ব্যবসা-বাণিজ্য জোরদারে অর্থনৈতিক কূটনীতির প্রতি প্রধানমন্ত্রীর গুরুত্বারোপ
ব্যবসা-বাণিজ্য জোরদারে অর্থনৈতিক কূটনীতির প্রতি প্রধানমন্ত্রীর গুরুত্বারোপ
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য জোরদারে কূটনীতিকদের রাজনীতির পাশাপাশি অর্থনৈতিক কূটনীতি অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘কূটনৈতিক মিশনগুলোর দায়িত্ব আজকের বিশ্বে পরিবর্তিত হয়েছে। এখন রাজনীতির পাশাপাশি অর্থনৈতিক কূটনীতি সামনে উঠে এসেছে। আমাদের এমনভাবে কূটনীতি অবলম্বন করতে হবে যাতে আমরা দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য জোরদার করতে পারি এবং বিশ্বের সকলের সঙ্গে একত্র হয়ে অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জন করতে পারি।’ একইসঙ্গে তিনি বিশ্বে শান্তি বজায় রাখতে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম বাংলায় ভাষণদানের ৪৬তম বার্ষিকী উপলক্ষে স্মরণ সভায় প্রধান অতিথির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শুক্রবার এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী একই সঙ্গে ফরেন সার্ভিস একাডেমি ভবন এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রকাশিত ‘বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা এন্ড দ্য ইউনাইটেড ন্যাশনস : বাংলাদেশ এট দ্য ওয়াল্ড স্টেজ’ এবং ‘বঙ্গবন্ধু, দ্য পিপলস হিরো’ এই দুইটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন। প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে এই বৈঠকে যোগ দেন। অন্যদিকে সুগন্ধা চত্বরে ফরেন সার্ভিস একাডেমি থেকে কূটনৈতিক কোরের প্রধানসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতগণ যোগ দেন।
বিশ্বে সকলেই একে অপরের ওপর নির্ভরশীল কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা সবার কাছ থেকে সহায়তা আশা করি। তেমনিভাবে কোনো দেশের যদি আমাদের সাহায্যের প্রয়োজন হয়, আমরা তা দিতে প্রস্তুত।’
কোভিড-১৯ মহামারি প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি আশা করি, বিশ্ব করোনা ভাইরাস মহামারি থেকে মুক্তি পাবে এবং অর্থনীতির চাকা আবার ঘুরতে শুরু করবে এবং এভাবে সবাই তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবে এবং এজন্যই গোটা বিশ্বকে একত্রে কাজ করতে হবে।’
অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন মূল বক্তব্য পাঠ করেন। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম, বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক মিয়া সেপ্পো এবং পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানে ফরেন সার্ভিস একাডেমির রেক্টর রাষ্ট্রদূত সৈয়দ মাসুদ মাহমুদ খন্দকার নবনির্মিত ভবন সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরেন।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম বাংলায় ভাষণ এবং সুগন্ধায় বঙ্গবন্ধুর প্রথম কার্যালয়ের দুটি অডিও-ভিজুয়াল প্রজেন্টেশন প্রদর্শিত হয়। এতে বাংলাদেশ সরকারের প্রথম দিকের চিত্র তুলে ধরা হয়।
বঙ্গবন্ধু হলেন প্রথম বাঙালি যিনি ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ইউএনজিএ’তে প্রথম বাংলায় ভাষণ দেন।
প্রধানমন্ত্রী বর্তমান বিশ্বকে একটি ‘গ্লোবাল ভিলেজ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং বলেন, ‘উন্নয়নের জন্য সকলের সহযোগিতা সমানভাবে দরকার।’
সরকার প্রধান ভাষণে ২০১৩, ১৪ ও ১৫ সালে বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলনের নামে মানুষ হত্যার প্রসঙ্গ টেনে দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে তাদের অসহযোগিতারও ইঙ্গিত দেন।
তিনি বলেন, ‘ভৌগলিক অবস্থানের কারণে আমাদের বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন প্রতিনিয়ত মোকাবেলা করতে হয় তেমনি মাঝে মাঝে মনুষ্য সৃষ্ট দুর্যোগও আসে।’
‘১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট যে ঘাতকেরা জাতির পিতাকে হত্যা করেছিল, তার দোসর যারা, তারা এদেশে কোনো স্থিতিশীল সরকার থাকুক তা কখনোই চায়নি,’যোগ করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, ‘এই অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির প্রচেষ্টা যখন চালানো হয় তখন আমরা দেখেছি মানুষকে খুন করা বা পুড়িয়ে হত্যার মত ঘটনা।’
আওয়ামী লীগ সরকার সকল ধরনের ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে একাধিক বার দেশ পরিচালনায় দায়িত্ব পাওয়ার এবং দেশকে বর্তমান পর্যায়ে তুলে আনতে পারার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমরা এটা পেরেছি একটাই কারণে যেহেতু জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস আমরা অর্জন করতে পেরেছি। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ওপর এদেশের মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস রয়েছে বলেই বার বার আমাদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করায় আমরা সরকার গঠন করে তাদের সেবা করতে পেরেছি। আজকে উন্নয়নগুলোও যেমন দৃশ্যমান হচ্ছে এবং এর সুফলও ভোগ করছে দেশের জনগণ।’
জাতির পিতার অসম্পন্ন কাজ সম্পন্ন করাই তার একমাত্র লক্ষ্য উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের মধ্যদিয়ে জাতির পিতা এদেশের মানুষকে যে মর্যাদার আসনে বসিয়েছিলেন, তাকে হত্যা করার মধ্যদিয়ে তা ভূলুণ্ঠিত হয়।
’৭৫ পরবর্তী প্রবাস জীবনে থাকতে বাধ্য হওয়া এবং আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর জোর করে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের কথা স্মরণ করে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘তখন দেশে কোনো গণতন্ত্র ছিল না, মানুষের অধিকার ছিল না, মুখে গণতন্ত্র ছিল। এদেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হয়েছে। সেই ভাগ্য পরিবর্তন করাই আমার লক্ষ্য ছিল। সেই লক্ষ্যেই আজো আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’
কোভিড-১৯ মহামারি থেকে বিশ্বের মানুষের মুক্তি কামনা করে শেখ হাসিনা ভাষণে এজন্য বিশ্ববাসীকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করারও আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, ‘আবারও অর্থনীতির চাকা সচল হোক, সকল মানুষ সুন্দরভাবে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারুক, সেটাই আমরা চাই। সেজন্য সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। সারাবিশ্বকে এক হয়ে কাজ করতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী এ সময় করোনা ভাইরাস পরিস্থিতিতে সম্ভাব্য খাদ্য সংকটের বিষয়ে তার সরকারের আগাম সতর্কতার বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরে বলেন, ‘করোনা ভাইরাসের কারণে বিশ্বে হয়ত দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে যেন কোনোমতে সেই দুর্ভিক্ষের ছোঁয়া না লাগে। তাই, আমরা যতটুকু পারি খাদ্য উৎপাদন করা, খাদ্য বিতরণ করা, দরিদ্র মানুষকে বিনা পয়সায় খাদ্য দেওয়া এবং খাদ্য নিশ্চয়তা দেবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’
দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ৩১ দফা নির্দেশনার মাধ্যমে সীমিত আকারে অব্যাহত রাখার কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কোভিডের কারণে আমাদের জিডিপির যেটা টার্গেট ছিল সেটা আমাদের পক্ষে অর্জন সম্ভব হয়নি। এবার ৫ দশমিক ২৪ শতাংশের মত জিডিপি অর্জন করতে পেরেছি। কিন্তু আমরা আশা করি আগামীতে আমাদের প্রবৃদ্ধি আমরা আরো বেশি অর্জন করতে সক্ষম হব এবং সেদিকে লক্ষ্য রেখেই কাজ করে যাচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘প্রায় ৪০ শতাংশ থেকে দারিদ্রের হার কমিয়ে ২০ দশমিক ৫ শতাংশে এনেছি। আমরা এটা আরো কমাতে চাই। বাংলাদেশের প্রত্যেকটা মানুষকে একটা সুন্দর জীবন আমরা উপহার দিতে চাই।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, প্রতিটি মানুষকে, যারা গৃহহীন, তাদের গৃহ নির্মাণ করে দেব। যারা ভূমিহীন, তাদের ভূমির ব্যবস্থা করে দেব। মুজিববর্ষে কেউ গৃহহীন থাকবে না।
তিনি বলেন, আমরা খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পেরেছি। পুষ্টির নিশ্চয়তার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছি। করোনা ভাইরাস মোকাবেলা করার জন্য আমরা বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়েছি। পাশাপাশি, বিশেষ প্রণোদনা দিয়েছি। সব মানুষ যাতে এই প্রণোদনার সহযোগিতাটা পায়, সে ব্যবস্থাও আমরা করে দিয়েছি।
শেখ হাসিনা বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটে দেশের পররাষ্ট্রনীতির প্রসঙ্গ টেনে দুর্যোগ মোকাবেলায় যৌথ উদ্যোগের ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, ‘সকলের সহযোগিতা যেমন আমাদের একান্ত কাম্য তেমনি কাউকে কোন ধরণের সহযোগিতা করার প্রয়োজন হলে আমরা সেটা করতেও প্রস্তুত। কারণ, বাংলাদেশ সবসময় চায় সমগ্র বিশ্বে শান্তি বজায় থাকুক।’
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অংশ নিয়ে বিশ্বের সংঘাতপূর্ণ এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী এবং পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা প্রত্যেকেই বিশেষ ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন বলে উল্লেখ করে তিনি এ সময় বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় আত্মাহুতি দানকারী বাংলাদেশি সৈনিকদের রুহের মাগফেরাত ও কামনা করেন।
এ সময় প্রতিবছর তিনি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে অংশগ্রহণের জন্য নিউইয়র্কে থাকলেও এ বছর করোনার জন্য যেতে না পারায় এবং বিশ্ব নেতৃবৃন্দের মিলন মেলায় অংশগ্রহণ করতে না পারার আক্ষেপ ব্যক্ত করেন।
তিনি বলেন, ‘আমি ১৬ বার জাতিসংঘে গিয়ে ভাষণ দিয়েছি কিন্তু ১৭ তম ভাষণ দেওয়ার সময় যেতে পারছি না, যেটা খুব দুঃখের। কারণ, সেখানে বিশ্বের সবদেশের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং মতবিনিময়ের সুযোগ হয়। একে অপরের অভিজ্ঞতা জানা এবং বিনিময়ের যে সুযোগ সেটা এবার করোনাভাইরাসের কারণে হলো না।’ বাসস