মানিকগঞ্জের খেতাবপ্রাপ্ত ৩ মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে বেঁচে আছেন মাত্র আতাহার আলী খান বীরপ্রতীক। বিজয়ের মাস এলেই খোঁজ পড়ে তার।
মানিকগঞ্জের খেতাবপ্রাপ্ত ৩ মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে বেঁচে আছেন মাত্র আতাহার আলী খান বীরপ্রতীক। বিজয়ের মাস এলেই খোঁজ পড়ে তার। সাংবাদিকরা আসেন, ছবি তোলেন, ঝলমলে পাঞ্জাবি পরে নেতাদেরও কেউ কেউ আসেন, কুশল জিজ্ঞেস করেন, আশ্বাস দেন, চলেও যান। তারপর সব আগের মতোই সাদামাটা। বাকি দিনগুলো কেমন করে কাটছে, কী খাচ্ছেন, সংসারই বা চলছে কী করে কেউ রাখে না এসবের খবর। এক নিঃশ্বাসে গভীর অভিমানে এসব অভিযোগই বেরিয়ে আসে এই যোদ্ধার। মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার বারাহির গ্রামে তার বাড়ি।
আতাহার আলী বীরপ্রতীক বলেন, ১৯৬৩ সালে বাবার সঙ্গে রাগ করে চট্টগ্রাম গিয়ে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসে যোগ দিই। চাকরির আট বছরের মাথায় এলো ১৯৭১। তখন টগবগে তরুণ আমি। বিন্দুমাত্র দ্বিধা করিনি, ভাবিনি পরিবার-পরিজনের কথা। সোজা যুদ্ধের ময়দানে। ভূরুঙ্গামারী কলেজে পাকসেনাদের একটি ক্যাম্পে প্রাণঘাতী হামলা চালিয়ে ২০ জনের মতো খানসেনা মেরে তাদের অস্ত্র ছিনিয়ে নেই। এরপর রায়গঞ্জে পাকসেনাদের হেড কোয়ার্টারে আক্রমণ চালাই। লে. সামাদসহ আমাদের ১২-১৩ জন সহযোদ্ধা শহীদ হলে আমরা পিছু হঠে আসি। আমাদের হাতে নিহত হয় শতাধিক পাকসেনা। এমনিভাবেই দীর্ঘ প্রায় ৯ মাস রংপুর, লালমনিরহাট, রায়গঞ্জ, ভূরুঙ্গামারীসহ বিভিন্ন জায়গায় অসংখ্য সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়েছি। দেশ স্বাধীন হলে যুদ্ধের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছি রাষ্ট্রীয় খেতাব বীর প্রতীক।
স্বাধীন দেশে আবার ফিরে যান আতাহার আলী খান বীরপ্রতীক। কিন্তু চরম অসম্মান নিয়ে ফিরে আসতে হয় তাকে। ১৯৮৫ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভালুকাপাড়ায় শান্তিবাহিনী আতাহার আলীদের ক্যাম্পে আক্রমণ চালিয়ে ৩ সৈনিককে হত্যা করে। আকস্মিক এ হামলা ঠেকানোর ব্যর্থতার দায়ে আতাহার আলীসহ ১০ বিডিআর সদস্যকে বরখাস্ত করা হয়। অথচ এ ব্যর্থতার দায় তার ছিল না। দায়িত্বে ছিল না কোনো গাফিলতি বলে জানান তিনি। এরপর মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রণালয়ে ঘুরেও চাকরি ফিরে পাননি এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। একবারও বিবেচনায় আনা হয়নি তার বীরপ্রতীক খেতাব প্রাপ্তির গৌরব। এসব স্মৃতিকথায় অশ্রুসিক্ত হন আতাহার আলী খান। প্রচ- মানসিক যন্ত্রণা হয় তার। চোখ গড়িয়ে নামে অশ্রু ধারা। সেই থেকে অভাব, অনাহার, ক্ষুধা তাঁর পরিবারকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।
‘ভেবেছিলাম চাকরি গেছে তো কী হয়েছে মুক্তিযোদ্ধার সম্মান নিয়েই বেঁচে থাকবো। জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে দেখলাম সে সম্মানটুকুও কেউ অন্তর দিয়ে দিতে চায় না। তাই বাধ্য হয়ে অভাব আর অবহেলায় দগ্ধ হয়েও মানিকগঞ্জের এই অজপাড়া গাঁয়ে বাপদাদার মাটি কামড়ে পড়ে আছি। বাড়িতে সাংবাদিক আর নেতাদের আনাগোনা দেখলে গ্রামের মানুষ টের পায় স্বাধীনতা দিবস অথবা বিজয় দিবস হয়তো কাছে। আতাহার আলীর দুঃখ, বেঁচে আছি নাকি মরে গেছি সে খবর সারা বছর কেউ রাখে না। না রাখুক কিচ্ছু এসে যায় না।’
আতাহার আলী সত্তরে পা রেখেছেন আরও আগেই, শরীরটা পড়ন্ত বেলায়। অসুখ-বিসুখ তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। তার মধ্যে সম্প্রতি তার স্ত্রী পরপারে চলে গেছেন। এখন অনেকটা একাকী জীবনযাপন করতে হচ্ছে এই বীরকে। একমাত্র ছেলের রোজগারেই তার বেঁচে থাকা। কিচ্ছু চাওয়ার নেই আতাহার আলীর; অভাবে নয়, কষ্ট বাড়ে শুধু অবহেলায়। এলাকাবাসীর আকাঙক্ষা এ বীরের নামে তাদের গ্রামের পাশে ধলেশ্বরী নদীতে যে ব্রিজটি হবে তা যেন বীরপ্রতীক আতাহার আলীর নামেই হয়- এটুকু সম্মান করতে কেউ যেন কার্পণ্য না করেন।