বিদ্যুৎ খাতের মূল সমস্যা প্রাথমিক জ্বালানি সংকট
বিদ্যুৎ খাতের মূল সমস্যা প্রাথমিক জ্বালানি সংকট
অধ্যাপক ম. তামিম
বিদ্যুৎ খাতে বাংলাদেশের মূল সমস্যা প্রাথমিক জ্বালানির সংকট। আমাদের গ্যাসের মজুদ দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। আর বিকল্প জ্বালানি হিসেবে কয়লার ব্যবহারও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ অবস্থায় বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি করতে না পারলে আগামী বছর বিদ্যুতের ঘাটতি আরও বাড়বে। এমনকি বড় দুটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ সময়মতো শেষ হওয়া নিয়েও সন্দেহ আছে। আর কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র দ্রুত নির্মাণ করা না হলে নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা করছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ম তামিম। গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বিদ্যুৎ খাতের বিভিন্ন সমস্যা ও তার সমাধান নিয়ে এসব কথা বলেন।
ম তামিম বলেন, আমাদের ৯৫ ভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় গ্যাস দিয়ে। ২০০৭ সালের আগে বাংলাদেশে বিদ্যুতের সংকট শুরু হয়। তবে এর আগে গ্যাসের মজুদ থাকলেও তখন পর্যাপ্ত বিদ্যুৎকেন্দ্র ছিল না। ১৯৯৫ সালের শেষেও বিদ্যুতের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ঘাটতি ছিল না। কিন্তু এরপর থেকেই বিদ্যুৎকেন্দ্রের অভাবে বিদ্যুৎ সংকট শুরু হয়। সে সময় যে পরিমাণ প্রাথমিক জ্বালানি ছিল তা পর্যাপ্ত ছিল না। আমার মতে, প্রাথমিক জ্বালানি সংকটের বিষয়টি চিহ্নিত করতে সময় নষ্ট করা ছিল সংশ্লিষ্টদের বড় ধরনের ভুল। অন্যদিকে ফুলবাড়ী ঘটনার জন্য বিকল্প জ্বালানি হিসেবে কয়লার ব্যবহারের ক্ষেত্রেও বাধা সৃষ্টি হয়েছিল। ২০০৭ থেকে ‘০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দ্রুত তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনে যায়। বর্তমান সরকারও গ্যাস সরবরাহের মাধ্যমে নতুন কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি না করে দ্রুত তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রসার করে। এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বলেন, শেভরন বিবিয়ানা, জালালাবাদ গ্যাস ক্ষেত্রগুলোর মাধ্যমে এখন প্রায় ২৬শ মিলিয়ন ঘন ফুট গ্যাস উৎপাদন করছে যা মোট গ্যাসের ৫৭% আর পেট্রোবাংলার দেশীয় গ্যাসের পরিমাণ ৩৭%-এ নেমে এসেছে। অর্থাৎ আমাদের দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধি পায়নি। এ সময়ের মধ্যে নতুন কোনো গ্যাস ক্ষেত্রও আবিষ্কার হয়নি। চিন্তার বিষয় এই যে, বর্তমানে গ্যাসের মজুদও ফুরিয়ে আসছে। এখন আমরা বছরে এক ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ) গ্যাস ব্যবহার করছি। আর ২৭শ মিলিয়ন ঘন ফুট গ্যাসের সরবরাহ ঘাটতি আছে। গ্যাসের ঘাটতির জন্য এখন বিদ্যুৎকেন্দ্র থাকার পরও আমরা প্রায় এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছি না। ধারণা করছি, আমাদের সম্ভাব্য আরও ১৫ বছরের গ্যাস মজুদ আছে। ম তামিম আরও বলেন, আমাদের বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বিশেষ করে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো নির্মাণ শেষে উৎপাদনে যাওয়ার জন্য যে নির্ধারিত সময় সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে তা বারবার পিছিয়ে যাচ্ছে। সরকার বলছে, ২০২২ সালে মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আর ২০১৯ সালে রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি সম্পন্ন হবে। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে এ কেন্দ্র দুটির নির্মাণ শেষে উৎপাদনে যাওয়ার ব্যাপারে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আশা করছি, আগামী বছর নাগাদ কয়লাভিত্তিক এ কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন প্রক্রিয়া শুরু হবে। তবে এ ক্ষেত্রে আমদানিকৃত কয়লার বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। আমাদের দেশীয় কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা ভাবতে হবে। তা না হলে জ্বালানিতে পরনির্ভরশীলতা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আমি মনে করি, সরকার যে বড় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করছে এটা ইতিবাচক উদ্যোগ। তবে এ কেন্দ্রগুলো যদি সময়মতো তৈরি না হয় সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের নানা ধরনের সাময়িক অসুবিধায় পড়তে হবে। এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বলেন, সমস্যা সমাধানে আমাদের দীর্ঘমেয়াদি প্রাথমিক জ্বালানির নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। আমদানিকৃত কয়লার পাশাপাশি দেশীয় কয়লার ব্যবহার বাড়াতে হবে। ম তামিম বলেন, বিদ্যুৎ খাতের মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী সরকার প্রথমে ভারত থেকে তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা করেছিল। এটি বাড়িয়ে সরকার এখন ছয় থেকে সাত হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ভারত থেকে আমদানির কথা ভাবছে। এটি ইতিবাচক উদ্যোগ। লোডশেডিং প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বুয়েটের এই অধ্যাপক বলেন, পুরনো বিতরণ ব্যবস্থা ও এ খাতে সংশ্লিষ্টদের অপরিকল্পিত পদ্ধতিতে কাজ করার জন্যই বিদ্যুৎ বিভ্রাট হচ্ছে। বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে আমাদের আরও সাশ্রয়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র লাগবে। গরম-শীতে সব সময় আমাদের পাঁচ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করার সক্ষমতা থাকতে হবে। আর এ সমপরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করার মতো বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রও লাগবে। বর্তমানে আমাদের ৩৫শ মেগাওয়াটের ডে লোড আছে। আর দিনে ১৫শ থেকে ১৮শ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ ঘাটতি আছে। পিক আওয়ারে এ বছর ৮০০ মেগাওয়াটের ঘাটতি আছে। আর উৎপাদন বাড়াতে না পারলে আগামী বছর এ ঘাটতি আরও বৃদ্ধি পাবে।