বৃটিশ পার্লামেন্টে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ

26/05/2016 10:59 amViews: 5

বৃটিশ পার্লামেন্টে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ

 

সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ড নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের ভাষ্যের সঙ্গে একমত নয় যুক্তরাজ্য। দেশটির মিনিস্টার অব স্টেট, ফরেন ও কমনওয়েলথ অফিস হুগো সয়্যার বৃটিশ পার্লামেন্টকে এই তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন ধর্ম অবমাননার কারণে এসব হত্যাকাণ্ড হয়েছে এবং সরকারবিরোধীরা দেশকে অস্থিতিশীল করতে এসব ঘটাচ্ছে। বৃটিশ সরকার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত নয়। আমরা মনে করি, এ সমস্যা আরো গভীরে প্রোথিত। মঙ্গলবার বৃটিশ পার্লামেন্টে হুগো সয়্যার এসব কথা বলেন। এ দিন বৃটিশ পার্লামেন্টে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। যত দ্রুত সম্ভব একটি জাতীয় নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপের বিষয়ও উঠে আসে আলোচনায়। বলা হয়, বাংলাদেশ সঠিক পথে যাচ্ছে না। এ অবস্থায় বাংলাদেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় ও দেশটি যাতে একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত না হয় সে জন্য বৃটেনের হস্তক্ষেপের বিষয়টিও আলোচিত হয়। আলোচনায় উঠে আসে সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডে সরকারের পদক্ষেপ নিয়ে। এ বিষয়ে সরকার ধীরগতিতে পদক্ষেপ নিচ্ছে বলে অভিযোগ করেন কয়েকজন এমপি। তারা বিভিন্ন প্রশ্ন করেন হুগো সয়্যারকে উদ্দেশ্য করে। ওই বিতর্কের বাংলাদেশ অংশ এখানে তুলে ধরা হলো:

সিমন ড্যানচুক: বাংলাদেশে মানবাধিকার রক্ষায় তার বাংলাদেশি প্রতিপক্ষের সঙ্গে সম্প্রতি কি আলোচনা করেছেন। অ্যালেক্স কানিংহাম: এলজিবিটি জনগণের বিরুদ্ধে যে সহিংসতা হচ্ছে সে বিষয়ে তিনি বাংলাদেশ সরকারের কাছে কি বক্তব্য রেখেছেন।

হুগো সয়্যার: ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর আঘাতে যেসব পরিবার তাদের প্রিয়জনকে হারিয়েছে এবং ঘরবাড়ি হারিয়েছে তাদের প্রতি শুরুতেই আমি সমবেদনা প্রকাশ করছি। বাংলাদেশ সরকার যে শক্ত নেতৃত্ব প্রদর্শন করেছে তাকে স্বাগত জানাই। মানবাধিকার ও এলজিবিটি জনগণের বিরুদ্ধে সহিংসতার বিষয়ে আজ সকালেই (মঙ্গলবার) বাংলাদেশি হাইকমিশনারের কাছে আমি উদ্বেগ জানিয়েছি। মিনিস্টার অব স্টেট, ডিপার্টমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট, আমার সম্মানিত বন্ধু নিউ ফরেস্ট ওয়েস্টের সদস্য ২০১৫ সালের আগস্টে বাংলাদেশ সফরকালে এ বিষয়টি উত্থাপন করেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে।

সিমন ড্যানচুক: বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের গুম ও ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশ দ্রুতগতিতে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে। মন্ত্রী কি মনে করেন না যে, যত দ্রুত সম্ভব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যাতে একটি যথার্থ জাতীয় নির্বাচন দেন সে জন্য একটি অবরোধ দেয়ার এটাই উপযুক্ত সময়?

হুগো সয়্যার: অবশ্যই এলজিবিটি অধিকারকর্মী জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু মাহবুব তন্ময়কে কাণ্ডজ্ঞানহীনের মতো হত্যায় আমি চরমভাবে আতঙ্কিত। এসব হত্যায় যারা জড়িত তাদেরকে বিচারের আওতায় আনার জন্য আমরা বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছি। ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও যারা ইসলামের বিরুদ্ধাচরণ করে এমন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন ও জীবনযাপন করেন উগ্রপন্থিরা তাদেরকে হত্যা করছে। ২০১৫ সাল থেকে এমন হত্যাকাণ্ড বেড়ে গেছে। এ বিষয়টি নিয়ে আমরা বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা করছি।

অ্যালেক্স কানিংহ্যাম: মন্ত্রী বলেছেন তিনি বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি কি আসলেই মনে করেন যে, এলজিবিটি জনগণের বিরুদ্ধে সহিংসতার ইস্যুটিকে মোকাবিলায় পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার?

হুগো সয়্যার: পরিষ্কার করে বলছি, আমি তা মনে করি না। বাংলাদেশে আমাদের সুনির্দিষ্ট কিছু দায় রয়েছে। আমরা সেখানে সবচেয়ে বড় দাতা। ২০১৫-১৬ সময়ে আমরা তাদেরকে ১৬ কোটি ২০ লাখ পাউন্ড অনুদান দিয়েছি। তাই সেখানে আমাদের কথার ওজন আছে। গত বছরে ব্লগারদের নিরাপত্তা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছে আমাদের মানবাধিকার ও গণতন্ত্রবিষয়ক প্রোগ্রাম। বাংলাদেশে এলজিবিটি অধিকার বিষয়ক গ্রুপগুলোকে অনুমোদন দেয়ার একটি প্রকল্পে আমরা অর্থায়ন করেছি। তারপরও এখনও অনেক প্রচুর কাজ করতে হবে। বাংলাদেশ সরকারকে সঠিক পথে চলার ক্ষেত্রে উদ্যোগী করতে আমরা দ্বিধান্বিত নই। তবে সে জন্য কিছুটা সময় প্রয়োজন। তাদেরকে বোঝাতে হবে।

নুসরাত গনি: বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষদের অধিকার হুমকির মুখে। গত মাসে ঢাকায় আইনের ছাত্র নাজিমুদ্দিন সামাদকে ‘আই হ্যাভ নো রিলিজিয়ন’ ব্লগ লেখার জন্য হত্যা করা হয়েছে। আমার সম্মানিত বন্ধু এ বিষয়টি বাংলাদেশি প্রতিপক্ষের কাছে  উত্থাপন করেছেন ও ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তিদের অধিকার বাংলাদেশে নিশ্চিত এমন নিশ্চয়তা পেয়েছেন?

হুগো সয়্যার: আমার সম্মানিত বন্ধু যথার্থই বলেছেন। ৯ই এপ্রিল ঢাকায় নাজিমুদ্দিন সামাদ হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে দায়েস। শুধু তা-ই নয়। ২৩শে এপ্রিল রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে হত্যার দায়ও তারা স্বীকার করেছে। বাংলাদেশে এখন নিয়মিত এটা ঘটে আসছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এ জন্য বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে দায়ী করছেন। ইসলাম অবমাননার জন্য নির্যাতনের শিকারদের দায়ী করা হচ্ছে। এ বিষয়ে আমাদের দ্বিমত আছে। আমরা মনে করি, সমস্যা আরো গভীরে প্রোথিত।

রিচার্ড ফুলার: মানবাধিকার সুরক্ষায় বাংলাদেশ সরকারের অক্ষমতা ও কার্যকর বিরোধী দলের অনুপস্থিতি রয়েছে। তাই যুক্তরাজ্য সরকার, যেটি বাংলাদেশকে উল্লেখযোগ্য অনুদান প্রদান করে থাকে, তাদের হস্তক্ষেপের একটি সময়সূচি থাকা কি উচিত নয়? যাতে করে দেশটিতে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সুরক্ষা নিশ্চিত হয় ও দেশটি একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত না হয়?

হুগো সয়্যার: আমি তা মনে করি না। বন্ধু ইঙ্গিত দিচ্ছেন যে, আমাদের উচিত আমাদের ঋণ স্থগিত করা। এর মাধ্যমে দুনিয়ার সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় থাকা কিছু মানুষ উপকৃত হয়। তিনি বলছেন, রাজনৈতিক অগ্রগতির কথা। আমি তার যুক্তি বুঝতে পারছি। বাংলাদেশে আমাদের আরো অনেক কিছু করার আছে এবং আমরা চেষ্টা করছি, কমনওয়েলথের মহাসচিবের নতুন ভূমিকার মাধ্যমেও। বাংলাদেশ অবশ্যই কমনওয়েলথের একটি সদস্য রাষ্ট্র। আমরা চাই কমনওয়েলথ বাংলাদেশে আরো কিছু করুক। কারণ, দেশটি এ মুহূর্তে সঠিক পথে এগিয়ে যাচ্ছে না।

ড. লিসা ক্যামেরন: প্রতিদিন বাংলাদেশ থেকে বিদেশে প্রায় ৭০ থেকে ৮০ জন নারী ও শিশু পাচার হয়। বাধ্যতামূলক পতিতাবৃত্তি ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যর্থ হচ্ছে। বাংলাদেশে নারী ও শিশুদের জন্য আইনি কাঠামো শক্তিশালী করতে চাপ প্রয়োগের ব্যাপারে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কী আলোচনা করছেন?

হুগো সয়্যার: শ্রদ্ধেয় ক্যামেরন একেবারে সঠিক বলেছেন। যদিও অবশ্যই বাংলাদেশই কেবল এসবের শিকার হচ্ছে না। আইনের মাধ্যমে আমরা মানব পাচারের ব্যাপারে অনেক কিছু করেছি। সাপ্লাই চেইনের ব্যাপারেও আমরা অনেক কিছু করেছি। আমি জানি এখানে আমাদের উদ্বেগ রয়েছে। শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ ব্যাপারটি আমরা উত্থাপন করছি। এটা এমন জিনিস যা আমরা মুছে ফেলতে চাই। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এটা খুবই প্রচলিত একটা ব্যাপার। আমরা একে গুরুত্বের সঙ্গে নিই।

ফ্যাবিয়ান হ্যামিল্টন: বাংলাদেশে উদারপন্থি অ্যাক্টিভিস্টদের সামপ্রতিক হত্যাকাণ্ডে মন্ত্রীর উদ্বেগ শুনে ভালো লাগছে। তিনি ২৫শে এপ্রিল জুলহাজ মান্নানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কথা উল্লেখ করেছেন। জুলহাজ দেশের প্রথম ও একমাত্র এলজিবিটি ম্যাগাজিনের সমপাদক ছিলেন। তিনি ৬ই এপ্রিল ব্লগার নাজিমুদ্দিন সামাদের ওপর প্রাণঘাতী চাপাতি হামলার কথা উল্লেখ করেছেন। নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশ সরকার এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে খুবই ধীরগতি অবলম্বন করেছে। এ ধরনের হত্যার ঘটনা সঠিকভাবে মোকাবিলা করা হবে- তা নিশ্চিতে বাংলাদেশ সরকারের ওপর অতিরিক্ত কী ধরনের চাপ প্রয়োগ করতে তিনি ও বৃটিশ সরকার প্রস্তুত?

হুগো সয়্যার: বাংলাদেশ সরকার যুক্তি দেখাবে, যেমনটি হাইকমিশনার আজ সকালে (মঙ্গলবার) আমার সঙ্গে দেখিয়েছেন। তাদের যুক্তি, এসব অপরাধের একজন ভিকটিম বাংলাদেশের সাবেক একজন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাজিন। তাই এটা তারা খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছে। আমি বিশ্বাস করি যে, বাংলাদেশের সমস্যা আছে। বিভিন্ন ধরনের ইস্যু নিয়ে আমরা বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রাখবো, যেসব ইস্যু অত্যন্ত উদ্বেগের।

Leave a Reply