ভুট্টার উৎপাদন প্রযুক্তিঃ
ভুট্টার উৎপাদন প্রযুক্তিঃ
মাটি
বেলে দোআঁশ ও দোআঁশ মাটি ভুট্টা চাষের জন্য উপযোগী। লক্ষ্য রাখতে হবে যেন জমিতে পানি জমে না থাকে।
বপনের সময়
বাংলাদেশে রবি মৌসুমে মধ্য-আশ্বিন থেকে মধ্য-অগ্রহায়ণ (অক্টোবর-নভেম্বর) এবং খরিফ মৌসুমে ফাল্গুন থেকে মধ্য-চৈত্র (মধ্য-ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ) পর্যন্ত সময় বীজ বপনের উপযুক্ত সময়।
বীজের হার ও বপনপদ্ধতি
শুভ্রা, বর্ণালী ও মোহর জাতের ভুট্টার জন্য হেক্টর প্রতি ২৫-৩০ কেজি এবং খইভুট্টা জাতের ১৫-২০ কেজি হারে বীজ বুনতে হবে। সারি থেকে সারির দূরত্ব হবে ৭৫ সেমি। সারিতে ২৫ সেমি দূরত্বে ১টি অথবা ৫০ সেমি দূরত্বে ২টি গাছ রাখতে হবে।
সারের পরিমান
ভুট্টা চাষে বিভিন্ন প্রকার সারের পরিমান নীচে দেয়া হল-
সারের নাম | সারের পরিমান/ হেক্টর | ||
কম্পোজিট | হাইব্রিড | ||
রবি | খরিফ | রবি | |
ইউরিয়া | ১৭২-৩১২ কেজি | ২১৬-২৬৪ কেজি | ৫০০-৫৫০ কেজি |
টিএসপি | ১৬৮-২১৬ কেজি | ১৩২-২১৬ কেজি | ২৪০-২৬০কেজি |
এমওপি | ৯৬-১৪৪ কেজি | ৭২-১২০ কেজি | ১৮০-২২০ কেজি |
জিপসাম | ১৪৪-১৬৮কেজি | ৯৬-১৪৪ কেজি | ২৪০-২৬০ কেজি |
জিংক সালফেট | ১০.১৫কেজি | ৭-১২কেজি | ১০-১৫কেজি |
বরিক এসিড | ৫-৭কেজি | ৫-৭কেজি | ৫-৭কেজি |
গোবর | ৪-৬ টন | ৪-৬ টন | ৪-৬ টন |
সারপ্রয়োগপদ্ধতি
জমি তৈরীর শেষ পর্যায়ে অনুমোদিত ইউরিয়ার এক তৃতীয়াংশ এবং অন্যান্য সারের সবটুকু ছিটিয়ে জমি চাষ দিতে হবে। বাকী ইউরিয়া সমান ২ কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে। প্রথম কিস্তি বীজ গজানোর ২৫-৩০ দিন পর এবং দ্বিতীয় কিস্তি বীজ গজানোর ৪০-৫০ দিন পর উপরি প্রয়োগ করতে হবে। চারা গজানোর ৩০ দিনের মধ্যে জমি থেকে অতিরিক্ত চারা তুলে ফেলতে হবে। চারার বয়স এক মাস না হওয়া পর্যন্ত জমি আগাছামুক্ত রাখতে হবে।
সেচপ্রয়োগ
উচ্চফলনশীল জাতের ভুট্টার আশানুরূপ ফলন পেতে হলে রবি মৌসুমে সেচ প্রয়োগ অত্যাবশ্যক। উদ্ভাবিত জাতে নিম্নরূপ ৩-৪টি সেচ দেয়া যায়।
প্রথম সেচ: বীজ বপনের ১৫-২০ দিনের মধ্যে (৪-৬ পাতা পর্যায়)
দ্বিতীয় সেচ:বীজ বপনের ৩০-৩৫ দিনের মধ্যে (৮-১২পাতা পর্যায়)
তৃতীয় সেচ:বীজ বপনের ৬০-৭০ দিনের মধ্যে (মোচা বের হওয়া পর্যায়)
দ্বিতীয় সেচ:বীজ বপনের ৮৫-৯৫ দিনের মধ্যে (দানা বাঁধার পূর্ব পর্যায়)
ভুট্টার ফুল ফোটা ও দানা বাঁধার সময় কোন ক্রমেই জমিতে যাতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
ভুট্টাসংগ্রহ
দানার জন্য ভুট্টা সংগ্রহের ক্ষেত্রে মোচা চকচকে খড়ের রং ধারণ করলে এবং পাতা কিছুটা হলদে হলে সংগ্রহের উপযুক্ত হয়। এ অবস্থায় মোচা থেকে ছাড়ানো বীজের গোড়ায় কালো দাগ দেখা যাবে। ভুট্টা গাছের মোচা ৭৫-৮০% পরিপক্ব হলে ভুট্টা সংগ্রহ করা যাবে। বীজ হিসেবে মোচার মাঝামাঝি অংশ থেকে বড় ও পুষ্ট দানা সংগ্রহ করতে হবে।
অন্যান্য পরিচর্যা
ভুট্টার বীজ পচা এবং চারা গাছের রোগ দমন:
বীজ পচা এবং চারা নষ্ট হওয়ার কারণে সাধারণত ক্ষেতে ভুট্টা গাছের সংখ্যা কমে যায়। নানা প্রকার বীজ ও মাটিবাহিত ছত্রাক যেমন পিথিয়াম, রাইজকটনিয়া, ফিউজেরিয়াম, পেনিসিলিয়াম ইত্যাদি বীজ বপন , চারা ঝলসানো, গোড়া ও শিকড় পচা রোগ ঘটিয়ে থাকে। জমিতে রসের পরিমান বেশী হলে এবং মাটির তাপমাত্রা কম থাকলে বপনকৃত বীজের চারা বড় হতে অনেক সময় লাগে। ফলে এ সময় ছত্রাকের আক্রমণের মাত্রা বেড়ে যায়।
প্রতিকার
১। সুস্থ , সবল ও ক্ষতমুক্ত বীজ এবং ভুট্টার বীজ পচা প্রতিরোধী বর্ণালী ও মোহর জাত ব্যবহার করতে হবে।
২। উত্তমরুপে জমি তৈরী করে পরিমিত রস ও তাপমাত্রায় ( ১৩●সে. এর বেশী ) বপন করতে হবে।
২। থিরাম বা ভিটাভেক্স ( ০.২৫% ) প্রতি কেজি বীজে ২.৫-৩.০ গ্রাম হারে মিশিয়ে বীজ শোধন করলে ভুট্টার বীজ পচা রোগের আক্রমণ অনেক কমে যায়।
ভুট্টার পাতা ঝলসানো রোগ দমন
হেলমিনথোসপোরিয়াম টারসিকাম ও হেলমিনথোসপোরিয়াম মেইডিস নামক ছত্রাকদ্বয় এ রোগ সৃষ্টি করে। প্রথম ছত্রাকটি দ্বারা আমাদের দেশে ভুট্টার পাতা ঝলসানো রোগ বেশী হতে দেখা যায়। হেলমিনথোসপোরিয়াম টারসিকাম দ্বারা আক্রান্ত গাছের নীচের দিকের পাতায় লম্বাটে ধুসর বর্ণের দাগ দেখা যায়। পরবর্তীতে গাছের উপরের অংশে তা বিস্তার লাভ করে। রোগের প্রকোপ বেশী হলে পাতা আগাম শুকিয়ে যায় এবং গাছ মরে যায়। এ রোগের জীবাণু গাছের আক্রান্ত অংশে অনেকদিন বেঁচে থাকে। জীবাণুর বীজকণা বা কনিডিয়া বাতাসের সাহায্যে অনেক দূর পর্যন্ত সুস্থ গাছে ছড়াতে পারে। বাতাসের আর্দ্রতা বেশী হলে এবং ১৮-২৭ ডিগ্রী সে. তাপমাত্রায় এ রোগের আক্রমণ বেড়ে যায়।
প্রতিকার
১। রোগ প্রতিরোধী জাতের (মোহর) চাষ করতে হবে।
২। আক্রান্ত ফসলে টিল্ট ২৫০ ইসি (০.০৪%) ১৫ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
৩। ভুট্টা উঠানোর পর জমি থেকে আক্রান্ত গাছ সরিয়ে অথবা পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
ভুট্টার মোচা ও দানা পচা রোগ দমন:
মোচা ও দানা পচা রোগ ভুট্টার ফলন , বীজের গুণাগুণ ও খাদ্যমান কমিয়ে দেয়। বিভিন্ন প্রকার ছত্রাক যথা ডিপ্লোডিয়া মেডিস, ফিউজেরিয়াম মনিলিফরমি প্রভৃতি এ রোগ ঘটায়।
আক্রান্ত মোচার খোসা ও দানা বিবর্ণ হয়ে যায়। দানা পুষ্ট হয়না, কুঁচকে অথবা ফেটে যায়। অনেক সময় মোচাতে বিভিন্ন দানার মাঝে বা উপরে ছত্রাকের উপস্থিতি খালি চোখেই দেখা যায়। ভুট্টা গাছে মোচা আসা থেকে পাকা পর্যন্ত বৃষ্টিপাত বেশি থাকলে এ রোগের আক্রমণ বাড়ে। পোকা বা পাখির আক্রমণে বা কান্ড পচা রোগে গাছ মাটিতে পড়ে গেলে এ রোগ ব্যাপকতা লাভ করে। রোগের জীবাণু বীজ অথবা আক্রান্ত গাছের পরিত্যাক্ত অংশে বেঁচে থাকে। একই জমিতে বার বার ভুট্টার চাষ করলে এ রোগ দ্রুত বিস্তার লাভ করে।
প্রতিকার
১। এ রোগের প্রাদুর্ভাব এড়াতে একই জমিতে বার বার ভুট্টার চাষ করা ঠিক নয়।
২। জমিতে পোকা ও পাখির আক্রমণ রোধ করতে হবে।
৩। ভুট্টা পেকে গেলে তাড়াতাড়ি কেটে ফেলতে হবে।
৪। কাটার পর ভুট্টার পরিত্যাক্ত অংশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
ভুট্টার কান্ড পচা রোগ দমন
বিভিন্ন প্রজাতির ছত্রাক যথা ডিপ্লোডিয়া মেডিস, ফিউজেরিয়াম মনিলিফরমি-এর কারণে এ রোগ ঘটে থাকে। প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে গাছের কান্ড পচে যায় এবং গাছ মাটিতে ভেংগে পড়ে। আমাদের দেশে খরিফ মৌসুমে এ রোগটি বেশী হয়ে থাকে। জমিতে নাইট্রোজেনের পরিমাণ বেশী এবং পটাশের পরিমাণ কম হলে ছত্রাকজনিত কান্ড পচা রোগ বেশী হয়।
প্রতিকার
১। ছত্রাকনাশক ভিটাভেক্স-২০০ দিয়ে বীজ শোধন করে লাগাতে হবে।
২। সুষম হারে সার ব্যবহার করতে হবে, বিশেষ করে নাইট্রোজেন ও পটাশ পরিমিত মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে।
৩। ভুট্টা কাটার পর পরিত্যাক্ত অংশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
৪। শিকড় ও কান্ড আক্রমণকারীপপো-মাকড় দমন করতে হবে।
৫।আক্রান্ত জমিতে অনুমোদিত ছত্রাকনাশক ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
Source: Krishi Projukti Hatboi(Handbook on Agro-technology), 4th edition, Bangladesh Agricultural Research Institute, Gazipur-1701, Bangladesh.