যাঁ, তুমি বলো তাঁরটা, দোষ কী আমারটায়? বলো দোষ কী আমারটায়?’ জানি না গানটির লেখক ট্র্যাসি থর্ন ১২ বছরের মেয়েদের মনে কিছু গেঁথে দিতে চেয়েছিলেন কি না, কিন্তু কথাগুলো নিজেরাই নিজেদের স্থান করে নিয়েছিল। ২০ বছর পর আমার প্রথম সন্তানের নাম রাখার সময়ে গানটা আবার আমার জীবনে ফিরে আসে।
তাঁর মেয়ের নামকরণ প্রসঙ্গে রেবেকা লিখেছেন, ‘আমাদের মেয়ে পারিবারিক নাম হিসেবে বাবার নামের বদলে আমার নাম পেয়েছিল। বৈপ্লবিক, না? আপনি নিশ্চয়ই এমন ভাবছেন না? ভাবছেন কি? অন্তত এই আলোকপ্রাপ্ত, তথাকথিত ‘লৈঙ্গিক সমতার’ যুগে। কিন্তু দৃশ্যত বিষয়টি তা-ই—বাবা-মা দুজনের নামই হাইফেনযুক্ত হয়ে পারিবারিক নাম হিসেবে থাকাটা আজকাল চালু হলেও শুধু মায়ের নামে নাম এখনো বিরল।’ সাম্প্রতিক এক জরিপ অনুযায়ী মাত্র ৪ শতাংশ নারীর ক্ষেত্রে হয়তো নিজের নামে সন্তানের নাম রাখার সুযোগ হয়। আর বিশ্বমানচিত্রে নজর বোলালে দেখা যায় যে বিষয়টি সাধারণভাবে চর্চিতও নয়।
রেবেকা তাঁর লেখায় বলেছেন, তবুও; দুনিয়াজুড়ে গণভাবে মেনে চলা এই চর্চায় আমি বিভ্রান্ত হয়ে যাই। নিশ্চিতভাবেই, অনেক নারীই কি তাঁদের পারিবারিক নামটাই বহন করতে চান? নিশ্চিতভাবেই কি আমরা ওই নাম ঘৃণা করি না? করি কী? আমি যখন এ নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম, তখনো আমার কোনো ধারণা ছিল না যে এতে পুরুষরা আঘাত পাবেন। আমার কোনো ধারণাই ছিল না যে আমি একেবারেই নিগৃহীত হওয়ার মতো সংখ্যালঘু হয়ে যাব। এ বিষয়ে আমার যুক্তি কিছুটা ব্যক্তিগত এবং কিছুটা রাজনৈতিকও। এটা ঠিক যে বাস্তব ও আবেগের নিরিখেও আমার সন্তানেরাই এমন একটা পারিবারিক নামের শেষ বহনকারী হবে, যা আমার ভালোই লাগত। কিন্তু ওই অবাধ্য চিন্তাও মাথায় আসে যে, কেন ওরা বিনা বিচারে বাবার নামের বহনকারীই হবে? কতটা লিঙ্গবৈষম্যমূলক, কী অচল ধ্যানধারণা এটা!
দাম্পত্যে বিষয়টি নিয়ে স্বামীর সঙ্গে আলোচনায় যে অভিজ্ঞতা রেবেকা পেয়েছেন তা লিখতে গিয়ে তিনি উল্লেখ করেন, ‘সৌভাগ্যবশত আমার জীবনসঙ্গী অ্যান্ড্রু নির্বিঘ্ন জীবনযাপনকারী একজন আলোকিত মানুষ। বিষয়টি নিয়ে ঠান্ডা মাথায় কথা বলার জন্য পানীয় হাতে বসে শান্ত হয়ে তার সঙ্গে কথা বলি আমি। এ প্রসঙ্গে অ্যান্ড্রুর বক্তব্য, এ নিয়ে সে সুখী। অ্যান্ড্রু বলেছিল, তার কাছে এটাই স্বাভাবিক মনে হয়েছে। সে বলেছিল, ‘বাচ্চারা তোমার নামই পাবে—বিয়ে বা অন্য কিছুতেই আমরা প্রথাগত জীবনযাপন করিনি। তুমি নয় মাস ওদের গর্ভে ধরেছ এবং জন্ম দিয়েছ। ওরা তোমার পাবে—এটাই আমার কাছে ভালো মনে হয়েছে।’ হাইফেনযুক্ত করে বাবা-মা দুজনের নাম দিলে কেমন হয়?
রেবেকা লিখেছেন, এ প্রসঙ্গে অ্যান্ড্রু জানিয়েছিল, ‘ওটা ঝামেলার মনে হয়, যেন আমরা জোর করে কিছু করছি। আর তারপর কথা হবে, কার নাম আগে থাকবে তা নিয়ে। আমি বলতে চাইছি, নিজের পারিবারিক নাম হারিয়ে অন্য কারও নাম ধারণ করার পুরো বিষয়টাই গোলমেলে—বিয়ের পর সব মেয়ের কাছ থেকেই এটা আশা করা হয়। আর এটা মেয়েদের জন্য পুরুষের কাছে নিজের অধীনতার পরিচয় বহনকারী একটা প্রকট প্রতীক।’ আর এর উত্তরে রেবেকা বলেছিলেন, আমি জানি! তবুও জানতে চাই, তোমার কী মনে হচ্ছে না যে তোমাকে খাটো করা হচ্ছে? এরপর রেবেকা লিখেছেন, জবাবে মৃদু হেসে অ্যান্ড্রু জানাল, ‘ইতিহাস জুড়েই হয়তো নিজের নামের ওই বন্ধনটা পুরুষদের প্রয়োজন ছিল নিজেকে আরও বেশি দায়িত্বশীল আর সংযুক্ত রাখার জন্য। কিন্তু আজকের দিনে এটা অর্থহীন, আত্মকেন্দ্রিক এবং পুরোনো ধ্যানধারণার পরিচায়কই বটে। ‘হয়তো ছোট্ট একটা ভয় কাজ করতে পারে যে কোনোদিন সীমান্ত-চৌকিতে বা এমন অন্য কোথাও নাম নিয়ে ওরা ঝামেলায় পড়তে পারে। আর তা ছাড়া আমি আমার বাবা ও মা দুই পক্ষের পারিবারিক উত্তরাধিকারকেই সমান গুরুত্ব দিই। আমার নিজের কাছে সন্তানেরা আমাদের দুজনেরই, যেমন এখনকার মানুষেরাও। বাপ-দাদার নামে কী আসে-যায়।’
খুবই আধুনিক এমন দম্পতির জন্য সন্তানের নাম রাখা নিয়ে পিতৃতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা বদলে ফেলা নিয়ে তেমন কোনো সংকট সৃষ্টি না হলেও এ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণে সমাজ এখনো প্রস্তুত নয় বলে মনে করেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিত্সক নিকোলা ডাইসন। তাঁর মতে, পরিবারের ধারণা বদলে যাচ্ছে। পঞ্চাশের দশকের পরিবারের ধারণা আজকের দিনে অনেকটাই বদলেছে। তাই আমাদের সন্তানের নামকরণের সংস্কৃতিও বদলাবে এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
কোনো দম্পতির মধ্যে এ নিয়ে বিরোধ না থাকলেও অনেক সময় বৃহত্তর পরিবারের সদস্যরা তাঁদের বংশগতির ধারক-বাহকদের নাম রাখা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠতে পারেন। চিকিত্সক ডাইসন বলছেন, ‘এসব ক্ষেত্রে বিরোধ যা-ই থাকুক না কেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো শিশুদের ওই বিরোধ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা। তাদের এটা বুঝতে না দেওয়া যে ওদের নাম নিয়েই যুদ্ধটা চলছে। এটা তাদের পরিচয়, নিজের সম্পর্কে তাদের ধারণা।’