বিএনপি বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে পাটশিল্প ধ্বংস করে :প্রধানমন্ত্রী ‘ব্যাংকের এমডি পদের জন্য দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের বিচার করবে জনগণ’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে একের পর এক পাটকল বন্ধ করে পাটকে ধ্বংস করে দিয়েছিল বিএনপি সরকার। ১৯৯৬ সালে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার সোনালী আঁশ পাটের সুদিন ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। বন্ধ থাকা খুলনার খালিশপুর জুটমিল, সিরাজগঞ্জের কওমী জুটমিলসহ ৫টি পাটকল ও ২টি বস্ত্রকল চালু করি। এতে প্রায় ২১ হাজার নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কার্যকরী পদক্ষেপের কারণে পাটের সোনালী দিন ফিরেছে। পাট ও পাটজাত পণ্য থেকে রপ্তানি আয় বেড়েছে। আর প্রযুক্তির এই উত্কর্ষের যুগেও পাটের সেই অমিত সম্ভাবনা রয়ে গেছে। পাট চাষ ও সংরক্ষণে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর কৃষিবিদ ইনষ্টিটিউশন মিলনায়তনে প্রথমবারের মতো জাতীয় পাট দিবস ও বহুমুখী পাটপণ্য মেলা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মোহাম্মদ ইউনূসকে ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের দেশের স্বনামধন্য একজন ব্যাংকের এমডি পদ নিয়ে কত বড় ষড়যন্ত্র করলেন। পদ্মা সেতুর কাজ পর্যন্ত বন্ধ করে দিলেন। ব্যাংকের এমডি পদের লোভে যে মানুষটি দেশের এতো বড় সর্বনাশ করতে পারে, তার বিচার দেশবাসী একদিন করবে।’ তিনি বলেন, ‘বয়স হয়েছে এমডি পদ ছেড়ে দেবেন, এটাই নিয়ম।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘ওই সময় মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে বিশ্বব্যাংক বলছিল, এই করলে টাকা দেবে, ওই করলে টাকা দেবে। কিন্তু আমি বলেছিলাম, মিথ্যা অভিযোগ নিয়ে আমরা কোনো টাকা নেবো না। তখন আমি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলাম যে পদ্মা সেতু প্রকল্পে কোনো দুর্নীতি হয়নি। সম্প্রতি কানাডার আদালতে তা প্রমাণিত হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘ওই সময় মানসিকভাবে আমার ও আমার বোন, ছেলে, মেয়েসহ পরিবারের ওপর দিয়ে যে কত অত্যাচার গেছে, তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। দেশের মানুষের মান মর্যাদা আমার ও আমার পরিবারের জন্য ক্ষুণ্ন হবে না, অন্তত এটা আমি কথা দিতে পারি।’ পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নে করা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই কাজ শুরু করা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। এ সেতুর নির্মাণ কাজ চলছে। বাংলাদেশে পদ্মা সেতু হলে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ সবচেয়ে বেশি সুফল পাবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে পাটকে অবহেলা করেছে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি। বিশ্ব ব্যাংকের পরামর্শে এবং অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার অসত্ উদ্দেশে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার বৃহত্ পাটকল আদমজী জুটমিল বন্ধ করে দেয়। তিনি বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোট ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় আসার পরই বিশ্ব ব্যাংকের পরামর্শে একটি চুক্তি করে যে, পাটকলগুলো একে একে বন্ধ করে দেবে। ১৯৯৩ সাল থেকেই বন্ধের কাজ শুরু হবে, বিনিময়ে তারা গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে পাটকলের শ্রমিকদের বিদায়ের জন্য বিশ্বব্যাংক থেকে টাকা পাবে। তিনি বলেন, বিএনপি যখন ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের সঙ্গে এই চুক্তি করলো তখন ওয়ার্ল্ড ব্যাংক আবার ভারতের সঙ্গে একটি চুক্তি করে। যে চুক্তি মোতাবেক বিশ্বব্যাংক ভারতকে টাকা দেবে নতুন পাটকল তৈরির জন্য। শেখ হাসিনা বলেন, ‘বিএনপি যে চুক্তিটা করেছিল তাতে আড়াই লাখ বেল পাট রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকে চুক্তি মোতাবেক তাদের টাকায় ভারতে যে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে তাতে আড়াই লাখ বেল পাট উত্পাদনে সক্ষমতা থাকবে।’ তিনি বলেন, বিএনপি বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে চুক্তিটা করে আসলো, আর আমি সেটার কাগজ সংসদে উপস্থাপন করি এবং আওয়ামী লীগ এর তীব্র বিরোধিতা করে। যেটা জাতীয় সংসদের সংসদ কার্যাবলীতেও পাওয়া যাবে (৯১-৯৬)। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি সে সময় সংসদে তাদের কাছে (বিএনপি) প্রশ্ন তুললাম- আমাদেরকে তো সবসময় ভারতের দালাল বলেন অথচ আপনাদের দালালির যে জ্বলন্ত উদাহরণ সামনে সেটার কি করবেন?’ তিনি বলেন, এভাবেই আমাদের পাটকলগুলোকে তারা একে একে ধ্বংস করে দেয়। বিএনপি সরকারের আমলে পাট শ্রমিকদের আন্দোলন প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৯১ সালে বিএনপি যখন সরকারে, তখন এই শ্রমিকেরা আন্দোলন করেছিল। আওয়ামী লীগ তখন পাট শ্রমিকদের আন্দোলনের সঙ্গে যুগপত্ আন্দোলন করে পাটের ন্যায্যমূল্যের দাবিতে প্রেস কনফারেন্সও আয়োজন করে। ওই সময় বিএনপি-জামায়াত আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর গুলি চালিয়ে ১৭ জন শ্রমিককে হত্যা করে।
প্রধানমন্ত্রী স্মৃতিচারণ করে বলেন, ১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে (যুক্তফ্রন্ট সরকার) তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী এবং তিনি ‘জুট মার্কেটিং করপোরেশন’ গড়ে তোলেন। এই পাটের রপ্তানি, উত্পাদন, বিপণন ও গবেষণা কার্য বৃদ্ধি করার জন্য।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাটের বহুমুখী ব্যবহার হচ্ছে। যে শাড়িটা পরে এসেছি, এটা পাটের তৈরি, যে ব্যাগটা ব্যবহার করছি, সেটাও পাটের তৈরি। বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে পাটের বহুমুখীকরণ করে যাচ্ছি। পাট থেকে উন্নত তন্তু, পলিথিনের মতো হালকা উন্নতমানের পাটের ব্যাগ, ?ওষুধি গুণসম্পন্ন চায়ের মতো পাট পাতার পানীয়, পাটের বস্ত্র, ব্যাগ, নিত্য ব্যবহার্য বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী ব্যবহারে সুবিধা ও গুরুত্বের কথা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
অভ্যন্তরীণ বাজারে পাটের চাহিদা সৃষ্টিতে সরকারের উদ্যোগ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন-২০১০’ এবং ‘পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার বিধিমালা ২০১৩’ কার্যকর হয়েছে। ইতোমধ্যে ১৭টি পণ্যে পাটজাত মোড়কের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
বস্ত্র ও পাট মন্ত্রী ইমাজউদ্দিন প্রামাণিকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মীর্জা আজম, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব গোপাল কৃষ্ণ ভট্টাচার্য প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী পাট খাতে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯টি ক্যাটাগরিতে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে সম্মাননা প্রদান করেন। পাট বিষয়ে সারাদেশে আয়োজিত রচনা প্রতিযাগিতার বিজয়ীদের মাঝেও পুরস্কার বিতরণ করেন প্রধানমন্ত্রী।