মধ্যরাত থেকে এ সরকার নির্বাচনী সরকার
বিশেষ প্রতিনিধি : আজ ২৬ অক্টোবর শনিবার রাত ১২টার পর থেকে সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকার নির্বাচনকালীন সরকারে রূপ নেবে। কিন্তু নির্বাচনকালীন সরকারের কোন রূপরেখা বা কাঠামো না থাকায় দলীয় সরকারের সঙ্গে এ সরকারের কোন পার্থক্য থাকছে না। আমাদের দেশে অতীতে নির্বাচনকালীন সরকারের কোন কার্যক্রম না থাকায় রেওয়াজ অনুসারে নীতিও গড়ে উঠেনি।
২০০৯ সালের ২৫ জানুয়ারি নবম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন বসেছিল। সংবিধানের ১৭২ (৩) অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে, “রাষ্ট্রপতি পূর্বে ভাঙ্গিয়া না দিয়া থাকিলে প্রথম বৈঠকের তারিখ হইতে পাঁচ বত্সর অতিবাহিত হইলে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবে।” সেই হিসাবে আগামী ২৪ জানুয়ারি বর্তমান সংসদের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। সংবিধানের ১২৩ (৩) অনুচ্ছেদের (ক) উপ-অনুচ্ছেদেউল্লেখ রয়েছে, সংসদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাঙ্গিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে। সেই হিসাবে ৯০ দিনের গণনা শুরু হচ্ছে আজ ২৬ অক্টোবর রাত ১২টা ১ মিনিট থেকে।
যদিও রাজনৈতিক দলের নেতারা বিশেষ করে বিরোধী দল এই অংক যোগে ভুল করছে। তারা ২৫ অক্টোবর থেকে সরকারের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে বলে দাবি করছে। যদিও প্রথমে তারা দাবি করেছিলো ২৪ অক্টোবর বর্তমান সংসদের মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। এই বিভ্রান্তিটি তৈরি হয়েছিল সংসদের কার্য উপদেষ্টা কমিটির একটি সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে। ইতিপূর্বে কার্য উপদেষ্টা কমিটি সংসদের অধিবেশন ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু সরকারি দল বর্তমানে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে। এখন কার্য উপদেষ্টা কমিটি আগামী ৭ নভেম্বর পর্যন্ত সংসদ অধিবেশন চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সংবিধান বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সরকারি দল চাইলে সংসদের শেষ দিন পর্যন্ত এমনকি নির্বাচনের দিনও সংসদের অধিবেশন চালাতে পারে। এতে সংবিধানের কোন বিধান লংঘিত হবে না। তবে তা সংবিধানের একটি অনুচ্ছেদের চেতনাকে লংঘন করে। সংবিধানের ৭২ (১) অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে, ১২৩ অনুচ্ছেদের (৩) দফার (ক) উপ-দফায় উল্লেখিত ৯০ দিন সময় ব্যতীত (ওই অনুচ্ছেদে সংসদের মেয়াদ শেষের ৯০ দিন পূর্বে নির্বাচনের নির্দেশনা রয়েছে) অন্য সময়ে সংসদের এক অধিবেশনের সমাপ্তি ও পরবর্তী অধিবেশনের প্রথম বৈঠকের মধ্যে ষাট দিনের অতিরিক্ত বিরতি থাকবে না।
এই বিধানটি করা হয়েছিল নির্বাচনকালীন ৯০ দিনের মধ্যে যাতে সংসদের অধিবেশন না বসে। কিন্তু এই অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্যের ব্যত্যয় ঘটিয়ে সংসদের অধিবেশন ৭ নভেম্বর পর্যন্ত অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। যদিও পঞ্চদশ সংশোধনী বিল পাসের সময় প্রধানমন্ত্রী ও সংশোধন কমিটির কো-চেয়ারম্যান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, নির্বাচনকালীন ৯০ দিনে সংসদের অধিবেশন বসবে না। প্রধানমন্ত্রী আরো বলেছিলেন, নির্বাচনকালে সরকার নীতি নির্ধারণী কোন কাজ করবে না। শুধু রুটিন ওয়ার্ক করবে।
সংবিধান অনুযায়ী ২৬ অক্টোবর রাত ১২টার পর থেকে এই সরকার নির্বাচনকালীন সরকারে রূপ নেয়ার কথা। কিন্তু নির্বাচনকালীন সরকারের কোন কাঠামো না থাকায় দলীয় সরকারের সঙ্গে ওই সরকারের কোন পার্থক্য থাকছে না। ব্রিটেন ও ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে দীর্ঘদিন ধরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। ফলে ওই দেশগুলোতে অন্তর্বর্তীকালীন বা নির্বাচনকালীন সরকারের কার্যক্রমের কিছু রীতি-নীতি গড়ে উঠেছে।
ভারতে নির্বাচনকালীন সরকার যাতে নির্বাচনের ওপর দলীয় প্রভাব বিস্তার করতে না পারে সে লক্ষ্যে আইন ও বিধিমালা রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কার্যক্রম সম্পর্কে বক্তৃতা-বিবৃতিতে অনেক কথা বলা হলেও এর কোন কাঠামো তৈরি করা হয়নি। বরং আমাদের সংবিধানের ৫৫ (২) অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে, প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক বা তাহার কর্তৃত্বে এই সংবিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা প্রযুক্ত হইবে। অর্থাত্ প্রধানমন্ত্রীর যেরূপ ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব ছিল সেরূপ ক্ষমতাই নির্বাচনকালের ৯০ দিনেও প্রধানমন্ত্রী প্রয়োগ করতে পারবেন।
ত্রয়োদশ সংশোধনীর ৫৮ (ঘ) অনুচ্ছেদে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারে একটি অন্তর্বর্তী সরকার হিসাবে কাজ করার নির্দেশনা ছিল। তাতে উল্লেখ ছিল, উক্তরূপ সরকার দৈনন্দিন কার্যাবলী সম্পাদন করবেন এবং ওইরূপ কার্যাবলী সম্পাদনের প্রয়োজন ব্যতীত কোন নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন না। কিন্তু বর্তমান সরকারের ক্ষেত্রে সেই সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা নেই। এমনকি সরকারের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে কোন আইনগত কাঠামোও তৈরি করা হয়নি।
সংবিধানে সংসদের মেয়াদ শেষের ৯০ দিন পূর্বের সময়কে নির্বাচনকালীন সময় বলে অভিহিত করেছে। কিন্তু এই আলোকে কোন আইন ও বিধিমালা তৈরি হয়নি। নির্বাচন কমিশন প্রণীত রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা-২০০৮ এ সংসদ ভেঙ্গে যাওয়ার পর হতে পরবর্তী সংসদ নির্বাচনের ফলাফল সরকারি গেজেটে প্রকাশের তারিখ পর্যন্ত সময়কে নির্বাচনের পূর্ব সময় বলে অভিহিত করা হয়েছে। এই বিধানটি প্রণীত হয়েছিল যখন নির্বাচন হতো সংসদ বিলোপ হবার পর। কিন্তু পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদ বিলুপ্তের ৯০ দিন পূর্বে নির্বাচন আয়োজনের বিধান সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হলেও নির্বাচন কমিশন তার এ সংক্রান্ত বিধিমালা এখনো সংশোধন করেনি। গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ ১৯৭২ এর অধিকতর সংশোধন বিল দীর্ঘদিন ধরে সংসদে ঝুলে আছে।