মাশরাফিদের উপহার
১৩ জুলাই, ২০১৫
যে কোনো ধরনের ক্রিকেটে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে এতদিন জয় ছিল মাত্র একটি। সেই ২০০৭ বিশ্বকাপে। আট বছরের সেই খরা ঘুচিয়ে কাল মিরপুরে আরেকটি গৌরবগাথা লিখল টাইগাররা। প্রবল প্রতাপশালী দক্ষিণ আফ্রিকাকে খড়কুটোর মতো উড়িয়ে দিয়ে তিন ম্যাচের সিরিজে ১-১-এ সমতা ফেরানোর পাশাপাশি ২০১৭ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে খেলা শতভাগ নিশ্চিত করে ফেলল বাংলাদেশ। দ্বিতীয় ওয়ানডেতে দক্ষিণ আফ্রিকাকে সাত উইকেটের বিশাল ব্যবধানে হারিয়ে সাময়িক দুঃসময়কে যেন পাল্টা জবাব দিল টাইগাররা। দক্ষিণ আফ্রিকাকে মাত্র ১৬২ রানে বেঁধে ফেলে দাপুটে জয়ের ভিতটা গড়ে দিয়েছিলেন বোলাররা। সেই ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে লাল-সবুজের জয়কেতন উড়িয়েছেন ব্যাটসম্যানরা। রাবাদার জোড়া আঘাতে ২৪ রানের মধ্যে তামিম ইকবাল ও লিটন দাস সাজঘরের পথ ধরলেও কোনো বিপদ ঘটতে দেননি সৌম্য সরকার ও মাহমুদউল্লাহ। তৃতীয় উইকেটে তাদের ১৩৫ রানের অনবদ্য জুটিই ম্যাচ থেকে ছিটকে দেয় দক্ষিণ আফ্রিকাকে। জয়ের দুয়ারে দাঁড়িয়ে ঠিক ৫০ রানে মাহমুদউল্লাহ আউট হলেও ৮৮ রানে অপরাজিত থেকে দলকে জিতিয়েই মাঠ ছাড়েন সৌম্য সরকার। দু’ম্যাচের টি ২০ সিরিজ ও প্রথম ওয়ানডেতে প্রতিরোধহীন হারের পর কাল লাল-সবুজের জয়কেতন উড়িয়ে বাংলাদেশ ফিরল সেই চেনা বাংলাদেশে। ১৩৪ বল ও সাত উইকেট হাতে রেখেই হাসতে হাসতে জয়ের বন্দরে পৌঁছে যায় বাংলাদেশ।
ঘরের মাঠে টানা চার ম্যাচে হারের পর বাংলাদেশ দলের সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছিল। জয়ে ফেরার চাপ, সঙ্গে জরুরি সভা ডেকে বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসানের কড়া ভাষায় সতর্কবার্তা। অন্য কোনো সময় হলে এ চাপেই হয়তো ভেঙে পড়ত টাইগাররা। কিন্তু এ যে বদলে যাওয়া বাংলাদেশ। চাপকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে ব্যাটিং, বোলিং ও ফিল্ডিংয়ে উড়ন্ত পারফরম্যান্স। উড়তে থাকা দক্ষিণ আফ্রিকাকে মাটিতে নামিয়ে সাত উইকেটের দাপুটে জয়। পেস-স্পিন কম্বিনেশনে প্রোটিয়াদের ১৬২ রানে গুটিয়ে দিয়ে সৌম্য সরকার (৮৮*) ও মাহমুদউল্লাহর (৫০) হাফ সেঞ্চুরিতে ২৭.৪ ওভারে জয় নিশ্চিত। তিন ম্যাচের সিরিজ এখন ১-১-এ সমতায়, মাশরাফিদের সামনে সিরিজ জয়ের হাতছানি। চট্টগ্রামে বুধবারের তৃতীয় ও শেষ ম্যাচটি অলিখিত ফাইনালে পরিণত হয়ে গেল। এ জয়ে সব শংকা কাটিয়ে ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে খেলা নিশ্চিত করল বাংলাদেশ।
প্রথম ওডিআইতে উইকেটশূন্য মুস্তাফিজুর এদিন আবারও স্বমহিমায়। বাংলাদেশের এই বিস্ময় পেসার আগের সিরিজে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের নাস্তানাবুদ করে ছাড়লেও হাশিম আমলা, ফাফ ডু প্লেসিদের বিপক্ষে প্রথম ওডিআইতে সুবিধা করতে পারেননি। এদিন ফের জ্বলে উঠলেন তিনি। টস জিতে প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেয় দক্ষিণ আফ্রিকা। শুরুতেই অসাধারণ এক ডেলিভারিতে কুইন্টন ডি কককে ফিরিয়ে দেন মুস্তাফিজুর। কার্টার দিয়ে হয়নি, গতিসম্পন্ন শর্ট ডেলিভারিতে ডি কক অসহায়ের মতো ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে ক্যাচ তুলে দেন। মুস্তাফিজের দ্বিতীয় শিকার ডুমিনি। আর রাবাদাকে ফিরিয়ে দিয়ে নিজের তৃতীয় উইকেট নেন এই তরুণ টাইগার-পেসার। তার অফ-কাটারে ছত্রখান হয়ে যায় রাবাদার মিডল স্টাম্প।
তবে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ১৬২তে গুটিয়ে ফেলার কৃতিত্ব শুধু মুস্তাফিজুরের একার নয়, নাসিরেরও তাতে সমান অবদান রয়েছে। সিম ও স্পিন দিয়ে প্রোটিয়দের বশীকরণে মুস্তাফিজুর ও নাসির পুরোপুরি সফল। ২০০৯-এর নভেম্বরের পর ওডিআইতে এটাই দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে কম রানে অলআউট হওয়ার নজির।
সেবার তাদের মাত্র ১১৯ রানে অলআউট করেছিল ইংল্যান্ড। মিরপুরে প্রথম ওডিআইতে রাবাদার গতির কাছে মার খেয়েছিলেন তামিম ইকবালরা। কাল হাশিম আমলারা মার খেলেন মুস্তাফিজুরের গতি ও নাসিরের ‘অফ-স্পিনের’ কাছে। ফাফ ডুপ্লেসির ধৈর্য এবং ফারহান বেহারডিয়েনের শেষের দিকে চালিয়ে খেলার নীতিতে সফরকারীরা ১৫০ পার করে। নাসিরের তিন উইকেটের অন্যতম ডু প্লেসি ও রিলে রুশো।
মুস্তাফিজুর অহর্নিশ নিজের ট্রেডমার্ক অফ-কাটারের সঙ্গে ইয়র্কার যোগ করে প্রোটিয়া ব্যাটসম্যানদের হেনস্থা করেছেন। প্রথম ওডিআইতে একাদশের বাইরে থাকা রুবেল হোসেন লাইন-লেন্থ দিয়ে তটস্থ রাখেন সফরকারী ব্যাটসম্যানদের। পুরস্কার হিসেবে পান দুটি উইকেট।
প্রথম ১০ ওভারে দক্ষিণ আফ্রিকা ছিল ৩৮/১। তখনই বোঝা যায়, এদিন তারা সুবিধা করতে পারবে না। কুইন্টন ডি কককে ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে সাব্বির রহমানের ক্যাচে পরিণত করেন মুস্তাফিজুর। হাশিম আমলা ও ফাফ ডু প্লেসি যখন ইনিংস মেরামতে মনোযোগী হওয়ার চেষ্টা করছেন, তখনই আঘাত হানেন রুবেল। ২২ রানে আমলার অফ-স্টাম্প উপড়ে দেন রুবেল। নিজের দ্বিতীয় ওভারের প্রথম বলে। দক্ষিণ আফ্রিকা ওই ওভারে কোনো রান নিতে পারেনি। রুবেলের পরের ওভারেও রানশূন্য থাকে প্রোটিয়ারা। ডু প্লেসি ও রিলে রুশো দু’জনকেই সন্ত্রস্ত রাখেন রুবেল। তাতে যোগ দেন সাকিব। আর নাসির এসে রুশোর দফারফা করে দেন।
ডেভিড মিলারও তেমন নড়াচড়া করার সুযোগ পাননি স্পিনের জালে বন্দি হয়ে। যদিও রুশো থেকে তার স্ট্রাইক রেট খানিকটা ভালো ছিল। কিন্তু নিজের আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ের ছায়া হয়ে রইলেন তিনি। শেষমেশ মাহমদুউল্লাহকে নিজের উইকেট দিতে বাধ্য হন মিলার মিড-উইকেটে ক্যাচ তুলে দিয়ে। দক্ষিণ আফ্রিকা তখন ৭৪/৪। ডু-প্লেসি নিজেদের মিডল-অর্ডারকে দুমড়ে-মুচড়ে যেতে দেখেন চেয়ে চেয়ে। মাহমুদউল্লাহর লেগ-বিফোরের আপিল থেকে রক্ষা পান তিনি ভাগ্যের সহায়তায়। যদিও রিপ্লেতে দেখা যায, বল তার মিডল স্টাম্পকেই আঘাত করত। ডু প্লেসি সে যাত্রা বেঁচে গেলেও ১০ ডেলিভারির পর নাসিরকে মিস-হিটের খেসারত দেন লং-অনে ক্যাচ দিয়ে।
ডু প্লেসির বিদায়ের পর দক্ষিণ আফ্রিকার লোয়ার-অর্ডার বাংলাদেশের করুণার পাত্র হয়ে ওঠে। ফারহান বেহারডিয়েন প্রযুক্তির আশ্রয় নিয়ে প্রথম দফা বেঁচে যান। নাসিরের অফ-ব্রেকে আম্পায়ার এনামুল হক আউট দিয়েছিলেন রেহারডিয়েনকে। রিভিউ নিয়ে সে যাত্রা নিষ্কৃতি পান বেহারডিয়েন। মাশরাফি ফেরান তকে। ওটাই সফরকারীদের শেষ উইকেট।
বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসানের ক্লাস কি তাহলে কাজে দিল, নাকি নাসির হোসেন যে আত্মবিশ্বাসের কথা বলছিলেন তারই পরিস্ফুটন? শেষ চার ম্যাচে হারের কারণ হিসেবে ব্যাটসম্যানদেরই দায়ী করা হয়েছে। কিন্তু ওই ম্যাচগুলোতে বোলাররাও যে ভালো করতে পারেননি সেটা চোখে পড়েছে কমই। মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে সূর্য যেমন হেসেছে, বাংলাদেশের বোলাররাও তেমনি ফিরেছেন স্বমহিমায়। উইকেটে পেসারদের জন্য কিছু থাকায় একাদশে মাশরাফি মুর্তজা ও মুস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে যোগ হলেন রুবেল হোসেন। আগের ম্যাচে কাগিসো রাবাদা ছয় উইকেট নেয়ার পর মুস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে তার তুলনা করা হচ্ছিল। দু’জনের বয়সও প্রায় একই। ভারতের বিপক্ষে সাড়া ফেলে দেয়া মুস্তাফিজ দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে প্রথম তিন ম্যাচে ছিলেন নিষ্প্রভ। কাল আবার ফিরলেন কাটার নিয়ে। পেস-স্পিন কম্বিনেশনে মাত্র ১৬২ রানেই শেষ প্রোটিয়ারা। বাংলাদেশের বিপক্ষে এটাই তাদের সর্বনিু রান।
বাংলাদেশের প্রথম উইকেট এনে দেন মুস্তাফিজই। দুই পেসারের নীতিতে একাদশে সুযোগ পাচ্ছিলেন না রুবেল হোসেন। কাল যেন বিশ্বকাপের স্মৃতি ফিরিয়ে আনলেন তিনি। গতি, বাউন্স আর ইর্য়কারের মিশেলে অ্যাডিলেড ফিরিয়ে আনলেন মিরপুরে। বলের গতি কখনও ১৪৩ ছুঁয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার রানরেট কখনোই চারের উপরে উঠেনি। কাল দলে কোনো বিশেষজ্ঞ স্পিনার ছিলেন না। কিন্তু অধিনায়ক যে নাসির হোসেনকেই সেরা অফ-স্পিনার খেতাব দিয়ে ফেলেছেন। তার প্রমাণও দিলেন নাসির। নিজের প্রথম বলেই রিলে রুশোর অফ-স্টাম্প ফেলে দিলেন। অলরাউন্ড পারফরম্যান্স অব্যাহত রাখলেন ইনিংসের শেষ বল পর্যন্ত। আট ওভার বল করে নিয়েছেন আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ উইকেট- সেরা ফর্মে থাকা ফাফ ডু প্লেসি ও কাইল অ্যাবটকে।
প্রথম ২৫ ওভারে প্রোটিয়াদের স্কোর ছিল ৮০/৪। ১০০ রানে পৌঁছতে তাদের সময় লেগেছে ৩১.৩ ওভার। এই সিরিজ থেকেই আইসিসির নতুন নিয়মে খেলা হচ্ছে। ব্যাটিং পাওয়ার প্লে উঠে গেলেও বোলিংয়ের সময় ফিল্ডারদের অবস্থান বোঝাতে পুরো ইনিংসে তিনটি পাওয়ার প্লে ধরা হয়। প্রথম দশ ওভারে বৃত্তের বাইরে দু’জন, ১১-৪০ ওভার পর্যন্ত সর্বোচ্চ চারজন এবং শেষ ১০ ওভারে পাঁচজন থাকতে পারবেন। মিডল ওভারগুলোতেই আক্রমণাত্মক ফিল্ডিং সাজিয়ে যেন পাওয়ার প্লে বানিয়ে দিলেন মাশরাফি নিজেই। দু’জন ফিল্ডারকে বাউন্ডারির বাইরে দেখা গেল অনেকটা সময়েই। সিরিজে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানকে যেন ব্যাটসম্যানরা উইকেটই দিতে চাচ্ছেন না। কাল উইকেটশূন্য থাকলেন; কিন্তু ১০ ওভারে কিপটে বোলিং করে দিলেন মাত্র ৩০ রান। এর মধ্যে মুস্তাফিজ তুলে নেন তিন উইকেট।