বোরো ধান চাষের নতুন প্রযুক্তি
কৃষকরা অ্যারোবিক পদ্ধতি ব্যবহার করে আর্থিকভাবে লাভবান বলে জানিয়েছেন। এ পদ্ধতিতে প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে সেচের পানি ৬০ শতাংশ কম লাগে। ফলনও প্রতি ধানের গোছায় বেশি হয়। বিদ্যুৎ সংকটের এই সময় এ পদ্ধতি সারাদেশে সম্প্রসারণ করলে প্রতি বছর দেশের ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকার ডিজেল ও বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে বলে জানিয়েছিন গবেষকরা।
জানা যায়, বোরো ধান চাষের জন্য ভূগর্ভ থেকে প্রচুর পরিমাণ পানি উত্তোলনের প্রয়োজন হয়, যার জন্য বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ, ডিজেল বা জ্বালানি লাগে সে কারণে বোরো মৌসুমে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ঘাটতি বেড়ে যায়। তাছাড়া অনেক সময় বিপুল পরিমাণ পানি উত্তোলনের ফলে পানির স্তর নিচে নেমে যায় ও ফসলহানি ঘটে থাকে। অন্যদিকে প্রচুর পানি উত্তোলনে অনেক সময় ভূমি দেবে যায়, মাটিতে লবণাক্ততা, আয়রন, আর্সেনিক দূষণ ইত্যাদি পরিবেশগত সমস্যার সৃষ্টি হয়। সেচের জন্য সেচ সাশ্রয় করতে পারলে একদিকে বিদ্যুৎ, ডিজেল ইত্যাদি সাশ্রয় হবে এবং উৎপাদন খরচ কমে যাবে, অন্যদিকে পরিবেশগত সমস্যা দূর করা সম্ভব হবে।
বোরো ধান চাষে সেচ সাশ্রয়ের জন্য বিভিন্ন উপায় অবলম্বনের চেষ্টা করা হচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশে অডউ (ম্যাজিক পাইপ) পদ্ধতিটি ব্যাপকভাবে গ্রহণের জন্যে সরকারিভাবে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ পদ্ধতিতে সর্বোচ্চ ২০-৩০ ভাগ সেচের পানি সাশ্রয় হয় বলে জানা গেছে। কিন্তু বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিতত্ত্ব বিভাগের গবেষণার মাধ্যমে অ্যারোবিক বা শুকনা পদ্ধতিতে বোরো ধান চাষ করলে কমপক্ষে ৫০-৬০ ভাগ সেচের পানি সাশ্রয় হবে ও ধানের ফলন প্রচলিত পদ্ধতির সমান বা বেশি হবে।
এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মোঃ মশিউর রহমান জানান, অ্যারোবিক বা শুকনা পদ্ধতিতে বোরো ধান চাষের জন্য জো অবস্থায় (ফসল লাগানোর উপযুক্ত সময়) জমি তৈরিতে শুকনা জমিতে প্রাইমিং করা ধানের বীজ (বপনের উপযুক্ত) নির্দিষ্ট দূরত্বে বপন করতে হয়। পরে প্রয়োজনমতো সেচ প্রদান করা হয়। এ পদ্ধতিতে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে জানুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত বীজ বপন করা যেতে পারে। এ পদ্ধতির জন্য ব্রিধান-২৯ সবচেয়ে ভালো। তবে বিনা ধান-৬, ব্রিধান-৪৭ ও ব্রিধান-২৮ জাতের চাষ করা যেতে পারে। ধানের বীজ প্রথমে ২৪-৩০ ঘণ্টা পানিতে ভেজানো হয় এবং পরে ২৪-৩০ ঘণ্টা জাগ দিয়ে ধান বীজের মুখ ফাটা অবস্থা তৈরি করা হয়। জমির উর্বরতা ও ধানের জাতভেদে সারের মাত্রা নির্ধারিত হবে। গোবর, কম্পোস্ট, টিএসপি, এমপি, জিপসাম ও দস্তা সার জমি তৈরির সময় প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া ৪ কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে। যন্ত্র বা নিড়ানির মাধ্যমে আগাছা দমন করা যাবে। শুকনো পদ্ধতিতে আগাছার আক্রমণ রোধ করতে প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় ২ বা ৩টি বেশি নিড়ানি দরকার হয়। নিড়ানি খরচ বেশি হলেও পানি ও চারা রোপণের খরচ কম লাগে বলে অধিক মুনাফা পাওয়া যাবে। চীন ও ভারতে বিভিন্ন আগাছানাশক যেমন_ বাই স্পাইরিকেব সোডিয়াম, ট্রাইফ্লুরালিন, পেনক্সসুলাম ইত্যাদি ব্যবহার করে কম খরচে সফলতার সঙ্গে শুকনো পদ্ধতির ধানের জমিতে আগাছা দমন করা হয়। বপনের পর জমিতে রস না থাকলে হালকা সেচ দিতে হবে। এরপর ৬০-৭০ দিন পর থেকে প্রয়োজনমতো ৭-১০টি সেচ দিতে হবে। উল্লেখ্য, অ্যারোবিক পদ্ধতিতে বপন থেকে ৯০ দিন পর্যন্ত খুব অল্প পরিমাণ সেচ লাগে। থোড় আসার সময় থেকে বীজ পুষ্ট হওয়ার সময় পর্যন্ত জমিতে সামান্য পানি রাখা ভালো। প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় এ পদ্ধতিতে পোকামাকড় ও রোগবালাইয়ের আক্রমণ কম হয়। পোকামাকড় ও রোগের আক্রমণ হলে আইপিএম অথবা আইসিএম পদ্ধতি অনুসরণ করে দমন করতে হবে। এ পদ্ধতিতে প্রচলিত বা এডবি্লউডির তুলনায় বীজ থেকে বীজ পর্যন্ত ১৫-২০ দিন কম সময় লাগে। প্রচলিত বা এডবি্লউডি পদ্ধতিতে ৩০ দিনের চারা রোপণের দিন থেকে ফসল কর্তন পর্যন্ত যে সময় লাগে শুকনো পদ্ধতিতে বীজ বপন থেকে ফসল কর্তন পর্যন্ত তার থেকে ১০-১৫ দিন বেশি সময় লাগে। প্রকল্পের সহযোগী গবেষক মোঃ মেহেদী মাসুদ ও মোঃ হাফিজুর রহমান জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া ও পরিমিত বৃষ্টিপাতের অভাবে খাদ্য উৎপাদন হুমকির সম্মুখীন। ফলে প্রচলিত পদ্ধতির বদলে শুকনো পদ্ধতির মাধ্যমে বোরো ধান চাষ করে একদিকে যেমন সেচের পানি সাশ্রয় করা যাবে, অন্যদিকে দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সমস্যা সমাধানের পথ উন্মুক্ত হবে। তাই শুকনো পদ্ধতি বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয় করে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও খাদ্য নিরাপত্তায় বিশেষ অবদান রাখবে।