মান্নান খান দম্পতির বিরুদ্ধে চার্জশিট আজ
মান্নান খান দম্পতির বিরুদ্ধে চার্জশিট আজ
অবৈধ সম্পদ অর্জন মামলায় সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আবদুল মান্নান খান এবং তার স্ত্রী সৈয়দা হাসিনা সুলতানার বিরুদ্ধে চার্জশিট দিচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আজ এ চার্জশিট আদালতে দাখিল করা হবে বলে জানা গেছে। গত মঙ্গলবার এ চার্জশিট অনুমোদন দেয় দুদক। এ ছাড়া অবৈধ সম্পদ অর্জন মামলায় কক্সবাজারের সরকারদলীয় এমপি আবদুর রহমান বদির বিরুদ্ধেও চার্জশিট অনুমোদন হয়েছে। দুটি মামলাতেই মান্নান দম্পতি জামিনে রয়েছে।
দুদক সূত্র জানায়, আবদুল মান্নান খানের বিরুদ্ধে ২ কোটি ৬৫ লাখ ৫৭ হাজার ৪৪২ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং ৩০ লাখ ৯৬ হাজার ৬১২ টাকার সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগ আনা হয়েছে চার্জশিটে। পৃথক মামলায় তার স্ত্রী সৈয়দা হাসিনা সুলতানার বিরুদ্ধে ৩ কোটি ৩৫ লাখ ২৭ হাজার ২৯ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়। তারা সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন ১ কোটি ৮৬ লাখ ৩ হাজার ৯১২ টাকার। উভয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিচালক মো. নাসির উদ্দিন দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪-এর ২৬(১) ও ২৭(২) ধারায় আজ অভিযোগপত্র দাখিল করবেন। অনুসন্ধান ও তদন্ত কর্মকর্তাসহ এ মামলায় সাক্ষী করা হয়েছে ১২ জনকে।
সূত্র জানায়, গত বছর ২১ আগস্ট মান্নান খানের বিরুদ্ধে ৭৯ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করে দুদক। এর দু’মাস পর ওই বছর ২১ অক্টোবর মান্নান খানের স্ত্রী সৈয়দা হাসিনা সুলতানার বিরুদ্ধেও ৩ কোটি ৪৫ লাখ ৫৩ হাজার ৬৪০ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে মামলা করা হয়। ৯ মাস ধরে চলে মামলাটির তদন্ত। তদন্ত প্রক্রিয়ায় মান্নান দাবি করেন, তার কোনো অবৈধ সম্পদ নেই কিংবা অর্জিত সম্পদের কোনো তথ্য গোপন করেননি। তবে দুদকের তদন্তে তার এ দাবি মিথ্যা প্রমাণিত হয়।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, অ্যাডভোকেট আবদুল মান্নান খান যে সম্পদ বিবরণী দাখিল করেন তাতে তিনি ৩০ লাখ ৯৬ হাজার ৬১২ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন। তিনি গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে ২ কোটি ৬৫ লাখ ৫৭ হাজার ৪৪২ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন। অবৈধ অর্থ উপার্জনের তথ্য তুলে ধরে বলা হয়, তিনি যুক্তরাজ্য সফর শেষে দেশে ফেরার সময় ৪৩ হাজার ৪৫০ ইউরো আনেন। সম্পদ বিবরণীতে তিনি এ অর্থ ‘উপহার’ হিসেবে দেখালেও প্রকৃত তথ্য গোপন করেন। জিজ্ঞাসাবাদেও এ অর্থের বিশ্বাসযোগ্য কোনো উৎস ও প্রমাণ তিনি উপস্থাপন করতে পারেননি।
সুতারপাড়া ইউনিয়নের অধীন কাটাখালী গ্রামে ৮০৮/৮০৮/২০ হোল্ডিং নম্বরের জমিতে আবদুল মান্নান খান নকশাবহির্ভূতভাবে সুরম্য একটি ভবন নির্মাণ করেছেন। এটির প্রকৃত নির্মাণ ব্যয় দেড় কোটি টাকার মতো হলেও জিজ্ঞাসাবাদে তিনি ৭৮ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে বলে জানিয়েছেন।
মান্নান খান তার সম্পদ বিবরণীতে সঞ্চয়পত্র ও প্রাইজবন্ড থাকার বিষয়টি উল্লেখ করলেও খিলগাঁওয়ের গজারিয়া মৌজায় ১৫ শতাংশ নাল জমি, গুলশানের ভাটারা মৌজায় ৮ শতাংশ জমি, বেরাইদে ২৯ শতাংশ জমি, ইস্কাটনের ইউনিক হাইটসে কেনা কমার্শিয়াল ফ্লোর, দোহার-নবাবগঞ্জের বিভিন্ন মৌজায় কেনা জমির প্রকৃত মূল্য উল্লেখ করেননি।
অ্যাডভোকেট আবদুল মান্নান খান বিগত মহাজোট সরকারের গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে তার বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। অর্থের বিনিময়ে সরকারি বাড়ি হাতছাড়া করা, সরকারি প্লট ও ফ্ল্যাট বরাদ্দে দুর্নীতি-অনিয়ম এবং রাজউকের হাউজিং প্রকল্পে প্লট বরাদ্দসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার দুর্নীতি ধরা পড়ে। একজন অপেশাদার আইনজীবী থেকে তিনি রাতারাতি হয়ে ওঠেন কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় তিনি যে সম্পদ বিবরণী দাখিল করেন তাতে পাঁচ বছরে তার সম্পদ বেড়ে দাঁড়ায় ১০৭ গুণ। বিষয়টি নিয়ে টিআইবি ও সুজনসহ দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা সোচ্চার হলে দুদক তাদের ওই হলফনামা ধরে ২২ জানুয়ারি মান্নান খানের সম্পদ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়।
অনুদ্ঘাটিতই থাকল মান্নানের প্রকৃত সম্পদের হিসাব : বিপুল সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেলেও বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে মান্নান খানের প্রকৃত সম্পদের বিস্তারিত তথ্য খুঁজে পায়নি দুদক। নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, মান্নান খান দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণীতে খিলগাঁওয়ে কিছু স্থাবর সম্পত্তি থাকার কথা উল্লেখ করলেও রাজধানীর ১১৭, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউয়ে ইউনিক হাইটসে চারটি অ্যাপার্টমেন্টের প্রকৃত মূল্য প্রদর্শন করেননি। দলিলমূল্য ১ কোটি ৮১ লাখ ৮৬ হাজার ৩৮৬ টাকা দাবি করলেও একেকটি অ্যাপার্টমেন্টের মূল্যই ২ কোটি টাকা বলে সূত্র জানায়। তবে এই কমার্শিয়াল স্পেসগুলো এওয়াজ বদলের মাধ্যমে অর্জন করেছেন বলে চাতুর্যের সঙ্গে সম্পদের তথ্য তিনি গোপন করেন। এওয়াজ বদলের দলিল পরে বাতিল করে তিনি তথ্য গোপন প্রমাণ করেছেন। গুলশান থানাধীন ভাটারা মৌজায় কেনা ৮ শতাংশের প্লটের প্রকৃত মূল্য গোপন করেন তিনি। প্লটটির দলিলমূল্য ২৩ লাখ টাকা দেখানো হলেও প্রকৃত মূল্য হবে ২ থেকে আড়াই কোটি টাকা। ২০১১ সালে রাজধানীর খিলগাঁও গজারিয়া মৌজায় ১৫ শতাংশ জমি কিনে মান্নান খান দলিলমূল্য দেখিয়েছেন মাত্র ৮ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। এটির প্রকৃত মূল্য বেরিয়ে আসে দেড় কোটি টাকা। গুলশানের বড় বেরাইদ মৌজায় ৬০ শতাংশ জমি থেকে ২৯ শতাংশ জমির এওয়াজ বদল করলেও অবশিষ্ট ৩১ শতাংশ নিজের মালিকানায় থেকে যাওয়ার বিষয়টি তিনি গোপন করেন সম্পদ বিবরণীতে। বাজার দর অনুযায়ী যার মূল্য হবে আড়াই থেকে ৩ কোটি টাকা। ২০১২ সালে মান্নান খান ব্যাংক ঋণ শোধ করেছেন পৌনে ১২ লাখ টাকা। যা তার বৈধ আয় থেকে শোধ করা ছিল অসম্ভব। হলফনামায় ১ কোটি ৪৪ লাখ ৬৩ লাখ ২২৭ টাকার উৎস দেখিয়েছেন মৎস্য চাষ থেকে। তার স্ত্রী সৈয়দা হাসিনা সুলতানা গৃহিণী হওয়া সত্ত্বেও হলফনামায় উল্লেখ করেছেন ‘ব্যবসায়ী’ হিসেবে। মৎস্য খাত থেকে স্ত্রীর আয় দেখান ৮৫ লাখ টাকা। দুদক অনুসন্ধানে মান্নান খান কিংবা তার স্ত্রীর নামে কোথাও কোনো মৎস্য খামারের অস্তিত্ব পায়নি। গ্রামের বাড়িতে দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে আলিশান ভবন নির্মাণ করলেও ওই বাড়ির তিনি একক মালিক নন বলে জানান জিজ্ঞাসাবাদে, যা মিথ্যা।
সহযোগিতা করেনি পূর্ত বিভাগ : গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী হিসেবে টানা পাঁচ বছর রাজত্ব করেছেন আবদুল মান্নান খান। এ সময় তিনি নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলিসহ নানা প্রক্রিয়ায় পূর্ত বিভাগে তৈরি করেছেন ‘নিজস্ব জনবল বাহিনী’। এ বাহিনীর লোকজনও মান্নান খান ও তার স্ত্রীর মাধ্যমে কাছ থেকে ভোগ করেছেন সব ধরনের অবৈধ সুযোগ-সুবিধা। এ কৃতজ্ঞতা বোধ থেকেই মান্নান খানের বিরুদ্ধে তদন্ত চলাকালে পূর্ত বিভাগের কাছে আশানুরূপ সহযোগিতা দুদক পায়নি বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, মান্নানের গ্রামের বাড়িতে নির্মিত আলিশান ভবনের প্রকৃত ব্যয় নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীন পূর্ত বিভাগের অসহযোগিতার কারণে। গ্রামের বাড়ি নির্মিত ভবনটির অনুমোদিত কোনো নকশা নেই। তাই কি ধরনের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে কত টাকা ব্যয় হয়েছে-এর প্রকৃত তথ্য দুদক উদ্ধার করতে পারেনি। তদন্ত প্রক্রিয়ায় গত বছর নভেম্বরে পূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রকৌশল সহযোগিতা চায় দুদক। এর পরিপ্রেক্ষিতে গণপূর্ত অধিদফতরের পূর্ত বিভাগ-৩, ঢাকার নির্বাহী প্রকৌশলী একেএম মনিরুজ্জামান গত বছর ৩০ নভেম্বর ২ সদস্যের সিভিল ও ইলেকট্রিক্যাল প্রকৌশলীর সমন্বয়ে দুটি টিম গঠন করেন। পূর্ত বিভাগ-৪-এর উপবিভাগীয় প্রকৌশলী স্বর্ণেন্দু শেখর মণ্ডলকে আহ্বায়ক করা হয়। উপসহকারী প্রকৌশলী মনিরুজ্জামান এ টিমের সদস্য ছিলেন। গত বছর ২ ডিসেম্বর গঠিত অন্য টিমের আহ্বায়ক গণপূর্ত (ই/এম) বিভাগ-৬-এর উপবিভাগীয় প্রকৌশলী ফরহানা আহম্মেদ । সদস্য করা হয় মো. আবদুল খালেক আকন্দকে। এ দুটি টিম গঠিত হলেও রহস্যজনক কারণে তারা মান্নান খানের বাড়ি পরিদর্শনে যায়নি। দুদককে প্রতিবেদনও দেয়নি। ফলে মান্নান খানেরই দেয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে চার্জশিট দাখিল করতে হচ্ছে দুদককে। পূর্ত বিভাগ কেন সহযোগিতা করেনি- জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা নাসির উদ্দিন কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
বদির চার্জশিট অনুমোদন : কক্সবাজারের সরকারদলীয় এমপি আবদুর রহমান বদির বিরুদ্ধেও চার্জশিট অনুমোদন করেছে দুদক। চার্জশিটে তার বিরুদ্ধে ৬ কোটি ৩৩ লাখ ৯৪২ টাকার অবৈধ সম্পদের অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে। সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগ আনা হয়েছে ৩ কোটি ৯৯ লাখ ৫৩ হাজার ২৭ টাকার । অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিচালক মঞ্জুর মোরশেদের নেতৃত্বে গঠিত দুই সদস্যের টিম তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ সালের ২৬(১) ও ২৭(২) ধারায় চার্জশিট দাখিলের অনুমতি চায়। টিমের অপর কর্মকর্তা হচ্ছেন দুদকের সহকারী পরিচালক এসএম রফিকুল ইসলাম। ১৩ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০১৪ সালের ২১ আগস্ট এমপি বদির বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। এ মামলায় বদি কারাভোগ করেন। বর্তমানে তিনি জামিনে রয়েছেন।