ব্যবসায়ীরা বাকরুদ্ধ জিএসপি হারিয়ে

12/08/2015 1:33 pmViews: 3

ব্যবসায়ীরা বাকরুদ্ধ জিএসপি হারিয়ে


ভারত-পাকিস্তানসহ দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা (জিএসপি) পেয়েছে। এ সুবিধার আওতায় এসেছে ভিয়েতনাম-কম্বোডিয়া ছাড়াও আফ্রিকা ও সাবসাহারা অঞ্চলের সবগুলো দেশ। শুধু তা-ই নয়, রাজনৈতিক সম্পর্কের দিক থেকে ঐতিহাসিকভাবেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চরম বৈরী ভেনিজুয়েলা ও ইকুয়েডরের নামও এসেছে জিএসপিপ্রাপ্ত দেশের তালিকায়। বিশ্বের ১২২টি দেশ ও অঞ্চলের এ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি কেবল রাশিয়া ও বাংলাদেশের নাম। এ বিষয়ে কোনো আশ্বাস বা শর্তের কথাও বলা হয়নি আমেরিকার ঘোষণায়। বাংলাদেশের প্রতি তার মোট রফতানি আয়ের এক- চতুর্থাংশের জোগানদাতা দেশটির সরকারের এমন মনোভাবে হতভম্ব হয়ে পড়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। তবে ভিন্নমতের প্রতি সরকারের সাম্প্রতিক আচরণ দেখে এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কোনো কথা বলতে না পারায় অনেকটা বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন রফতানিকারকেরা।

প্রকাশ্যে কেউ মুখ খুলতে রাজি না হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জিএসপি সুবিধা না পাওয়ার জন্য মোটাদাগে তিনটি কারণকে দায়ী মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রথমত, সার্বজনীন নির্বাচন অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্রের দাবি উপেক্ষা। দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্রের তীব্র চাপের মুখেও ড. ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকে পুনর্বহাল না করা। তৃতীয়ত, বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্বশীল নেতাদের মুখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং দেশটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সম্পর্কে আপত্তিকর ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যমূলক মন্তব্য। সামসগ্রিকভাবে এর অর্থ দাঁড়ায়, মার্কিন সরকার বাংলাদেশকে তার সুনজরপ্রাপ্ত দেশের তালিকায় রাখেনি। এটিকেই চরম হতাশার এবং বিশ্ববাণিজ্যে টিকে থাকার পথে অন্তরায় হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা।
রফতানিকারকদের ৪২টি সংগঠনের সমন্বয়ে গড়া জোট এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি ও বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী এ প্রসঙ্গে গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার প্রেক্ষাপটে স্থগিত হয়ে যাওয়া জিএসপি পুনরুদ্ধারে আমরা সম্ভব সবকিছুই করেছি। আমাদের অনেক কষ্ট হলেও যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া শর্তানুযায়ী আমরা শ্রমিকদের বেতনভাতা বাড়িয়েছি। কর্মপরিবেশ নিরাপদ করার দিকটিও অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সকে সাথে নিয়ে অনেক দূর নিয়ে এসেছি। তাদের দেয়া ১৬টি শর্তের সবগুলোই পূরণ করা হচ্ছে। এত কিছুর পরও জিএসপিপ্রাপ্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের না থাকাটা দুঃখজনক। এতে বিশ্বদরবারে বাংলাদেশ সম্পর্কে খারাপ বার্তা যাবে।
যুক্তরাষ্ট্রের এমন কঠোর মনোভাবের কারণ প্রসঙ্গে বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনের সময় থেকেই ওয়াশিংটনের সাথে ঢাকার দূরত্ব বাড়তে থাকে। ওই সময় ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি ও পরে ড্যান ডাব্লিউ মজিনা নানা ইস্যুতে সরকারের এ সংক্রান্ত ভূমিকার বিরুদ্ধে জোরালো অবস্থান নেন। গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সরানোর ঘটনায় সোচ্চার হয়ে ওঠেন রাষ্ট্রদূত মজিনা ও দেশটির বেশ কয়েকজন কংগ্রেস সদস্য। যুক্তরাষ্ট্রের ওই সময় দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি কিনটন টেলিফোনে এবং বাংলাদেশ সফরে এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ইউনূসের প নিয়ে নানা অনুরোধ করেন। পরে ২০১৪ সালের নির্বাচন ঘিরে অনেকটাই সক্রিয় হয়ে ওঠেন মজিনা। ওই নির্বাচনকে ‘ত্রুটিপূর্ণ’ ঘোষণা করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের আহ্বানে সর্বদাই অটল ছিল দেশটি। এসব কারণে বিদায়ী সাাতের জন্যও মজিনাকে সময় দেননি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
গত বছর ১৪ জুন হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে ‘বিশ্বায়ন এবং বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের টেকসই সমতা’ নিয়ে অনুষ্ঠিত সেমিনারে বাংলাদেশের পক্ষে তোফায়েল আহমেদ ১৬ দফা কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের অগ্রগতির বিবরণ তুলে ধরে জিএসপি পুনর্বহালের পে জোর দাবি জানালে তার তীব্র বিরোধিতা করেন ওই সেমিনারে অংশগ্রহণকারী ড্যান ডাব্লিউ মজিনা। মজিনার সে দিনের বক্তব্য থেকেই তোফায়েল আহমেদ হয়তো নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন, বাংলাদেশ আর জিএসপি ফিরে পাবে না। যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ অবস্থান টের পেয়েই হয়তো দেশে এসে তিনি দেশটির কঠোর সমালোচনা এবং জিএসপি বিষয়ে হতাশামূলক বক্তব্য দিয়েছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং তৎকালীন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম মজিনাকে ‘কাজের মেয়ে মর্জিনা’ এবং সফররত দেশটির একজন মন্ত্রীকে ‘দুই আনার মন্ত্রী’ বলে মন্তব্য করেছিলেন।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য মতে, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে ১৫ দশমিক ৬২ শতাংশ শুল্ক দিয়ে পণ্য রফতানি করছে। অথচ ভারতের েেত্র গড় শুল্কহার ২ দশমিক ২৯ শতাংশ, চীনের েেত্র ৩ দশমিক ০৮ ও তুরস্কের েেত্র তা ৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ। তৈরী পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশ সারা বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। আমাদের চেয়ে বেশি রফতানি করে চীন, ভিয়েতনাম ও ভারত। ২০১৪ সালে ভিয়েতনাম সে দেশে ৯৭০ কোটি ডলারের তৈরী পোশাক রফতানি করলেও বাংলাদেশ করেছে ৫২৮ কোটি ডলার। টিপিপি স্বারের পর ভিয়েতনাম-অ্যামচেম প্রণীত যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি ল্যমাত্রা অনুযায়ী, ২০২৫ সালে ভিয়েতনামের রফতানির পরিমাণ দাঁড়াবে ১৯৯০ কোটি ডলার, সেখানে বাংলাদেশের রফতানি হতে পারে ৯১০ কোটি ডলার। যদিও পরিবর্তিত পেক্ষাপটে সব প্রত্যাশাই ভেস্তে যাবে বলে আশঙ্কা ব্যবসায়ীদের।
জিএসপিবিহীন অবস্থায় বিশ্ববাণিজ্যে বাংলাদেশের অবস্থান কেমন হতে পারেÑ এমন প্রশ্নের জবাবে প্রকাশ্যে সব ব্যবসায়ী-অর্থনীতিবিদই ইনিয়ে-বিনিয়ে বলতে চাইছেন, বাংলাদেশের প্রধান রফতানি পণ্য তৈরী পোশাক যেহেতু আগেও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জিএসপি সুবিধা পাচ্ছিল না, সেহেতু আমাদের তেমন ক্ষতি হবে না। তবে ‘অফ দ্য রেকর্ড’ পরিভাষা উল্লেখ করে তারাই আবার বলছেন, পরিস্থিতি হবে ভয়াবহ। তাদের কেউ কেউ এমনও বলেছেন, ‘১৬ দফার বাইরে যে দফাটির ওপর যুক্তরাষ্ট্র বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে তার নাম গণতন্ত্র। কাজেই সবার অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হলে জিএসপির মতো আরো অনেক কিছুই আমাদের হারাতে হবে।’ এমন মন্তব্যও এসেছে, ‘যুক্তরাষ্ট্র না চাইলে বাংলাদেশ পৃথিবীর কোনো দেশেই পণ্য রফতানি করতে পারবে না’।

Leave a Reply