বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের দাবি পূরণের আশ্বাস
একদিকে দাবি পূরণের ব্যাপারে এমন অবস্থা, অন্যদিকে কর্মবিরতি প্রত্যাহারে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানের কারণে উভয় সংকটে পড়েছেন শিক্ষক নেতারা। বৈঠকে যোগ দেয়া একাধিক শিক্ষক নেতার সঙ্গে সোমবার রাতে কথা বলতে গিয়ে দেখা যায়, তারা বেশ চিন্তিত। বিশেষ করে সিনিয়র সচিবের সমান বেতন-ভাতাসংক্রান্ত প্রধান দাবি পূরণের বিষয়ে তারা সুনির্দিষ্ট কোনো আশ্বাস পাননি। বিপরীত দিকে প্রধানমন্ত্রী কর্মবিরতি প্রত্যাহার করে শিক্ষকদের ক্লাসে ফিরে যেতে আহ্বান জানিয়েছেন। এমন অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান বাস্তবায়নের ইস্যুতে সাধারণ সভা মোকাবেলা নিয়ে তারা চিন্তিত হয়ে পড়েছেন।
জানতে চাইলে ফেডারেশনের মহাসচিব অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল যুগান্তরকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সন্ধ্যা ৫টা ৪০ মিনিটে আমাদের বৈঠক শুরু হয়। শেষ হয় ৭টা ২০ মিনিটে। দীর্ঘসময় তিনি আমাদের কথা শুনেছেন। অনেক বিষয় নিয়েই আলাপ হয়েছে। আমরা তার কাছে মূলত দুটি প্রস্তাব তুলে ধরেছি। পাশাপাশি দাবির যৌক্তিকতা উপস্থাপন করা হয়েছে। তিনি সব কথা শুনে আমাদের আশ্বাস দিয়ে বলেছেন, আমি নিজে বিষয়টি দেখছি। পাশাপাশি তিনি শিক্ষকদের ক্লাসে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।’ এক প্রশ্নের জবাবে মহাসচিব বলেন, ‘অধ্যাপকদের একটি অংশকে সুপার গ্রেড দেয়ার বিষয়টি দেখবেন বলে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন। শিক্ষকদের গ্রেড-৩ থেকে গ্রেড-১-এ যাওয়ার ক্ষেত্রে সোপান তৈরি করে দেয়ার বিষয়েও আশ্বাস দিয়েছেন।’
একাধিক সূত্র জানায়, বৈঠক শুরু হয় প্রধানমন্ত্রীকে সম্বোধন করার অনুমতি প্রার্থনার মধ্যদিয়ে। এক শিক্ষক নেতা প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, ‘মাননীয় নেত্রী, আমরা যখন ছাত্র রাজনীতি করেছি, তখন আপনাকে আপা ডাকতাম। আজ কী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ডাকব। তখন তিনি বলেন, আপাই ডাকো।’ এভাবে আলাপ-আলোচনার শুরু হয়। এক পর্যায়ে অধ্যাপকদের একটি অংশকে সুপার গ্রেডে (সিনিয়র সচিবের সমান) বেতন-ভাতা দেয়ার প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে পিরামিড স্ট্রাকচারের প্রসঙ্গ আনেন প্রধানমন্ত্রী। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং জাতীয় অধ্যাপকদের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন। জবাবে শিক্ষক নেতারা জানান যে, পিরামিড কাঠামো প্রশাসনিক ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনিক কাঠামোতে এ পদ্ধতি বহাল আছে। একাডেমিক ক্ষেত্রে এই নীতি প্রযোজ্য নয়। এ সময় তারা ভারতসহ বিশ্বের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন। ইমেরিটাস ও জাতীয় অধ্যাপকরা নিয়মিত চাকরির অংশ নন বলেও প্রধানমন্ত্রীকে জানানো হয়। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে শিক্ষকদের ৬৫ বছর চাকরির বয়সের বিষয়টিও উত্থাপিত হয়। তিনি এ সময় বলেন যে, এ সুবিধা সচিবরা পান না। তখন একজন শিক্ষক নেতা বলেন, ‘আপা আপনি ওনাদের (আমলা) পক্ষ নেবেন না। আমরা আপনার কাছে সরাসরি এসেছি। আপনিই শিক্ষকদের বিষয় দেখবেন।’
এ আলোচনার ফাঁকে সচিবদের পক্ষ থেকে কথা উঠলে শিক্ষক নেতাদের দোষারোপ করার চেষ্টা করা হয়। তখন এক শিক্ষক নেতা এক সচিবের উদ্দেশে বলেন, আপনারা জটিলতা তৈরি করবেন না। আপনাদের কারণে আজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে। তখন হস্তক্ষেপ করে প্রধানমন্ত্রী ওই শিক্ষক নেতাকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘লক্ষ্মীপুরের লক্ষ্মী ছেলে। শান্ত হও।’
জানা গেছে, বৈঠকের এক পর্যায়ে অর্থমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবির বিষয়টি তোলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি অনুযোগ করে বলেন, এ কারণে অর্থমন্ত্রী পদত্যাগপত্র নিয়ে এসেছিলেন। এভাবে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়। প্রধানমন্ত্রী সব বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু গবেষণা প্রকল্প পুনরায় চালুর বিষয়েও আশ্বাস দেন।
সোমবার বিকালে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবনে দেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের জন্য পিঠা উৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল। শিক্ষকরা সেখানে যোগ দেয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এ অনানুষ্ঠানিক বৈঠক শুরু হয়। বৈঠকে যোগ দেয়া এক শিক্ষক নেতা জানান, প্রধানমন্ত্রী আগেই তার নিরাপত্তা কোরের এক সামরিক কর্মকর্তাকে বলে রেখেছিলেন।
বৈঠকে ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যাপক ফরিদউদ্দিন আহমেদ, মহাসচিব অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামালসহ ফেডারেশন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির ৮ নেতা উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ, জনপ্রশাসন সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী ও অর্থ সচিব মাহবুব আহমেদ যোগ দেন।
জানতে চাইলে অধ্যাপক ফরিদউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে আন্তরিক পরিবেশে বৈঠক হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আমাদের সব কথা ও দাবি-দাওয়ার বিষয় শুনেছেন। তিনি সমস্যা সমাধানের বিষয়ে আশ্বাস দিয়েছেন।’
প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব এহসানুল করিমও বৈঠকের বিষয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি জানান, ‘বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে শিক্ষকরা কথা বলেছেন। একটি ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘গ্রেড-৩ থেকে গ্রেড-১-এ যেতে পদোন্নতির সোপান তৈরি করা হবে। বাকি দাবিগুলো যথাযথভাবে বিবেচনা করা হবে।’ এক প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘শিক্ষকরা তাদের কর্মসূচির বিষয়ে নিজেদের ফোরামে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন।’
৫ দফা দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা ১১ জানুয়ারি থেকে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতিতে আছেন। অষ্টম দিনে শিক্ষকদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক হল।