ভোট বর্জন স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে জনগণের নিরব বিপ্লব : খালেদা জিয়া
স্বৈরশাসনকে দীর্ঘায়িত করার বিপক্ষে অতীত ঐতিহ্যের ধারায় জনগণ আরেকবার নীরব বিপ্লব ঘটিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন ও বিরোধী দলের নেতা বেগম খালেদা জিয়া।
সোমবার রাতে সংবাদমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এ কথা বলেন তিনি।
বিবৃতিতে বেগম খালেদা জিয়া বলেন, দেশের এবং সারা দুনিয়ার মানুষ নিজের চোখে সরাসরি ও মিডিয়ার মাধ্যমে দেখেছেন এবং জেনেছেন যে, কিভাবে ভোটারেরা এই কারসাজির ঘৃণ্য প্রহসনকে বর্জন করেছেন। সারাদিন সারাদেশের ভোটকেন্দ্রগুলো ছিল ফাঁকা। ভোটারবর্জিত এ একতরফা কারসাজিকে জনগণ ঘৃণাভরে পুরোপুরি বর্জন করেছেন। গণতন্ত্র হত্যার এ যজ্ঞে তারা সায় দেননি। প্রত্যাখ্যান করেছেন আওয়ামী লীগের এই নির্লজ্জ মহড়াকে।
এজন্য দেশবাসীকে অভিনন্দন জানিয়ে তিনি বলেন, অভিনন্দন বাংলাদেশের গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষকে। আমি অন্তরের অন্তস্থল থেকে ধন্যবাদ জানাই বাংলাদেশের সচেতন নাগরিকবৃন্দ ও ভোটারদের। তারা ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের নামে কলংকময় প্রহসনকে বর্জন করেছেন।
তিনি বলেন, ভোটারশূন্য এ নির্বাচনী প্রহসনের মাধ্যমে সবার সামনে হাতে-কলমে প্রমাণিত হয়েছে যে, সরকারের প্রতি মানুষের ঘৃণা ও অনাস্থা কত তীব্র। এর মাধ্যমে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, তাদের মুষ্টিমেয় দোসর ও আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশনের গণবিরোধী কুকর্মও দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে গেছে।
সবখানে সারাদিন ভোটকেন্দ্রগুলো শূন্য পড়েছিল। কেউ ভোট দিতে আসেনি। বহু ভোটকেন্দ্রে একটি ভোটও পড়েনি। কোথাও কোথাও দু’চারটা করে ভোট পড়লেও এর মধ্যে বেশিরভাগই ছিল জাল। অথচ ভোটগ্রহণের শেষ পর্যায়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের নির্বাচন কমিশন অভিমুখে ছুটাছুটি ও তৎপরতার পর রাতে লাখ লাখ এবং হাজার হাজার ভোট পড়েছে বলে দেখানো হয়। এতে পুরো প্রহসনটির সামান্যতম বিশ্বাসযোগ্যতাও আর অবশিষ্ট থাকেনি বলে মন্তব্য করেন বিএনপি চেয়ারপারসন।
তিনি বলেন, গায়ের জোর, সন্ত্রাস ও রাষ্ট্রশক্তির নিষ্ঠুর অপব্যবহার করে এ প্রহসনের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণকে পরাজিত এবং গণতন্ত্র ও মানুষের অধিকারকে কেড়ে নিয়ে আওয়ামী লীগ তাদের শাসনক্ষমতা প্রলম্বিত করতে চাইছে। কতটা নির্লজ্জ হলে তারা এরপরেও বলতে পারে যে, জনগণ স্বতঃস্ফুর্তভাবে ভোট দিয়েছে এবং তারা দেশ পরিচালনায় জনগণের ম্যান্ডেট পেয়ে গেছে।
তিনি বলেন, মানুষের কোনো ভোট বা সম্মতি ছাড়াই আগেই জাতীয় সংসদের ১৫৩টি আসন আওয়ামী লীগ ভাগ-বাটোয়ারা করে সিলেকশন করেছে। বাকি ১৪৭ আসনেও ভোটারদের সমর্থন দূরে থাক, তারা ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের হাজিরই করতে পারেনি। বাংলাদেশের সচেতন জনগণ তাদের এ কারসাজির একতরফা অপপ্রয়াসকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছে। কাজেই এ সরকারের ক্ষমতায় টিকে থাকার আর কোনো নৈতিক ও সাংবিধানিক ভিত্তি নেই। জনগণের অনুমোদন ছাড়া দেশ পরিচালনার এখতিয়ার কারো থাকে না।
খালেদা জিয়া বলেন, ৫ জানুয়ারির কলংকময় প্রহসনের মাধ্যমে সরকারের প্রতি জনগণের অনাস্থাই কেবল নয়, আরো প্রমাণ হয়েছে যে, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ও গ্রহনযোগ্য নির্বাচন কমিশন ছাড়া বাংলাদেশে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ এবং সকলের অংশগ্রহনমূলক নির্বাচন সম্ভব নয়। কাজেই আমি অবিলম্বে নির্বাচনের নামে এই প্রহসন বাতিল, সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় নিরপেক্ষ একটি সরকারের অধীনে সকলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সমঝোতায় পৌঁছার জন্য আহবান জানাচ্ছি।
তিনি বলেন, আমি আবারো বলতে চাই, আমাকে কার্যত গৃহবন্দী ও জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন রেখে, বিরোধী দল ও জনগণের ওপর দমন-পীড়ন চালিয়ে সমস্যা ও সংকটের কোনো সুরাহা হবে না। সন্ত্রাসের পথে অবৈধ ক্ষমতাকে প্রলম্বিত করার অপচেষ্টাতেও শেষ রক্ষা হবে না। বরং তাতে সংকট আরো জটিল ও গভীর এবং সমাধানের অযোগ্য হয়ে পড়বে।
তিনি বলেন, কারসাজি ও প্রহসনের মাধ্যমে অবৈধ ক্ষমতাকে প্রলম্বিত করার ঘৃণ্য অপচেষ্টাকে প্রতিরোধ করতে গিয়ে নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ ও বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা আজ অকাতরে প্রাণ দিচ্ছেন। তাদের এ আত্মদান বৃথা যাবে না। ব্যক্তি বিশেষের ক্ষমতার উৎকট বাসনা আজ যেভাবে রক্ত ঝরাচ্ছে, যেভাবে মানুষ নিজের দেশের সরকারের হাতেই সীমাহীন উৎপীড়িত হচ্ছে, এটা বেশিদিন চলতে পারে না। জনগণের এ আন্দোলন বিজয় অর্জন না হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত আছে এবং থাকবে। কেন্দ্র থেকে যখন যে কর্মসূচি ঘোষণা হবে তা পালন এবং স্থানীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে ও সমন্বয় করে আন্দোলন চালিয়ে যাবার জন্য আমি সকলের প্রতি আহবান জানাচ্ছি।
নির্বাচনী প্রহসনে আওয়ামী লীগেরও বিপুলসংখ্যক লোক শরিক না হওয়ায় আমি তাদেরকেও ধন্যবাদ জানাই। আশা করি তারাও জনগণের অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে তাদের সঙ্গেই একাত্ম থাকবেন।
তিনি বলেন, প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আমি আবারো আহবান জানাই, বেআইনী কার্যকলাপ ও হত্যা-নির্যাতন থেকে বিরত থাকুন। সুস্থ, স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে কাজ করুন। জনগণের সঙ্গে থাকুন। ধর্মীয় সংখ্যালঘুসহ দুর্বল জনগোষ্ঠীসমূহসহ সব নাগরিকের জীবন, সম্পদ ও সম্ভ্রমের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন।
খালেদা জিয়া বলেন, এ প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে গণতান্ত্রিক বিশ্বের প্রতি আমার কিছু বলার আছে। আজ বাংলাদেশে জনগণের সকল অধিকার ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে বিধ্বস্ত। উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক রাজনীতি ও নিয়মতান্ত্রিক কার্যক্রম স্তব্ধ। সংবাদ-মাধ্যম শৃংখলিত। আগেরবারের আওয়ামী শাসনামলে সৃষ্ট যে জঙ্গীবাদকে আমরা ধর্মপ্রাণ মানুষের সহযোগিতা নিয়ে কঠোর হাতে দমন করতে পেরেছিলাম, আজ আবারো স্বৈরশাসনের কারণে তা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার অবকাশ সৃষ্টি হয়েছে। এই স্বৈরব্যবস্থা কেবল বাংলাদেশে নয়, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার স্বস্তি ও স্থিতিকে হুমকির দিকে ঠেলে দিতে পারে। তাই অবিলম্বে বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুণ:প্রতিষ্ঠা এবং গণতান্ত্রিক রীতিনীতির অবাধ অনুশীলণের পক্ষে বিশ্ববিবেককেও আরো বেশি সোচ্চার ও সক্রিয় হতে হবে।
তিনি বলেন, সংবাদ মাধ্যম ৫ জানুয়ারি সারাদিন নির্বাচনী প্রহসনের চিত্র যেভাবে তুলে ধরেছে তার জন্য আমি তাদেরকে ধন্যবাদ জানাই। তবে রাতে চাপের মুখে তাদের স্বাধীনতা যেভাবে হরণ করা হয়েছে, তার জন্য জানাই সহানুভূতি।
তিনি বলেন, আমি সারাদেশের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ থেকে সকল মিথ্যাচার ও কারসাজিকে মোকাবিলা করে তাদের হৃত অধিকার ফিরিয়ে আনার সংগ্রামে অটল থাকার আহবান জানাচ্ছি। অবৈধ সরকার দীর্ঘায়িত হবে না ইনশাআল্লাহ।